কবীর সুমনের গানেই গল্পটা শুরু করা যাক; ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়’। শিল্প জগতের কোনো ব্যক্তিকে সব্যসাচী বলার জন্য কতখানি বৈচিত্র্যময় হতে হয়? কতটা বিস্তৃত পরিসরে নিজেকে মেলে ধরতে হয়? এর নির্দিষ্ট মাপকাঠি হয়ত নেই।

কিন্তু যিনি টিভি পর্দায় ফুটিয়েছেন হাসির ফোয়ারা, সিনেমায় দেখিয়েছেন হিংস্রতার অনন্য রূপ, আবার নির্মাণেও দেখিয়েছেন আলাদা নৈপুণ্য। তাকে তো সব্যসাচী বলাই যায়। শিল্প-সংস্কৃতির প্রায় সব শাখাতেই উজ্জ্বল দ্যুতি ছড়ানো সেই মানুষটির নাম আবু তাহের মোহাম্মদ শামসুজ্জামান। না, এ নামে অবশ্য খুব কম মানুষই তাকে চেনেন। তিনি পরিচিত, জনপ্রিয় এটিএম শামসুজ্জামান নামে।

কেবল অভিনয় কিংবা নির্মাণেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না এটিএম শামসুজ্জামান। তার পরিচয়ের বিরাট জায়গা দখল করে আছে লেখালেখি। শতাধিক সিনেমার কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। এর মধ্যে রয়েছে বহু নন্দিত ও সফল সিনেমা।

অভিনয়ের আকাশে ধ্রুবতারার মতো উজ্বল এই কিংবদন্তি চলে গেছেন গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি। দেখতে দেখতে আজ এক বছর হয়ে গেল। বিশেষ দিনটিতে তাই এটিএম সবার মনে উঁকি দিচ্ছেন তার চিরচেনা হাসিমাখা মুখেই।

দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে অভিনয়ে মিশে থাকা এটিএম শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীতে। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৬১ সালে উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে রূপালি জগতে পা গলান তিনি।

‘নয়া জিন্দেগানি’ নামের একটি সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন এটিএম শামসুজ্জামান। তবে সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। তাকে প্রথম পর্দায় দেখা যায় ১৯৬৮ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘এতটুকু আশা’ সিনেমায়। তবে চরিত্রটি ছিল একজন খবরের কাগজ বিক্রেতার।

সিনেমার পর্দায় এটিএম শামসুজ্জামান বিখ্যাত হয়ে আছেন খলনায়ক হিসেবে। এই রূপে তার আবির্ভাব হয়েছিল ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ সিনেমার মাধ্যমে। এরপরের ইতিহাসটা সিনেমাপ্রেমী সবার কম-বেশি জানা।

অভিনেতা হিসেবে প্রায় সবকিছুই অর্জন করেছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। কিন্তু তারকা খ্যাতি তার সুন্দর-শিশু মনটিকে কখনোই কঠিন করেনি। তিনি সর্বদা হাসিখুশি উদার মানসিকতার ছিলেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা সামনে চলে আসে।

একদা সিনেমার শুটিং করতে ঢাকায় এসেছিলেন কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা শুভাশিস মুখার্জি। ওই সময় এটিএমের সঙ্গে দেখা হয় তার। তিনি শুভাশিসের কাছে জানতে চান, ঢাকার কোথাও যেতে চান কিনা। তাহলে তিনি নিয়ে যাবেন।

২০১৯ সালে ঢাকার এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে শুভাশিস বলেন, ‘আমি ওনাকে বললাম- আড়ংয়ের শোরুমে যেতে চাই। শুনেছি সেখানে খুব সুন্দর সুন্দর পাঞ্জাবী পাওয়া যায়। ওইখানে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন গাড়িতে করে। উনি দোকানে ঢুকেছেন, সবাই ওনাকে খাতির করছে। তো একটা পাঞ্জাবী দেখে আমি একটু দাঁড়িয়ে গেছি। পাঞ্জাবির কাপড়টা দেখছি হাত বুলিয়ে। উনি তখন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও গেলাম। যাওয়ার পর কাউন্টারের লোককে কিছু একটা দিতে বললেন। তারা একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। উনি সেটা নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার। পাঞ্জাবীটা তোমার পছন্দ হইছিল না? তাই এটা আমার কলকাতার মেহমানের জন্য’।

মজার ব্যাপার হলো, ২০১৯ সালের সেই আয়োজনে এটিএম শামসুজ্জামানের দেওয়া পাঞ্জাবিটা পরেই অংশ নিয়েছিলেন শুভাসিস। ভিনদেশের এক শিল্পীর প্রতি এটিমের এমন উদারতার ঘটনা মুগ্ধ করেছিল সবাইকে। সুতরাং দেশের শিল্পীদের কাছে তিনি কতখানি আশ্রয়ের জায়গা ছিলেন, তা তো সহজেই অনুমেয়।

বর্ণাঢ্য সিনে জীবনে এটিএম শামসুজ্জামান ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ আয়োজনে তাকে আজীবন সম্মাননাও প্রদান করা হয়েছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।

কেআই