কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে ৩৬টি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ-সৌমিত্র জুটি এখনো রূপালি দুনিয়ায় সমাদৃত, স্মরণীয়। কীভাবে এই যুগলের যাত্রা হয়েছিল? অস্কারজয়ী সত্যজিতের সিনেমায় কীভাবে যুক্ত হয়েছিলেন সৌমিত্র? সেই গল্পটাই চলুন জেনে নেওয়া যাক…

১৯৩৫ সালের ১৯ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তার। ছাত্র অবস্থায় তিনি বিখ্যাত অভিনেতা ও নির্মাতা অহিন্দ্র চৌধুরীর কাছে অভিনয় শিখেছিলেন। কলেজের ফাইনাল ইয়ারে তিনি শিশির ভাদুরির অভিনয় দেখে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হন তিনি। এরপরই একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বুনতে থাকেন সৌমিত্র।

এরই ফাঁকে অল ইন্ডিয়া রেডিওর ঘোষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ওই সময়েই তিনি সত্যজিৎ রায়ের সান্বিধ্যে পান। নিয়মিত যোগাযোগ, দেখাসাক্ষাৎ হতো। তখন সত্যজিৎ তার ‘অপরাজিত’ সিনেমার জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। এতে সৌমিত্রর অভিনয় করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিধি বাম! কারণ ততদিনে সৌমিত্রর বয়স ২০-এর কোঠায়। যা চরিত্রের তুলনায় অনেক বেশি।

কিন্তু সত্যজিৎ রায় ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন, তার ক্যামেরার সামনে সৌমিত্রকে আনবেনই। এই কথা অবশ্য সৌমিত্র নিজেও জানতেন না। ১৯৫৮ সালে সত্যজিৎ রায় তার ‘জলসাঘর’ সিনেমার শুটিং করছিলেন। সেই শুটিং দেখার জন্য সেটে যান সৌমিত্র। কিন্তু তার জন্য কতবড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, কল্পনাও করেননি তিনি।

সেদিন শুটিং সেট থেকে চলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সৌমিত্রকে ডাক দেন সত্যজিৎ রায়। তারপর অভিনেত্রী ছবি বিশ্বাসের কাছে গিয়ে বলেন, ‘ও হচ্ছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আমার পরবর্তী সিনেমায় অপুর চরিত্রে অভিনয় করবে’। এই কথা শুনে সৌমিত্র মুহূর্তেই হতবাক হয়ে যান।

কিছু দিন পরই শুরু হয় ‘অপুর সংসার’-এর শুটিং। সৌমিত্র জীবনে প্রথমবারের মতো বড় পর্দার জন্য অভিনয় করলেন। নিজেকে ঢেলে দিলেন চরিত্রের ভেতর। নির্মাণ শেষে ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় সিনেমাটি। মুক্তির পর এই সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা কোথায় পৌঁছে যায়, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যুগের পর যুগ পেরিয়ে এখনো অপু সবার হৃদয়ে সঞ্জীব হয়ে আছে।

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টপাধ্যায় আরও যেসব সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘অশনি সংকেত’, ‘অভিযান’, দ্য কাওয়ার্ড’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘চারুলতা’, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ইত্যাদি।

দীর্ঘ ষাট বছর ধরে অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তার অভিনীত সিনেমার সংখ্যা ২১০টির বেশি। সিনেমা ছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বহু নাটক, যাত্রা এবং টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন। মঞ্চনাটকেও ছিল তার সরব পদচারণা। অভিনয়ের বাইরে তিনি ছিলেন লেখক ও আবৃত্তিকার। নাটক কবিতা লিখে সমাদৃত হয়েছেন। এছাড়া তাকে বাংলা ভাষার একজন সেরা আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়।

অভিনয়ের জাদুতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জয় করেছিলেন সবই। উপমহাদেশে যে কারোর চেয়ে তার প্রাপ্তির পাল্লা ভারি বটে। ফ্রাঞ্চের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘অফিসার দেস আর্টস এট মিটারস’ লাভ করেছেন তিনি। ইতালির নেপলস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাকে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। ১৯৭০ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় পদক পদ্মশ্রী, ২০০৪ সালে পদ্ম ভূষণ-এ ভূষিত হন তিনি।

এছাড়াও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে অ্যাওয়ার্ড, তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, আটবার বিএফজেএ পুরস্কার, দুইবার ফিল্মফেয়ার পূর্ব পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার সাউথ পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।

২০২০ সালের ৫ অক্টোবর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এর পর দিনই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কিছু দিন পর করোনা থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু তার শরীরে বাসা বাঁধে অন্যান্য জটিলতা। যার ফলে আর ফেরা হয়নি বরেণ্য এই অভিনেতার। ১৫ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আজ নন্দিত এই অভিনেতার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রয়াণের এই দিনে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

কেআই