লতা মঙ্গেশকরকে বলা হতো সুরের সরস্বতী দেবী। গান গেয়ে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে তিনি অদ্বিতীয়। উপমহাদেশের সংগীতে তাকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে সবাই। সেই লতা মঙ্গেশকর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রোববার (৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

লতা মঙ্গেশকর একদিনে উপমহাদেশের কিংবদন্তি হয়ে উঠেননি। প্রায় ৭০ বছরের পেশাদার সংগীত জীবনে ২৭ হাজারের বেশি গানের রেকর্ডিং করেছিলেন তিনি। দেশের ৩৬টি ভাষা-সহ বেশ কিছু বিদেশি ভাষাতেও গান করেছেন। জেনে নেওয়া যাক এই কিংবদন্তির জীবনের বিস্ময়কর কিছু তথ্য।

লতার ভালো নাম ছিল হেমা

লতা মঙ্গেশকরের নাম ছিল হেমা। পরবর্তীকালে তার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের ‘ভাওবন্ধন’ নাটকের লতিকা চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার লতা নামটি রাখেন।

কম বয়সে লতার গানের প্রতিভা চোখে পড়ে বাবার

মঙ্গেশকর পরিবারের সকলেই কোনও না কোনও ভাবে শিল্পজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পন্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রুপদী সংগীত পিয়াসী। অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। একবার তিনি এক ছাত্রকে একটি বিশেষ রাগ অনুশীলনের কথা বলেন। এদিকে ছাত্রটি অনুশীলন করছে। এর মধ্যেই ছোট্ট লতা তার ভুল ধরিয়ে দেয়। সেদিন বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর বুঝতে পারেন, তার বড় মেয়ে গায়িকা হতে চলেছে। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছাড়াও লতা মঙ্গেশকর গানের তালিম নিয়েছিলেন আমানত খান, আমান আলী খানের মতো কিংবদন্তির কাছে।

১৩ বছর বয়সে প্রথম গান রেকর্ডিং

১৯৪২ সালে মরাঠি সিনেমা ‘কিটি হাসাল’-এর জন্য স্টুডিওতে গান রেকর্ডিং করেন লতা। কোনও অজ্ঞাত কারণে সিনেমাটি রিলিজ হলেও গানটি বাদ গিয়েছিল।

অভিনেত্রী হিসাবেও হাতেখড়ি হয়েছিল

১৯৪২ সালে বাবার মৃত্যু আর অর্থনীতিক সংকট মুশকিলে ফেলে দিয়েছিল মঙ্গেশকর পরিবারকে। কিছুটা অর্থের প্রয়োজনেই প্রায় ছ’বছর পেশাদার অভিনয় জীবনে ৮টি সিনেমায় অভিনয় করেন পাঁচ ভাই বোনের সবচেয়ে বড় লতা মঙ্গেশকর।

অনেকেই বলেছিলেনবড্ড সরু গলা

লতা মঙ্গেশকরের জীবনেও ব্যর্থতা এসেছিল। তাও ক্যারিয়ারের শুরুতেই। সেই সময় নুর জাহান, শাম সাদ বেগমের রমরমা সময়। একটু নাঁকি ভারি গলার চল তখন। অনেকেই বলেছিলেন, লতা মঙ্গেশকরের গলা বড্ড সরু। তবে ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ সিনেমার সুপারহিট ‘আয়েগা অনেওয়ালা’ গানের পর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

১৯৬২ সালে লতার খাবারে বিষ মেশানো হয়েছিল

১৯৬২ সালে লতা মঙ্গেশকর গুরুতর অসুস্থ হন। তখন জানা যায়, তাকে স্লো পয়েজন করা হচ্ছিল। পরিস্থিতি এতটাই চিন্তার হয়ে দাঁড়ায়, তাকে প্রায় তিন দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হয়। বিপদ কেটে গেলেও অনেক দিন লাগে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে।

সাংসদ হিসেবে কোনও সুযোগ সুবিধা নেননি

লতা মঙ্গেশকরকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। অসুস্থতার জন্য তিনি রাজ্যসভার সেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু তিনি বেতন বা বাড়ি ভাড়া বা কোনও বাড়তি সুবিধা নেননি, যা সাধারণত দেওয়া হয় সাংসদদের।

প্রসঙ্গত, ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লতার জন্ম এক মারাঠি পরিবারে। বাবার হাত ধরেই গান ও অভিনয়ের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ১৩-১৪ বছরে প্রথম গান গেয়েছিলেন মারাঠি সিনেমায়। হিন্দিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘মজবুর’ সিনেমায়। লতার সুরেলা কণ্ঠ সিনেমা ও গানে প্রাণ ঢেলে দিতো। নক্ষত্রপতনে তাই শোকস্তব্ধ দুনিয়া।

২৭ দিন ধরে করোনা, নিউমোনিয়া আর বার্ধক্যজনিত জটিলতার সঙ্গে লড়াই করেছেন লতা মঙ্গেশকর। ৯ জানুয়ারি তার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে। সেখানে অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছিল লতার। ৩০ জানুয়ারি তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। ভেন্টিলেশন থেকে বের করেও নিয়ে আসা হয় সুরসম্রাজ্ঞীকে। কিন্তু দুদিন আগে পুনরায় তার অবস্থার অবনতি হয়। অবশেষে রোববার সকালে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস