ক্ষমতা এমন এক প্রক্রিয়া, যা সুবিধামতো অপব্যবহার করা যায়। তবে এটাকে টিকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। সেজন্য হতে হয় হিংস্র। প্রয়োজনে অবিশ্বাসের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অর্জিত বিশ্বাসের হৃদপিণ্ড ছুরি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে হয়, যেন ভবিতব্য শত্রু পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু ক্ষমতা কখনোই চিরস্থায়ী হয় না। উল্টো দিকে তাক করে থাকা বল্লমের আঘাতে একপাশে রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকে আর অন্যপাশে চলতে থাকে ক্ষমতার পালাবদল।

উইলিয়াম শেক্সপিয়য়ের বিখ্যাত ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে এ ধরনের ঘটনার অবতারনা পাওয়া যায়। এই ট্র্যাজিক নাটক অবলম্বনে ওয়েব সিরিজ বানিয়েছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য, যার নাম ‘মন্দার’। যদিও ভারতীয় ছাঁচে ফেলে গল্পে কিছুটা সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। তবে বিষয়বস্তু অভিন্ন। অনেকাংশে স্বতন্ত্র।

স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকানের বিশ্বস্ত ছিলেন সেনাপতি ম্যাকবেথ। নরওয়ে ও আয়ারল্যান্ডের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। রাজা ডানকান সেনাপতির এই সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে তার প্রাসাদে আতিথ্য গ্রহণ করেন। লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে ম্যাকবেথ সেই রাতেই ডানকানকে হত্যা করে নিজেকে স্কটল্যান্ডের রাজা ঘোষণা করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকা বিদ্রোহীদের হাতে ম্যাকবেথের মৃত্য হয়। ডানকানপুত্র ম্যালকমই সিংহাসনে বসেন।

‘মন্দার’-এর প্রেক্ষাপট গেইলপুরের জেলেপাড়া। এখানে রাজা ডানকানের প্রতিভূ ডাবলু ভাই। তার ছেলে ম্যালকম হয়েছেন মঞ্চা। ডানকানের অনুগামী ম্যাকডাফ মিশে গেছেন মদন চরিত্রে। সেনাপতি ম্যাকবেথ হয়েছেন মন্দার। লেডি ম্যাকবেথ মন্দারের স্ত্রী লাইলি। ব্যাঙ্কোর চরিত্রে বঙ্কা। তার ছেলে ফ্লিয়ান্সরূপে ফন্টুস।

যারা ‘ম্যাকবেথ’ পড়েছেন তারা জেনে থাকবেন, রাজা ডানকানের দুই পুত্রের পিতা। কিন্তু বাংলা সংস্করণে এক ছেলে দেখানো হয়েছে। নাটকে ডানকানের স্ত্রী উহ্য থাকলেও এখানে তাকে রাখা হয়েছে পরাধীন এক নারী হিসেবে। অনুগামী রাজনীতিবিদ মদনের স্ত্রীর পরিবর্তে বোন চরিত্রটি দেখানো হয়েছে। মূল নাটকের তিন ডাইনির পরিবর্তে মা, ছেলে ও তাদের কালো বিড়ালকে ডাইনিরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া নাটকে অসৎ পুলিশ অফিসার মুকাদ্দার চরিত্রটি না থাকলেও এতে সংযোজিত করেছেন পরিচালক।

এই চরিত্রগুলো নিয়েই ডাবলু ভাইয়ের গেইলপুর সাম্রাজ্য। একটা সময় সেই সাম্রাজ্যে ম্যাকবেথের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা মন্দারকে পতনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ডাবলু ভাইয়ের পুত্র মঞ্চাই বাবার সাম্রাজ্য দখলে নেয়।  

সিরিজটিতে তিনজন ছাড়া বাকি সব অভিনয়শিল্পী অপরিচিত। যতদূর জানা যায়, তারা সবাই পরীক্ষিত মঞ্চকর্মী। ডাবলু ভাই চরিত্রে অভিনয় করা দেবেশ রায় চৌধুরীর অভিনয় প্রশংসাযোগ্য। এলাকার একমাত্র প্রভাবশালী ও লম্পট ব্যক্তির যে ধরনের শারীরিক ভাষা, বাচনভঙ্গী—সব ছিল মানানসই। পুরান চাল আসলেই ভাতে বাড়ে!

তবে অভিনয়ে মাত করে দিয়েছেন লেডি ম্যাকবেথ লাইলি। একসঙ্গে একাধিক চরিত্রে দেখা গেছে তাকে। কখনো তিনি মাতৃত্বের স্বাদ পেতে আকুল। কখনো স্বামী-অন্তপ্রাণ। আবার কখনো অন্যের শয্যাসঙ্গী। এর বাইরে তার চরিত্রে একধরনের হিংস্রতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটে। চরিত্রের প্রতিটি স্তর বিন্যাসে অনবদ্য অভিনয় করেছে সে। এজন্য সোহিনী সরকার ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ পেতেই পারেন। এটি তার জীবনের সেরা অভিনয়।

অসৎ পুলিশ অফিসার মুকাদ্দার তথা অনির্বাণ পরিপাটি অভিনয় করেছেন। শুরু থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, তিনি আসলে কোন গোছের মানুষ। একটা সময় মনে হচ্ছিল, হয়ত তিনি শেষদিকে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। আবার কখনো মনে হয়েছে তিনি খারাপ হয়েই থাকবেন। এই যে দর্শকের মনোজগতকে দোদুল্যমান রাখতে পেরেছেন—এটা অনির্বার্ণের কৃতিত্ব।

নাম-ভূমিকার অভিনেতা মন্দাররূপি দেবাশীষ মন্ডল ভালো অভিনয় করেছেন বটে। তার চোখের অভিব্যক্তি ভালো লেগেছে। তবে কোথায় যেন একটু খামতি থেকে গিয়েছে। প্রস্ফুটিত হতে গিয়ে পারেননি। দায়টা পরিচালককেই নিতে হবে এক্ষেত্রে।

বাকি সবাই যে যার চরিত্র অনুযায়ী পরিমিত অভিনয় করেছেন। ডাইনি ও তার ছেলে পেদোর অভিনয় অনবদ্য লেগেছে। বিশেষ করে রোগা-পাতলা পেদোর দৌড় তো চোখে লেগে আছে।

সিরিজটির সিনেমাটোগ্রাফি ছিল চোখ জুড়ানো। দৃশ্যের প্রয়োজনের ‘সিম্বলিক ন্যারেটিভ’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা এই সিরিজের সৌন্দর্য। শুরুর দিকে সমুদ্র তীরে জীবন্ত মাছের সামনে উদ্ভট অঙ্গভঙ্গিতে পেদোর নাচ, এমন সময় কালো বিড়াল এসে দাঁড়ানো। খানিক বাদে নৌকার উপর থেকে বসে ডাইনি বুড়ির বল্লম ছুঁড়ে ডাঙায় থাকা মাছ শিকার—এসবই জানান দিয়েছে শঙ্কিত এক এলাকায় প্রবেশ করতে যাচ্ছে দর্শক। যেখানে প্রতি মুহূর্তে আছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, প্রাণনাশের সম্ভাবনা।

শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক লাল রঙ। জেলেপাড়ার রাজা হওয়ার স্বপ্ন সে প্রথম দেখে যখন তিনি ফুটপাত থেকে লাল রঙের চশমা কেনে মন্দার। বিক্রেতাও তাকে বলেছে, বাদশাহ সানগ্লাস তার চোখে ভালো মানাবে।

ডাবলু ভাইয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের পর লাইলি বাথরুমে কাপড় কাচে। ধীর গতিতে দেখানো দৃশ্যে সমান্তরালভাবে বাকলছাড়া মরা গাছ দেখানো হয়, যেটির আকৃতি যোনির মতো। লাইলির সঙ্গে গাছটির একটা মিল খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। উলঙ্গ নারীর যোনিতেই পুরুষের আকর্ষণ সবসময়।  

মন্দারের যৌন দুর্বলতা আছে। এটা নিয়ে সে প্রচন্ড হীনমন্যতা ভোগে। একরাতে স্বপ্ন দেখে, সমুদ্র তীরে বাসর ঘর। তার স্ত্রী বউ সেজে বসে আছে। যখন তিনি ঘোমটা তোলে তখন দেখতে পায়, কুৎসিত ডাইনি বউ সেজে বসে আছে। সে গাড়িতে করে চলে যেতে চায়, সেই গাড়িও পেছনে সরে যায়। এ থেকে তার এই জৈবিক ব্যর্থতা আরও তীব্র হয়।

একদিকে কসাই ক্লোজ শটে খাসির মাংস কাটছে, অন্যদিকে মৃত ডাবলু ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে মন্দারের যৌন দৃশ্য। কাট কাট শটে দুটি দৃশ্যের আলাদা ভাষা তৈরি করেছে।

শেষ দিকে মন্দারকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয় মঞ্চা ও ফন্টুস। তখন দূর থেকে ডাইনি বুড়ি প্রথম দৃশ্যের মাছ শিকারের মতো বল্লম ছুঁড়ে মন্দারকে হত্যা করে। তার নিথর দেহ পড়ে রয় নৌকা গলুইয়ের উপর। ঘাড়ে এসে বসে ডাইনির কালো বিড়াল।

তবে সিরিজটির কিছু বিষয়ে আপত্তির জায়গা রয়েছে। এখানে সংযোজিত মুকাদ্দার চরিত্রটি সেভাবে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। চরিত্রটি না থাকলে বিশেষ কোনো ক্ষতি হতো না।

চরিত্রগুলোর মধ্যে আন্তরিকতার অভাব দেখা গেছে। ডাবলু ভাইয়ের সঙ্গে মন্দারের সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া দেখা যায়নি। এমনকি ডাবলু ভাইয়ের শয্যাসঙ্গী হওয়ার পরও লাইলির ভেতর কোনো ভালোবাসা তৈরি হয়নি তার জন্য। অথচ তার প্ররোচনায় মন্দার ডাবলু ভাইকে খুন করার পর তাকে হ্যালুসিনেট করে। বঙ্কাকেও হ্যালুসিনেট করে মন্দার। যাদের প্রতি লাইলি ও মন্দারের ভালোবাসা নেই তাদের কেন হ্যালুসিনেট করবে তারা! ক্ষমতার মোহে যারা হিংস্র হয়ে যায়, তারা তো অনুতপ্ত হয় না। খুনটাকেই সঠিক কাজ মনে করে সামনে আরো খুনের জন্য প্রস্তুতি নেয়।

মদন গেইলপুরের রাজনীতিবিদ। তার কথায় ভোটের বিষয়টা সামনে চলে আসে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো কার্যক্রম দেখানো হয়নি। ফলে ভোটের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পায়নি। চাইলে এখানে ভোটের প্রচার এবং এটা কেন্দ্র করে হামলা-মামলা দেখানো যেত।

নিজের যৌন অক্ষমতার চিকিৎসা করাতে শহরে এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের খোঁজ পায় মন্দার। সেখানে চিকিৎসা করিয়ে তিনি সুস্থ হয়। যার প্রমাণ পাই যখন সে ডাবলুর স্ত্রীর সঙ্গে যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আদৌ কি এ ধরনের চিকিৎসায় মানুষ উপকৃত হয়? হাটে-বাজারে যৌন সমস্যা সমাধানে যেসব হাতুড়ে ডাক্তার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে, তারা তো সব ‘ভাওতাবাজি’ করে থাকে। এখানে তাদেরকে প্রমোট করা হয়েছে বলে বোধ করি।

এছাড়া কিছু কিছু জায়গায় গল্প বেশ ধীর গতির মনে হয়েছে। মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুত হচ্ছিল। এর বাইরে মোটামুটি সব ঠিকঠাক ছিল।

সিরিজটিতে গা ছমছমে ভাব আনার জন্য জুতসই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যবহার ভালো লেগেছে। সম্পাদনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। মেকআপ অসাধারণ ছিল। ডাইনি ও তার ছেলে পেদোর মেকআপ দেখলে ‘বমি’ আসতে পারে। তবে ওই দুটি চরিত্রের জন্যই এমন মেকআপ প্রয়োজন ছিল।

অভিনেতা অনির্বাণ দর্শকমনে সমাদৃত। পরিচালক হিসেবে তিনি কেমন করেন—সেটা দেখার বিষয় ছিল। তার প্রথম নির্মাণ ‘মন্দার’ দেখে মনে হলো মঞ্চের নির্দেশনা ও অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছেন।

লেখক: সাংবাদিক, সংবাদ প্রকাশ

কেআই