‘ইহারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির-ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা-রসের মতো অলক্ষ্যে’- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কথাটি বলেছিলেন একটি প্রবন্ধে। যারা সৃষ্টিশীল কাজের নিমজ্জিত থাকেন; হাঁকডাক নয়, সৃষ্টিতেই যাদের উল্লাস, তাদের নিয়েই এমন বাণী দিয়েছিলেন কবি। যুগ যুগ পেরিয়ে সে অমর বাক্য এখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে। যারা সৃষ্টিকর্মে মুন্সিয়ানা দেখিয়েও থেকে যান অলক্ষ্যে, আড়ালে।

তেমনই একজন মানুষ রাজেশ ঘোষ। বাংলা গানের নন্দিত সুরকার। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে পেশাগতভাবে সংগীতে মিশে আছেন তিনি। তার সুরে সৃষ্ট অসংখ্য গান হয়েছে শ্রোতাপ্রিয়, কালজয়ী। বিশেষ করে সংগীত তারকা আসিফের গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর সিংহভাগই তার সুর করা। কয়েকটি গানের নাম না বললেই নয়- ‘একাকী গভীর রাতে’, ‘ও পাষাণী’, ‘বিদায় বন্ধু’, ‘বাঁচবো না’, ‘মেঘে মেঘে’, ‘ঝড় উঠেছে’, ‘কখনো কখনো ইচ্ছের বাইরেও’, ‘ডানা ভাঙা পাখির মতো’ ইত্যাদি।

এত এত জনপ্রিয় গান, তবুও কেন রাজেশ ঘোষ আড়ালেই থেকে যান? ঢাকা পোস্ট থেকে এমন প্রশ্ন রাখা হয় তার কাছে। জবাবে এই সুরকার বলেন, ‘আসলে কিছু মানুষ থাকে, যারা সারাক্ষণ কাজে ডুবে থাকতেই ভালোবাসে। আমি তেমনই একজন। আমি বিশ্বাস করি, আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখবে। সেটার জন্য ঢাকঢোল পেটাতে হয় না। আমি যদি ভালো গান করি, তাহলে মানুষ ঠিকই জেনে যাবেন।’

সুরকার রাজেশ ঘোষের উত্থান কীভাবে? কবে থেকে তিনি গানের সঙ্গে যুক্ত? একেবারে শুরুর সময়ের গল্পটা তিনি তুলে ধরলেন আলাপে। বললেন, “ছোটবেলা থেকেই গানবাজনার প্রতি আগ্রহ। খুলনায় থাকতে ‘গোল্ডেন স্ট্রিংস’ নামে আমার একটা ব্যান্ডও ছিল। ১৯৮৭ সালে সেটা গঠন করেছিলাম। সেখানে আমি ভোকাল এবং লিড গিটারিস্ট ছিলাম। স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন শো করতাম। তো স্বপ্ন জাগে নিজের গান প্রকাশ করার। সেই স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় আসি ১৯৯৬ সালে। আসার পর নিজের লেখা-সুরে কিছু গান রেকর্ড করি। রেকর্ডের পর বুঝলাম, আমার আরও সময় নিতে হবে। আরও শিখতে হবে।”

এরপর রাজেশ বিভিন্ন স্টুডিওতে গিয়ে বসে থাকতেন, দেখতেন কীভাবে গানের সুর হয়, মিউজিক হয়। এভাবে সময় কাটতে থাকে।  নিজেও কিছু গান বানাতে থাকেন। কিছু দিন পর রেহমান মিন্টু নামের আরেক নবাগত শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় রাজেশের। তিনি রাজেশকে প্রস্তাব দিলেন, তার একটি অ্যালবামের গান করে দেওয়ার জন্য। সাহস নিয়ে কাজটিতে হাত দেন রাজেশ। ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে প্রকাশিত হয় সেই অ্যালবাম। নাম ছিল ‘কাঁদালে কেন’। প্রকাশিত হয় সাউন্ডটেক থেকে।

এরই ফাঁকে পরিচয় ঘটে গীতিকার প্রদীপ সাহার সঙ্গে। তার লেখা কিছু গানেও সুর দেন রাজেশ। তখন মঞ্জু নামের এক সংগীতানুরাগী রাজেশকে প্রস্তাব দেন একটি মিক্সড অ্যালবাম করার। যেখানে গান করবেন এন্ড্রু কিশোর, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী ও মনির খান। এখানকার সবগুলো গানই সুর করেন রাজেশ। অ্যালবামের নাম ‘প্রবঞ্চনা’। সিডি সাউন্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে এটি প্রকাশের ব্যবস্থা করেন মঞ্জু। তিনি একপ্রকার ঝুঁকি নিয়েই অ্যালবামটি করান। কিন্তু প্রকাশের পর সেই ঝুঁকি অপার সম্ভাবনায় পরিণত হয়।

২০০০ সালের দিকে আসিফ আকবরের সঙ্গে পরিচয় হয় রাজেশের। এর এক বছর পর তিনি আসিফের সঙ্গে গানের কাজ শুরু করেন। তারপরের ইতিহাসটা কম-বেশি সবারই জানা। প্রদীপ সাহার কথায়, রাজেশের সুরে আসিফের গান মানেই দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা। 

আসিফ ছাড়া আরও অনেক বিখ্যাত শিল্পীর জন্য গান বেঁধেছেন রাজেশ। তেমন কালজয়ী কয়েকটি গানের নাম জানতে চাইলে রাজেশ জানান, মিতালী মুখার্জির ‘জীবন নামের রেলগাড়িটা পায়না খুঁজে ইস্টিশন’, আকবরের ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে’, বিউটির ‘উড়াল পাখি’ ইত্যাদি।

একটা সময় নিয়মিত গান করেছিলেন আসিফ-রাজেশ-প্রদীপ; এখন এই ত্রয়ীর গান পাওয়া যায় না কেন? অগণিত শ্রোতাদের মনেই এমন প্রশ্ন। জবাবে রাজেশ বললেন, ‘অনেকে ভাবতে পারেন, আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক হয়ত ভেঙে গেছে, এজন্যই আমরা একসঙ্গে আর গান করি না। কিন্তু না, বিষয়টা একদমই সেরকম না। আমাদের মধ্যে এখনো সুন্দর সম্পর্ক আছে। নিয়মিত যোগাযোগ হয়। আসলে আগের মতো গান নিয়ে সেভাবে বসা হয় না। অ্যালবামের প্রচলন চলে গেছে। আগে তো একসঙ্গে বসে অ্যালবামের গান রেডি করতাম। এখন সময় পাল্টেছে। সিঙ্গেল গান, মিউজিক ভিডিওর সময় এসেছে। আমরা নতুন গান নিয়ে আলাপ করেছি। আশা করি শিগগিরই একটা সুখবর দিতে পারব।’

নতুন গান করার জন্য ভক্তদের কাছ থেকেও প্রচুর অনুরোধ পান বলে জানালেন রাজেশ। তার ভাষ্য, ‘আমি এখনো নিয়মিত গান করি। কিন্তু সেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছায় না। অথচ মানুষ এখনো আমাকে কী পরিমাণ ভালোবাসে, তা আমি উপলব্ধি করি। আমি তো সেভাবে নতুন গান দিতে পারছি না, তবুও তারা আমাকে ভালোবাসেন, এটা সত্যিই বড় পাওয়া। আশা করি, তাদের নতুন গানের দাবি দ্রুতই মেটাতে পারব।’

গান নিয়ে নতুন একটি পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন রাজেশ। যেসব গান এখন ইউটিউবে পাওয়া যায় না, কিংবা এখনকার শ্রোতারা শুনতে পারেননি; সেগুলো নতুন সংগীতায়োজনে প্রকাশ করবেন। নতুন শিল্পীদের দিয়ে গানগুলো গাওয়াবেন। যাতে গানগুলো নতুন প্রজন্মের কাছেও ছড়িয়ে যায়।

কেআই/আরআইজে