বাবা বলিউডের নামি প্রযোজক। আবার দুই ভাইয়ের একজন বলিউডের খ্যাতনামা অভিনেতা। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রযোজনায় নেমেছিলেন তিনিও। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সময় পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। তাই কাপুর পরিবারের সদস্য হয়েও সঞ্জয় কাপুর সাফল্যের স্বাদ উপভোগ করতে পারেননি।

১৯৬৫ সালের ১৭ অক্টোবর মুম্বাইয়ের চেম্বুরে জন্ম সঞ্জয়ের। তার বাবা ছিলেন প্রযোজক সুরিন্দর কাপুর। ভাই অনিল কাপুর ও বনি কাপুরের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও সঞ্জয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রাজ কাপুরের ছেলে রাজীব কাপুর।

সুরিন্দরের প্রতিবেশী ছিলেন রাজ। সেই কারণে দুজনের স্ত্রীর মধ্যেও বন্ধুত্ব গাঢ় ছিল। রাজীবের সঙ্গে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন সঞ্জয়। কিন্তু পড়াশোনার সূত্রে মুম্বাই ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেন রাজীব। কাছের বন্ধু চলে যাওয়ায় সঞ্জয়ও বিদেশে গিয়ে পড়বেন বলে সুরিন্দরকে জানান। দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ভালো ফল করায় ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে রাজি হয়ে যান সুরিন্দর।

বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছাপূরণ করতে দশম শ্রেণিতে ভালো ফল করেন সঞ্জয়। কিন্তু ছেলেকে দেওয়া কথা রাখতে পারলেন না সুরিন্দর। তখন ছবি বানাতে গিয়ে নিজের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছিলেন সুরিন্দর। ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ফ্লপ করার কারণে খরচ করা টাকার বিন্দুমাত্রও ফিরে আসেনি সুরিন্দরের কাছে। সঞ্জয়কে বিদেশে পাঠানোর মতো আর্থিক পরিস্থিতি ছিল না সুরিন্দরের। তাই মুম্বাইয়ে থেকেই পড়াশোনা করেন সঞ্জয়।

১৯৮৭ সালের ২৫ মে প্রেক্ষাগৃহে শেখর কাপুর পরিচালিত ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ মুক্তি পাওয়ার পর সুরিন্দরের ছেলে অনিলের জনপ্রিয়তা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। সুরিন্দরের বড় ছেলে বনিও তখন প্রযোজনার কাজে হাত দিয়েছেন। এবার সঞ্জয়কেও ইন্ডাস্ট্রিতে নামানোর সিদ্ধান্ত নেন সুরিন্দর।

সুরিন্দর ভেবেছিলেন, শেখরের সঙ্গে সঞ্জয় যদি প্রথম কাজ করেন তাহলে সে ছবি হিট হবে। ইতোমধ্যে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ নিয়ে মাতামাতির শেষ নেই। সুরিন্দরের কথায়, সঞ্জয়ের জন্য একটি রোমান্টিক ঘরানার ছবি তৈরি করতে শুরু করলেন শেখর।

একদিকে সঞ্জয়ের সঙ্গে কাজ করবেন বলে শেখর ছবি তৈরি করছেন, অন্যদিকে বনির সঙ্গেও ‘রূপ কি রানি, চোরো কা রাজা’ ছবিতে কাজ করছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো অজানা কারণে বনির সঙ্গে শেখরের মত পার্থক্য তৈরি হওয়ায় কাপুর পরিবারের সঙ্গে জড়িত সব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন শেখর। সঞ্জয়ের সঙ্গেও কাজ করেননি তিনি।

প্রথম ছবির কাজ হাতছাড়া হওয়ার পর হতাশ হয়ে পড়েন সঞ্জয়। তার পাশে এসে দাঁড়ান সতীশ কৌশিক। একটি রোমান্টিক ঘরানার ছবিতে সঞ্জয়কে অভিনয়ের সুযোগ দেন তিনি। সঞ্জয়ের বিপরীতে নায়িকা হিসেবে তব্বুকে বেছে নেন ছবি নির্মাতারা। ১৯৮৯ সালে ‘প্রেম’ ছবির প্রযোজনার কাজও শুরু হয়।

‘প্রেম’ ছবির কাজ চলাকালে তব্বুর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় সঞ্জয়ের। তাদের দুজনকে একসঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে দেখা যেত। বলিপাড়ায় কানাঘুষা হতে থাকে যে সঞ্জয় ও তব্বু সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সম্পর্কের কথা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা। বহু দিন সম্পর্কে থাকার পর কোনো অজানা কারণে তাদের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু সঞ্জয়ের ক্যারিয়ারে আবার বাধা আসে। ‘প্রেম’ ছবির কাজ শেষ হয়ে গেলেও মুক্তির তারিখ পিছিয়ে যেতে থাকে। ২৫ বছর বয়সে এই ছবিতে কাজ করেছিলেন সঞ্জয়। কিন্তু যখন সেই ছবি মুক্তি পায় তখন সঞ্জয়ের বয়স ৩১ বছর। শোনা যায়, শেখর ছেড়ে যাওয়ার পর ‘রূপ কি রানি, চোরো কা রাজা’ ছবির পরিচালনার দায়িত্ব নেন সতীশ। এই ছবির জন্য নিজের সব টাকা খরচ করে ফেলেছিলেন পরিচালক। কিন্তু ছবিটি ফ্লপ হয়।

‘প্রেম’ ছবির জন্য সময় বের করতে পারছিলেন না সতীশ। ১৯৯৫ সালে ছবিটি মুক্তির পর ভালো সাড়া মেলেনি। ক্যারিয়ারের প্রথম ছবি। যার শুরু থেকেই বারবার বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলেন সঞ্জয়। ছবি মুক্তির পরও সাফল্যের মুখ দেখলেন না অভিনেতা। পরে মাধুরী দীক্ষিতের সঙ্গে ‘রাজা’ ছবিতে অভিনয় করতে দেখা যায় সঞ্জয়কে। মুক্তির পর ছবিটি ভালো সাড়া পেয়েছিল। বলিপাড়ার সবাই জানিয়েছিলেন, মাধুরী ছিলেন বলেই ছবিটি হিট করেছে। সঞ্জয়কে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিলেন বলিপাড়ার তারকারা।

১৯৯৭ সালে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সোহেল খান পরিচালিত ছবি ‘অওজার’। এই ছবির জন্য সোহেলের দুজন অভিনেতার প্রয়োজন ছিল। সোহেল তার ভাই সালমান খানকে এই ছবির জন্য বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় দ্বিতীয় অভিনেতা খোঁজার সময়। সালমান তখন বড় মাপের অভিনেতা। সালমানের সঙ্গে কাজ করলে দর্শক শুধু সালমানকেই দেখবে, দ্বিতীয় অভিনেতা সালমানের পাশে গুরুত্ব পাবেন না। তাই সোহেলের প্রস্তাব বেশির ভাগ অভিনেতাই গ্রহণ করেননি।

শেষ পর্যন্ত সোহেলের প্রস্তাবে রাজি হন সঞ্জয়। শুটিং চলাকালে খান পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় সঞ্জয়ের। এমনকি সালমানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বও মজবুত হয়ে উঠে। শুটিংয়ের ফাঁকে এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিলেন সালমান এবং সঞ্জয়। সেই অভিজ্ঞতার কথা সঞ্জয় এক পুরোনো সাক্ষাৎকারে জানান। সালমান নাকি সঞ্জয়কে কথা দিয়েছিলেন যে সঞ্জয় কোনো ছবির প্রযোজনা করলে সেই ছবিতে সালমান অভিনয় করবেন।

‘অওজার’ ছবি মুক্তির সময় নির্মাতাদের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়েছিলেন সালমান। প্রথমে শহরজুড়ে যে পোস্টার ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানে সঞ্জয়ের ছবির তুলনায় সালমানের ছবি বড় ছিল। তা দেখে সালমান রেগে যান। কারণ এই ছবিতে সালমানের চরিত্রের তুলনায় সঞ্জয়ের চরিত্রটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সালমান তাই ছবির পোস্টার পরিবর্তন করার নির্দেশ দেন। তারপর শহরজুড়ে আবার পোস্টার বদলে ফেলা হয়েছিল। নতুন পোস্টারে সালমান এবং সঞ্জয়ের একই আকারের ছবি ব্যবহার করা হয়।

‘অওজার’ ফ্লপ করলেও সঞ্জয় তার জীবনে ভালো বন্ধু পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সুযোগ নিয়েছিলেন সঞ্জয়ের ভাই বনি। সঞ্জয়ের মাধ্যমে খান পরিবারের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন বনি। সঞ্জয় ভেবেছিলেন, বনির সঙ্গে এক ছবিতে কাজ করবেন। বনি সে রকম কথাও দিয়েছিলেন সঞ্জয়কে। কিন্তু শেষে পিছিয়ে যান বনি।

বনি ছাড়া সঞ্জয়কে পথ দেখানোর মতো কেউ ছিল না। তাই অভিনয় ছেড়ে প্রযোজনার কাজে নামবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন সঞ্জয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সির্ফ তুম’ ছবিটির সাফল্যের পর সঞ্জয় তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। অভিনয় নিয়েই ক্যারিয়ারে এগোবেন বলে ভাবেন তিনি।

‘সির্ফ তুম’ ছবির কাজ চলাকালে সুস্মিতা সেনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু অভিনেত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশি দিন টেকেনি। সুস্মিতার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মাহীপ সান্ধুর সঙ্গে সম্পর্কে আসেন সঞ্জয়। ১৯৯৭ সালে মাহীপকে বিয়েও করেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর নাকি মাহীপকে ঠকিয়েছিলেন তিনি। ‘ফ্যাবুলাস লাইফস অফ বলিউড ওয়াইভস’ শোয়ে এসে মাহীপ এমনটাই দাবি করেছেন। তিনি জানান, বিয়ের পর অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সঞ্জয়। তা জানার পর নিজের সন্তানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান মাহীপ। পরে সেই সমস্যা মিটে গিয়েছিল বলেও জানান মাহীপ।

‘ছুপা রুস্তম’, ‘কোই মেরে দিল সে পুছে’র মতো ছবিতে অভিনয় করে নিজের পরিচয় তৈরি করছিলেন সঞ্জয়। নেতিবাচক চরিত্রেও তার অভিনয় বহুল প্রশংসিত ছিল। এমনকি রামগোপাল বর্মাও একটি দক্ষিণী ছবির হিন্দি অনুকরণ ছবিতে সঞ্জয়ের সঙ্গে কাজ করবেন বলে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ছবিটি ছিল ‘তেরে নাম’। কিন্তু কোনো কারণে ‘তেরে নাম’ ছবির কাজ শুরু হতে দেরি হয়। অনুরাগ কশ্যপ সেই ছবির চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্বে ছিলেন। রামগোপালের কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সেই সুযোগ নেন সতীশ কৌশিক। ছবির স্বত্ব কিনে ফেলেন তিনি। সঞ্জয়ের পরিবর্তে সালমানকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন।

‘তেরে নাম’ ছবিটি বক্স অফিসে দারুণ সাড়া ফেলে। সালমানের বদলে যদি এই ছবিতে সঞ্জয় অভিনয় করতেন তাহলে সঞ্জয়ের ক্যারিয়ারে একটি মাইলফলক তৈরি হতে পারত। অভিনয় নিয়ে এগোলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই ভেবে নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা গড়ে তোলেন সঞ্জয়।

সঞ্জয় চেয়েছিলেন, তার প্রযোজিত ছবিতে অনিল অভিনয় করুক। অনিল তার প্রস্তাবে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু অভিনেতার শর্ত ছিল, অনিলের পছন্দমতো পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে হবে। ভাইয়ের কথা মতো সেই পরিচালককেও রাজি করান সঞ্জয়। কিন্তু চার বছর ধরে অনিল ফেরাতে থাকেন সঞ্জয়কে। সেই সময় সালমানের সঙ্গে ‘যুবরাজ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অনিল। অনিলের এমন আচরণ পছন্দ হয়নি তার। তাই তিনি নিজের ছবি নিয়ে আলোচনা করতে অনিলের কাছে আর যাননি।

২০০৩ সালে টেলিভিশন জগতে পা রাখেন সঞ্জয়। অভিনেত্রী কারিশমা কাপুরের সঙ্গে ‘করিশমা : দ্য মিরাকলস অব ডেস্টিনি’ ধারাবাহিকে প্রথম অভিনয় করেন তিনি। ২০১৫ সালে ‘তেভর’ ছবির প্রযোজনা করেন সঞ্জয়। এই ছবিতে অভিনেতা হিসেবে আর অনিলকে নয়, নিজের পরিবারের অন্য সদস্য অর্জুন কাপুরকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কারণ নিজের পরিবারের সবাই তাকে মানসিক আঘাত দিলেও অর্জুন তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।

পরে অবশ্য প্রযোজনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন সঞ্জয়। ‘শানদার’, ‘মিশন মঙ্গল’, ‘দ্য জোয়া ফ্যাক্টর’ ছাড়াও বিভিন্ন হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ‘ফ্যাশন স্ট্রিট’, ‘দিল সামাল যা জারা’র মতো ছোট পর্দার ধারাবাহিক এবং ‘লাস্ট স্টোরিজ’, ‘দ্য লাস্ট আওয়ার’, ‘দ্য ফেম গেম’ প্রভৃতি ওয়েব সিরিজেও অভিনয় করতে দেখা গেছে তাকে।

প্রযোজক হিসেবে বনি কাপুর এবং অভিনেতা হিসেবে অনিল কাপুর বলিউডে যে সাফল্য পেয়েছেন সে তুলনায় তাদের ভাই সঞ্জয় নিজের ক্যারিয়ারে অভিনয় বা প্রযোজনার কোনো কিছু নিয়ে এগোতে পারেননি। বর্তমানে টুকটাক অভিনয় করে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।

/এসএসএইচ/