বাংলা গানের ইতিহাসে এক মহাকাব্য সমান অংশ দখল করে আছেন জেমস। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, গানের ভুবনে আসা এবং সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করা; এসব বিষয়ে আলোচনা করার আগে একটু অন্য প্রসঙ্গে বলতে চাই। আমার শৈশব-কৈশোরের গল্প।

তখন আমি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। চারদিকে অডিও গানের ছড়াছড়ি। টেপ রেকর্ডারে বাজে নানা ধরণের গান। আসিফ, আতিক হাসান, রবি চৌধুরী, নাসির, শুভ্রদেব, এন্ড্রু কিশোর-দের গান শোনা যেতো বেশি। আইয়ুব বাচ্চুর একক গানও অনেক শোনা হতো। তবে ব্যান্ড সংগীতের ব্যাপারটা তখনও তেমন জানতাম না। 

সেসময় দু’একজনের ঘরে মাঝেমধ্যে ব্যতিক্রম কণ্ঠের, ভিন্ন সুরের কিছু গান বাজতো। এলাকার অন্যরা তাদের বলতো পাগল! অর্থাৎ যাদের মাথা ঠিক থাকে না, তারা ওরকম গান শোনে। সে গান জেমসের। লম্বা জটা চুল, পাগলামি ভরা গায়কী আর অচেনা সব কথার গান। সহজ-সরল গ্রামীণ মানুষের কাছে তার গানগুলো পাগলামি মনে হওয়াটা হয়ত স্বাভাবিক ছিল।

জেমসের গান আমাকে ছুঁতে পারেনি তখনো। কারণ তার গান বোঝার মতো বোধ তখনো তৈরি হয়নি। কলেজ জীবনে এসে আমি চিনলাম জেমসকে। তার গানকে। আর প্রেমে পড়লাম। পাগল হলাম। মুগ্ধ হলাম। ডুবে গেলাম। জেমস তো এমনই এক শিল্পী, যার গানের সমুদ্রে ডুবে যাওয়া যায়। বুকভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে সাঁতার কাটা যায়।

দেশের সংগীতাঙ্গনে জেমস-ই একমাত্র শিল্পী, যিনি পঞ্চাশ পেরিয়েও এখনো সমানতালে গান করতে পারেন। এখনো তার কণ্ঠ দিয়ে আগুন ঝরে। মঞ্চে উঠলে তিনি বিলিয়ে দেন উন্মাদনা। ব্যান্ড কিংবা আধুনিক গানের আর কোনো শিল্পী এমন বয়সে এসে এতোটা এনার্জি নিয়ে গান পরিবেশন করতে পারেননি, হয়ত পারবেনও না। জেমস তাই অনন্য, অদ্বিতীয়।

জেমসকে নিয়ে এত কথা লিখছি, কারণ আজ তার জন্মদিন। যদিও তাকে নিয়ে বলা কিংবা লেখার জন্য দিন-ক্ষণের প্রয়োজন নেই। তবু জন্মদিনের মতো বিশেষ উপলক্ষকে ঘিরে একটুখানি তো লেখাই যায়।

আজ ২ অক্টোবর জেমসের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন নওগাঁয়। তবে তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। আর ছিলেন রক্ষণশীল। ছেলে গান ভালোবাসে, গান করতে চায়; মানতে পারেননি তিনি। কিন্তু ছেলেও তো অনড় নিজের স্বপ্নে। প্রচণ্ড অভিমানে তাই ঘরছাড়া।

কিশোর মাহফুজ আনাম ছেড়ে দিলেন ঘর। উঠলেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর আজিজ বোর্ডিংয়ে। অনিশ্চিত আগামীর দিকে পা বাড়ালেন গানের স্বপ্নে বিভোর জেমস। গিটার আর গানের চর্চা করতে থাকলেন। আর কাছের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তুললেন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’।

বিশ্ব সংগীতের সঙ্গে জেমসের ছিল আত্মিক যোগাযোগ। তাই দেশে যখন সাইকিডেলিক রক গান করার সাহস করেননি, তখন জেমস সেই পথেই হাঁটলেন। ব্যতিক্রম এই ধাঁচে গানের চর্চা করতে থাকলেন তিনি ও তার ব্যান্ডের সদস্যরা। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা গান করেছেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করতে হলে তো যেতে হবে ঢাকায়। তাই আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকায় আসে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ড। ১৯৮৭ সালে প্রকাশ হয় তাদের প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’। অ্যালবামটি সাফল্যের মুখ দেখেনি। তবে এর ‘আগের জনমে’, ‘আমায় যেতে দাও’ এবং ‘রূপসাগর’ গান তিনটি কিছুটা জনপ্রিয় হয়েছিল।

এরই ফাঁকে জেমস তার একক ক্যারিয়ারে নজর দেন। ১৯৮৯ সালে তিনি তার প্রথম একক অ্যালবাম প্রকাশ করেন। ‘অনন্যা’ শীর্ষক সেই অ্যালবামও সাফল্যের প্রত্যাশা পুরোপুরি ছুঁতে পারেনি। যেই সংগীতের জন্য ঘরছাড়া, এত সাধনা, সেই সংগীত যেন জেমসকে ভালোবেসে বুকে টেনে নিচ্ছিল না। তাই কিছুটা হতাশা চেপে ধরলো তাকে।

‘অনন্যা’ প্রকাশের চার বছর পর শুরু হলো জেমস ঝড়। বুকের ভেতরকার সব দুঃখ, হতাশা যেন আগুন হয়ে বেরিয়েছিল ১৯৯৩ সালের ‘জেল থেকে বলছি’ অ্যালবামে। ফিলিংস ব্যান্ডের প্রথম সাফল্য, সেই সঙ্গে জেমসের দাপটের সূচনা। এই অ্যালবামের টাইটেল গানটি দেশজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তরুণদের মাঝে জেমস পরিণত হলেন নতুন ক্রেজে।

এরপর একে একে আসে ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬), ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮), ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১), ‘পালাবে কোথায়’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৭) এবং ‘কাল যমুনা’ (২০০৮)।

১৯৯৬ সালে ফিলিংস ব্যান্ড থেকে ‘নগরবাউল’ প্রকাশের পর সেটি ব্যাপক সফলতা পেয়েছিল। সেই সুবাদে ব্যান্ডের নাম ফিলিংস থেকে নগরবাউল রাখেন জেমস। আর এই নামে ব্যান্ড থেকে প্রকাশিত একমাত্র অ্যালবাম ‘দুষ্টু ছেলের দল’।

ব্যান্ড তারকা হলেও জেমস মূলত একক শিল্পী হিসেবে অধিক জনপ্রিয় ও সফল। যার সুবাদে তিনি গান করেছেন বিশ্বের অন্যতম সিনে ইন্ডাস্ট্রি বলিউডেও। মুম্বাইয়ের এই সিনে জগতে জেমস চারটি সিনেমায় গান করেছেন। আর পেয়েছেন সাফল্য। ২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় ‘ভিগি ভিগি’ এবং ‘ও লামহে’ সিনেমায় ‘চাল চালে’ গান দুটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। এর মধ্যে ‘ভিগি ভিগি’ গানটি ভারত এবং বাংলাদেশ দুই দেশেই ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল। এছাড়া ২০০৭ সালের আলোচিত সিনেমা ‘লাইফ ইন অ্যা মেট্রো’ সিনেমায় তিনি ‘রিশতে, আলভিদা’ গান করেছেন। সেটিও ছিল সফল। তারপর ২০১৩ সালে আবারও বলিউডে গান করেন জেমস। ‘ওয়ার্নিং থ্রিডি’ সিনেমায় তার সেই গানের নাম ‘বেবাসি’।

বলিউডে জেমসের পদচারণা সাফল্যমণ্ডিত। তাই বলে তিনি সেখানে স্থায়ী হয়ে যাননি। বরং নিজ দেশেই থেকে গেছেন এই তারকা। গান করেছেন দেশের শ্রোতাদের জন্যই।

দেশের সিনেমায় জেমসের জনপ্রিয় গানের সংখ্যাও কম নয়। ‘কষ্ট’ সিনেমায় ‘দশমাস দশদিন’, ‘মনের সাথে যুদ্ধ’ সিনেমায় ‘আসবার কালে আসলাম একা’, ‘নারীর মন’ সিনেমায় ‘মীরাবাঈ’, ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেয়াম্য ‘দেশা আসছে’, ‘সত্তা’ সিনেমায় ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’, ‘আগুন আমার নাম’ সিনেমায় ‘পাগলা হাওয়ার তরে’, ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমায় ‘এত কষ্ট কষ্ট লাগে কেন অন্তরে’ এবং ‘সুইটহার্ট’ সিনেমায় ‘বিধাতা’ গানগুলো শ্রোতাদের অসামান্য ভালোবাসা পেয়েছে।

জেমসের গাওয়া অন্যান্য জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘তারায় তারায়’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না’, ‘হতেও পারে এই দেখা শেষ দেখা’, ‘কবিতা তুমি স্বপ্নচারিণী’, ‘দুস্টু ছেলের দল’, ‘দিদিমনি’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’, ‘তোর সব কিছুতে নয় ছয়’, ‘বাবা কত দিন দেখি না তোমায়’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান’, ‘এক নদী যমুনা’ ইত্যাদি।

গান দিয়ে নিজের প্রাপ্তির খাতা দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছেন জেমস। ‘সত্তা’ এবং ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেমায় গান গেয়ে দুইবার জিতেছেন শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বিশেষ করে দেশের বাইরে ভারতের মানুষ তাকে বিপুল শ্রদ্ধা করে। সে দেশের তারকাদের কাছেও জেমস একজন তারকা।

জেমসের ব্যক্তিজীবনের গল্প বরাবরই আড়ালে থেকেছে। তিনি দুটি বিয়ে করেছেন। তার প্রথম স্ত্রী ছিলেন রথি। তিনি ছিলেন একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ১৯৯১ সালে বিয়ের পর ২০০৩ সালে তারা আলাদা হয়ে যান। রথির সঙ্গে বিচ্ছেদের আগেই ২০০২ সালে জেমস বিয়ে করেন বেনজির সাজ্জাদকে।

কেআই/আরআইজে