বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বলা যেতে পারে, মহাসচিবের ভূমিকা খুব বেশি মুখ্য নয়। এটা মূলত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া একটা দল। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে যে সিদ্ধান্ত আসে সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে মহাসচিবের...

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির মহাসচিব। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঠাকুরগাঁও- ১ আসন থেকে বিএনপির মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে কৃষি মন্ত্রণালয়, পরবর্তীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলটির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ অবস্থায় দলের হাল শক্ত হাতে ধরেছিলেন একসময় অর্থনীতির এ অধ্যাপক। রাজপথে সক্রিয় উপস্থিতি তেমন দেখা না গেলেও ঘরোয়া অথবা ভার্চুয়াল মিটিং-সমাবেশে ছিল তার সরব উপস্থিতি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত এ রাজনীতিক সম্প্রতি মুখোমুখি হন ঢাকা পোস্টের। বলেন, ‘দলের মহাসচিব হিসেবে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা সফলভাবে পালন করতে সক্ষম হচ্ছি। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলে মহাসচিবের ভূমিকা খুব একটা মুখ্য নয়। দলের স্থায়ী কমিটিতে চেয়ারপারসনের নির্দেশিত যে সিদ্ধান্ত আসে সেটা বাস্তবায়ন করাই মহাসচিবের কাজ।’ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদিত্য রিমন

ঢাকা পোস্ট : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এখন কেমন? আপনাদের দাবি অনুযায়ী ‘গৃহবন্দি খালেদা জিয়া’র মুক্তির আন্দোলনের বিষয়ে অথবা আইনি প্রক্রিয়ায় তাকে মুক্ত করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি-না?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : সরকারের যে অর্ডার সেখানে লেখা আছে, তার সাজা স্থগিত করা হয়েছে। প্রথমে ছয় মাস, এরপর আবার ছয় মাস। শর্ত দিয়েছে যে, তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। যদি চিকিৎসার জন্য কোনো হাসপাতালে যেতে হয় তাকে দেশের সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। এতে বোঝা যায় যে, এটা কোনো মুক্তি নয়, শুধু সাজা স্থগিত মাত্র। এটা তো গৃহবন্দি অবস্থা, কারণ তিনি তো বাইরে যেতে পারছেন না।

আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে যে, তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা খুব ইন্টারেস্টিং পিকচার যে, আমরাই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে পারি। মূলত, সন্ত্রাস তারাই তৈরি করে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। তার আগের যে শারীরিক সমস্যাগুলো ছিল, এখনও সেগুলো আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তার যে অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট (উন্নত চিকিৎসা) দরকার, সেটা বিদেশে সম্ভব। বাংলাদেশে নয়। সরকারের বিধিনিষেধের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজপথের আন্দোলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম | ফাইল ছবি

তার (খালেদা জিয়া) মুক্তির জন্য গত কয়েক বছর ধরে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু দেশে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো পরিবেশ নেই। গণতন্ত্র নেই। ফলে আমাদের মতো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের পক্ষে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করা বেশ কঠিন। তারপরও আমরা প্রথমদিকে আন্দোলন করেছি এবং তা অব্যাহত রেখেছি। করোনার কারণে আমাদের আন্দোলনটা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কারণে কোনোকিছু করা সম্ভব ছিল না। তবে আমরা অবশ্যই তার (খালেদা জিয়া) মুক্তির জন্য কাজ করছি। 

ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিন বিএনপির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। মহাসচিব হিসেবে নিজেকে কতটুকু সফল মনে করছেন? 
 
মির্জা ফখরুল ইসলাম : বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বলা যেতে পারে, মহাসচিবের ভূমিকা খুব বেশি মুখ্য নয়। এটা মূলত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী চেয়ারপারসনের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া একটা দল। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চেয়ারম্যানের নির্দেশে যে সিদ্ধান্ত আসে সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব হচ্ছে মহাসচিবের। আমি মনে করি, সেই কাজ এখন পর্যন্ত মোটামুটি সুস্থভাবে পালন করতে পেরেছি। আমি মহাসচিব বা কোনো পদে থাকার জন্য রাজনীতি করি না। রাজনীতি করি সামগ্রিকভাবে একটা রাজনৈতিক আদর্শ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। সেভাবেই আমি জিনিসগুলো দেখি। আমার কাজ, লক্ষ্য সেভাবে স্থির করি।

আওয়ামী লীগ কেন ফ্যাসিস্ট হয়েছে? তারা দেখেছে যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এ কারণে পুরোপুরি নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে এটাকে (ফ্যাসিবাদ) নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে তারা একটা সুবিধা গ্রহণ করেছে, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, বাংলাদেশে কিছু সন্ত্রাসবাদ তৈরি করে, সেটাকে দমন করে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

যখন থেকে আমাকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন থেকে যথাসম্ভব দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। আমি ম্যাডাম (খালেদা জিয়ার) অনুপস্থিতিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে সক্ষম হয়েছি। ম্যাডামের পরামর্শ নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে স্থায়ী কমিটির সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী রাজনৈতিক দলগুলোকে এক করে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছি। পাশাপাশি ২০ দলীয় জোটকেও সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত সফলভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পেরেছি। এটা তো আমার মহাসচিবের সময়েই হয়েছে। সুতরাং আমি মনে করব, আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা সফলভাবে পালন করতে সক্ষম হয়েছি। পরবর্তীতে দল যখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছে এবং আমার বিরুদ্ধে প্রায় শতাধিক মামলা, সেই অবস্থায় দল যে এখন ঐক্যবদ্ধ আছে, সেখানে আমার তো একটা ভূমিকা আছে। সেই ভূমিকা আমি পালন করছি।

ঢাকা পোস্টকে একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

দলের ঐক্য অটুট রেখে সঠিকভাবে যেন দায়িত্ব পালন করতে পারি, রাজনীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করেতে পারি, খালেদা জিয়াকে যেন মুক্ত করতে পারি, গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আমাদের নেতা তারেক রহমানকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনতে পারি, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সুতরাং আমি মনে করি, আমাদের যে দায়িত্ব তা যথাযথভাবে পালন করছি।
 
ঢাকা পোস্ট : বারবার একটা আওয়াজ ওঠে, বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে রাজপথে আন্দোলন করতে পারছে না বা সফল হচ্ছে না। আবার অনেক নেতা দল থেকেও পদত্যাগ করেছেন। আপনি বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন? 
 
মির্জা ফখরুল ইসলাম : বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত মজবুত। আমাদের দল থেকে দু-একজন স্বাস্থ্যগত কারণে বেরিয়ে গেছেন। খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতা দল ছাড়েননি। দলের প্রতিটি ইউনিট অত্যন্ত সুসংহত। নতুন করে আমরা সংগঠনকে পুনর্গঠন করছি। যদিও দেশনেত্রী এখনও বলা যেতে পারে যে গৃহবন্দি, সেই কারণে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতৃত্বে আছেন। আমাদের যে স্থায়ী কমিটি আছে, কমিটির যৌথ নেতৃত্বে সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে।

ঢাকা পোস্ট : মাঝেমধ্যে খবর আসে আপনার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে কী বলবেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আপনাদের দুর্ভাগ্য, যে সময়টাতে পত্রিকায় কাজ ও সাংবাদিকতা করছেন, সেই সময়টা স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য অত্যন্ত দুঃসময়। বাংলাদেশ এখন গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই। পুরো গণমাধ্যমকে সরকার তার স্বার্থে এবং একদলীয় শাসন ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করতে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যে মিডিয়া বাধ্য হচ্ছে সত্য ঘটনাগুলো প্রকাশ না করতে এবং সরকারের ফরমায়েশি কিছু নিউজ করতে।

যে ভারতের সঙ্গে তাদের এত ভালো সম্পর্ক, সেই ভারতই সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। চীনের সঙ্গে এত ভালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সেখানে চীনও বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তারা মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। রাশিয়া, জাপানও মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। তাহলে আমাদের সরকারের অবস্থানটা কোথায়

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

তারেক রহমানের সঙ্গে আমার কোনো রকম দ্বন্দ্ব তো নেই বরং আমরা, পুরো স্থায়ী কমিটি অত্যন্ত সুন্দর ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি। খালেদা জিয়া দুই বছরের মতো কারাগারে বন্দি ছিলেন। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ দুই বছরে আমরা বহু কাজ করেছি। একটা জাতীয় নির্বাচন করেছি, সেখানেও কিন্তু আমাদের বড় ধরনের কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।

বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

 একটা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছি, সেটা সম্পূর্ণ নতুন করে করেছি। এদিকে ২০ দলীয় জোট অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট। রাজনৈতিক আদর্শ অনুযায়ী দুই জোট দুই মেরুর। এ দুই মেরুকে সঙ্গে নিয়ে আসন সমঝোতা করে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করেছি। নির্বাচনের ফল কিন্তু সরকার ভোট ডাকাতি করে আগের রাতেই নিয়ে গেছে। এটা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু আমাদের যে ঐক্য, সেটাতে কোনো সমস্যা হয়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : আপনি এখন বলছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগের রাতে সরকার ভোট ডাকাতি করে ফল নিয়ে গেছে। কিন্তু আপনি তো ভোটের দিন অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সকালে ঠাকুরগাঁওয়ে বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। আপনার ওই বক্তব্য নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অনেক সদস্যও প্রশ্ন তুলেছিলেন। আসলে বিষয়টা কী ছিল?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : নো-নো (না-না), কথাটা আপনারা সম্পূর্ণভাবে বিকৃত করছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদেরই একটি টেলিভিশন কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে একটা মাত্র কথাকে কোট (উদ্ধৃতি) করে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছিল। ভোটের দিন সকালে আমার বাড়ির পাশের একটি ভোটকেন্দ্রে যখন গিয়েছিলাম তখন সেখানে ভালো ভোট হয়েছিল। সেটা তারা বিকৃত করে প্রচার করেছিল। সেদিন আমি কী বলেছি তা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। আমি বলেছি, ‘গত রাতে এখানে অনেকগুলো কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি হয়েছে। পরবর্তীতে অন্যান্য কেন্দ্রে আমি যাচ্ছি (সেটা সকাল ৮টায়), গেলে বুঝতে পারব।’ তারপর সকাল ১০টায় আবার আমি বক্তব্য দিয়েছি। বলেছি, ‘প্রত্যেকটি কেন্দ্রে ভোট ডাকাতি শুরু হয়ে গেছে, ভোট ভালো হচ্ছে না।’ এটাকে সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে প্রত্যেকটি মিডিয়াতে। যেটা খুবই দুঃখজনক। পরবর্তীতে আমার মূল বক্তব্য কী ছিল, সেটা আমি সব মিডিয়াতে দিয়ে দিয়েছি।

আমার মনে হয়, রাজনীতিবিদরা সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। রাজনীতিবিদদের স্থান দখল করে নিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা অনেকাংশে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

ঢাকা পোস্ট : মিডিয়াতে এসেছে, গত ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন আহম্মেদকে মনোনয়ন দিতে বলেছিলেন খালেদা জিয়া, কিন্তু তারেক রহমান দিয়েছিলেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে। এ আসনের মনোনয়ন দেওয়া নিয়ে গুলশান বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ওই দুই নেতার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং আপনার বাড়িতে হামলাও হয়। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, মা-ছেলের মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে কি-না? 

মির্জা ফখরুল ইসলাম : এটা সঠিক নয়। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর হামলা, সেটা তো হতেই পারে। একটা বড় দলে অনেকে বিক্ষুব্ধ থাকতে পারেন। দলের মনোনয়নে তারা একমত নাও হতে পারেন। পরে বিচ্যুত কিছু লোক এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। এটা প্রায়ই হয়, এ ধরনের ঘটনা আমাদের গত জাতীয় নির্বাচনেও হয়েছে। এর আগে আমাদের পার্টি অফিসে ছাত্রদল ও অন্যরা সমস্যা তৈরি করেছিল। এটা আওয়ামী লীগেও হয়েছে। বড় দলে এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এটা কোনো ইস্যু নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

আর মায়ের সঙ্গে ছেলের যে দূরত্বের কথা শোনা যাচ্ছে, এটা একেবারেই ভুয়া কথা। এর কোনো সত্যতা নাই। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের দূরত্ব নেই। অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক আছে তাদের মধ্যে।

ঢাকা পোস্ট : আপনি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতিও ছিলেন। সে সময়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির পার্থক্য কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : তখনকার ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে এখনকার রাজনীতির আকাশ-পাতাল তফাত। তখন মেধাবীরা ছাত্র রাজনীতি করত। যারা বোর্ডে প্রথম, দ্বিতীয় হতো, তারাই ছাত্র রাজনীতিতে আসত। তখনকার ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন— সবখানেই নেতৃত্বে ছিল মেধাবীদের। ফলশ্রুতিতে ছাত্র রাজনীতি নেতৃত্ব দিয়েছে জাতীয় রাজনীতিতে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে শুধুমাত্র ছাত্রদের ১১ দফার যে আন্দোলন ছিল, তার কারণেই। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, ওই আন্দোলন সফল হয়েছিল ছাত্রদের নেতৃত্বের কারণে। আমি দু-একটা উদাহরণ দিতে পারি। তখন মিজানুর রহমান শেলী ছিলেন এনএসএফ’র সভাপতি। পরবর্তীতে তিনি ডাকসাইটের একজন আমলা ও মন্ত্রী হন। আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, তিনি সলিমুল্লাহ হলের এনএসএফ’র সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বোর্ড পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছিলেন। কাজী জাফর আহমেদ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, তিনি ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। প্রফেসর মাহবুল্লাহ, তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, তিনি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মনোনয়ন নিয়ে ডাকসু’র এজিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। ড. জিসান হোসেইন, তিনি বিশ্ব ব্যাংকের একজন বড় অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ছাত্র ইউনিয়ন থেকে এসএম হলের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে। ছাত্রলীগেও তখন অনেক মেধাবী ছিলেন। এটা ছিল তখনকার ছাত্র রাজনীতির পরিবেশ।

খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ। তার আগের যে শারীরিক সমস্যাগুলো ছিল, এখনও সেগুলো আছে, কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও খারাপ হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী তার যে অ্যাডভান্সড ট্রিটমেন্ট (উন্নত চিকিৎসা) দরকার, সেটা বিদেশে সম্ভব। বাংলাদেশে নয়। সরকারের বিধিনিষেধের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

এখন ছাত্র রাজনীতিতে কারা আছেন, তাদের একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেন, কী ধরনের আন্দোলন তারা করছেন? দেশে যে এখন গণতন্ত্র নাই, তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো আন্দোলন হয় না। সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর বিষয় হলো, ছাত্রসংসদের কোনো নির্বাচন হয় না বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে। নির্বাচন না হওয়ার কারণে ছাত্র রাজনীতি থেকে ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে না।

ঢাকা পোস্ট : বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে প্রায় দুই বছর হতে চলল। সম্মেলন নিয়ে আপনাদের কোনো চিন্তা আছে কি-না?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : সম্মেলনের মেয়াদ শেষ হয়নি, আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির যে মেয়াদ আছে, সেটা শেষ হয়ে গেছে। এটা উত্তীর্ণ হতে পারে। দেশে কোভিড-১৯ এবং গণতন্ত্রের যে অবস্থা তাতে সময়মতো সম্মেলন নাও হতে পারে। এছাড়া বিএনপি যে ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, খালেদা জিয়া কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বাইরে, সেখানে সম্মেলন করা আমাদের জন্য কঠিন ও কষ্টসাধ্য। আগামীতে কখন সম্মেলন হবে, সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

রাজপথের আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

ঢাকা পোস্ট : ২০১৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে সেই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। এখন আবার বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। তাহলে সামনের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি কী করবে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। ২০১৪ সালে আমরা নির্বাচন বর্জন করেছিলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থার কারণে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি নির্বাচন হয়েছিল তা অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছিল। ভোটাররা নিরাপদে এসে ভোট দিয়েছেন। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে খুব ভালো করে জানি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনও সুষ্ঠু হয় না। সেজন্য ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। ২০১৮ সালে আমরা মনে করেছি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা দরকার, তাই অংশ নিয়েছিলাম। তখন দেশের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সরকার নির্যাতন-নিপীড়ন করে গণতান্ত্রিক পরিবেশ একেবারে সংকুচিত করে ফেলেছিল, সেখানে নির্বাচনকে আমরা একটা হাতিয়ার হিসেবে নিতে চেয়েছিলাম। একদিকে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা, অন্যদিকে নেতাকর্মীদের মুক্ত ও মামলা প্রত্যাহার করা। এমন উদ্দেশ্য নিয়েই একাদশ সংসদ নির্বাচনে গিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে আমরা জাতীয় নির্বাচনে যাব কি যাব না, এটা নির্ভর করবে তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তার ওপর। তবে, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সরকারের অধীনে জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। তারা ভোট ডাকাতি করে নিয়ে যাচ্ছে।

গণতন্ত্রের লড়াই এত সহজ নয়। বিএনপির ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, এক লাখের ওপর মামলা, আমাদের স্থায়ী কমিটির নেতা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কেউ বাকি নেই, যাদের নামে ১০টা থেকে শুরু করে ২০০টা পর্যন্ত মামলা আছে। যেখানে আমাদের ৫০০ ওপরে নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছেন। বিএনপির এমপিরা পর্যন্ত গুম হয়েছেন। হাজারের ওপরে নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

ঢাকা পোস্ট : বিএনপির তৃণমূলের পর দলের স্থায়ী কমিটিতেও জামায়াত ছাড়ার প্রসঙ্গ এসেছে। বিএনপি কি ২০-দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে ছেড়ে দেবে?
 
মির্জা ফখরুল ইসলাম : এখন পর্যন্ত আমাদের ২০-দলীয় জোট অক্ষুণ্ণ আছে। সেখানে যতক্ষণ পর্যন্ত ভিন্ন কিছু না শুনছেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা (জামায়াত) আছে। সুতরাং আমার মনে হয়, এ বিষয়ে খুব বেশি অনুমান করার সুযোগ নেই।

ঢাকা পোস্ট : তারেক রহমানের সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দূরত্বের কথা শোনা যায়। তারেক রহমানের সঙ্গে দূরত্বের কারণেই নাকি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। যদিও আপনারা তার পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করছেন না…  

মির্জা ফখরুল ইসলাম : এমন প্রশ্ন থেকে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মিডিয়ার কি দায়িত্ব হচ্ছে একমাত্র বড় বিরোধী দল বিএনপিকে আক্রমণ করা? তাদের (বিএনপি) ভুলত্রুটিগুলো জনগণের মাঝে তুলে ধরে তাদের আরও দুর্বলের চেষ্টা করা। এমন ধারণা জন্মেছে কারণ, আপনারা তো আওয়ামী লীগকে এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ করেন না। তারা কেন দেশের এ অবস্থা করছে, দেশকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে? এগুলো নিয়ে আমরা মিডিয়াতে খুব বেশি প্রশ্ন দেখতে পাই না। 

আমরা দেখতে পাই, বিএনপি’র সম্পর্কেই লিখছে সবাই। এর কারণ হচ্ছে, মিডিয়া অভ্যস্ত হয়ে গেছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থাতে, একটা স্বৈরাচারী ও কর্তৃত্ববাদী সরকার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার কারণে। তাই আমরা মিডিয়াকে কোনো দোষ দেই না। আমাদের দলে কোনো সমস্যা নেই। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের সুন্দর সম্পর্ক বিরাজমান।

ঢাকা পোস্ট : বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিএনপির বারবার পরাজয় হচ্ছে। এ কারণে বিএনপির আন্দোলনে সফলতা আসে না। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
 
মির্জা ফখরুল ইসলাম : আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল বলে ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে সফল আন্দোলন সবসময় হয় না। ক্ষমতায় আসতে নেলসন ম্যান্ডেলাকে ২৭ বছর জেলে কাটাতে হয়েছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও অং সান সু চিকে ১১ বছর গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। তারপরও সু চি আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করে একটা নির্বাচনে আসতে পেরেছে। কথাগুলো আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমরা যারা কাগজে লিখি, রাজনীতি করি, যারা গণতন্ত্রের চর্চা করতে চাই, আমাদের সবাইকে জানতে হবে যে, এটা খুবই কঠিন একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছ থেকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনা।

ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
মিডিয়ার কি দায়িত্ব হচ্ছে একমাত্র বড় বিরোধী দল বিএনপিকে আক্রমণ করা? তাদের (বিএনপি) ভুলত্রুটিগুলো জনগণের মাঝে তুলে ধরে তাদের আরও দুর্বলের চেষ্টা করা। এমন ধারণা জন্মেছে কারণ, আপনারা তো আওয়ামী লীগকে এ ধরনের প্রশ্নবিদ্ধ করেন না

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

গণতন্ত্রের লড়াই এত সহজ নয়। বিএনপির ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, এক লাখের ওপর মামলা, আমাদের স্থায়ী কমিটির নেতা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কেউ বাকি নেই, যাদের নামে ১০টা থেকে শুরু করে ২০০টা পর্যন্ত মামলা আছে। যেখানে আমাদের পাঁচশ’র ওপরে নেতাকর্মী গুম হয়ে গেছেন। বিএনপির এমপিরা পর্যন্ত গুম হয়েছেন। হাজারের ওপরে নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। থানায় নিয়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। 

বাড়ি-ঘরে আক্রমণ হচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেই জায়গায় আমরা এখন পর্যন্ত টিকে আছি, আন্দোলন করছি এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছি, এটাই তো আপনাদের দেখা উচিত বেশি করে। এটাই মানুষের সামনে আরও বেশি করে তুলে ধরা উচিত যে, বিএনপি এ কঠিনতম সময়ের মধ্যেও, যে সময়টা আওয়ামী লীগ কখনও ফেইস করেনি, যেটা আমরা করছি; তারপরও উই আর ফাইটিং অ্যান্ড উই আর ইউনাইটেড (আমরা লড়াই করছি এবং আমরা একতাবদ্ধ)।

ঢাকা পোস্ট : বিশ্ব রাজনীতিতে চলছে পরিবর্তনের হওয়া। বাংলাদেশে এর কতটুকু প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : ২০ বছর আগের বিশ্ব রাজনীতির যে ধারা, সেটা আজ পরিবর্তিত হয়েছে। ৫০ বছর আগে, বিশেষ করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অন্য একটি ধারা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর আরেকটি ধারা আসে। অর্থাৎ বিশ্ব রাজনীতির ধারা ক্রমেই বিবর্তন হচ্ছে। পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নিজস্ব মেরুকরণের কারণে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে।

ভবিষ্যতে আমরা জাতীয় নির্বাচনে যাব কি যাব না, এটা নির্ভর করবে তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। একই সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে আমরা কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছি তার ওপর। তবে, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সরকারের অধীনে জাতীয় কিংবা স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে না। তারা ভোট ডাকাতি করে নিয়ে যাচ্ছে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

৫০ বছর পর চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। ভারতবর্ষে নেতৃত্বে এসেছে ধর্মাশ্রয়ী একটি দল। যেখানে ধর্মীয় উগ্রবাদ প্রচার হচ্ছে। এর আগে কংগ্রেস যখন ছিল তখন কিন্তু মোটামুটি মধ্যপন্থী একটি রাজনীতির চর্চা ছিল ভারতবর্ষে। গণতন্ত্রের চর্চাও সেভাবে ছিল। 

পাকিস্তানে সামরিক শাসনের পরও সেখানে কিন্তু একটা পরিবর্তনের ধারা এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে একসময় সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূরত্ব ছিল, সেখানেও আজ তাদের মধ্যে সখ্যতা তৈরি হয়েছে। মূলত, বিশ্বের ধনতান্ত্রিক দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনে রাজনৈতিক ধরনগুলো বদলে দিয়েছে। এখন আমার মনে হয়, রাজনীতিবিদরা সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। রাজনীতিবিদদের স্থান দখল করে নিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থা অনেকাংশে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ছিল, তখন পশ্চিমা বিশ্বে বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের লড়াই ছিল ধনতন্ত্রের। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে সেটা শিফট করেছে। এখন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মুখ্য বিষয় হলো যুদ্ধ, সেটা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। তারা মূলত মুসলিম দেশগুলোকে টার্গেট করে নীতি প্রণয়ন করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান মিত্র ছিল সমাজতন্ত্র। ১৯৭৫ সালে তারা একদলীয় বাকশাল করেছিল। তাদের প্রয়োজনে, তাদের স্বার্থে তারা সমাজতন্ত্র বাদ দিয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি তাদের কাছে এসেছে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রও আসছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জিয়াউর রহমানই একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। একজন আর্মি অফিসার বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছেন।

মায়ের সঙ্গে ছেলের যে দূরত্বের কথা শোনা যাচ্ছে, এটা একেবারেই ভুয়া কথা। এর কোনো সত্যতা নাই। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের দূরত্ব নেই। অত্যন্ত সুসম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক আছে তাদের মধ্যে

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

অপরদিকে, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া সংসদীয় সরকার চালু করেন। বিএনপির হাত ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো এসেছে। স্বাধীন গণমাধ্যম বিএনপির হাত ধরে এসেছে। এখন আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী সরকারে ফিরে গেছে পুরোপুরি। আওয়ামী লীগ কেন ফ্যাসিস্ট হয়েছে? তারা দেখেছে যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সে ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এ কারণে পুরোপুরি নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে এটাকে (ফ্যাসিবাদ) নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে তারা একটা সুবিধা গ্রহণ করেছে, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, বাংলাদেশে কিছু সন্ত্রাসবাদ তৈরি করে, সেটাকে দমন করে। 

আওয়ামী লীগ সরকার বিশ্বকে দেখাতে চাচ্ছে যে, তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটা খুব ইন্টারেস্টিং পিকচার (আকর্ষণপূর্ণ ছবি) যে, আমরাই সন্ত্রাসবাদ দমন করতে পারি। মূলত, সন্ত্রাস তারাই তৈরি করে। কিছুদিন আগেও রাজধানীতে ১৫টি বাস পুড়ানো হলো, বিএনপির তো মাথা খারাপ হয়ে যায়নি যে, এ সময়ে বাস পুড়াতে যাবে। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করে বাংলাদেশের ভেতরে, সেগুলো নিয়ে তারা বিরোধী দলকেই দায়ী করে এবং তাদের ওপর চড়াও হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর 

বাংলাদেশে কিন্তু ৯৫ শতাংশ মুসলিম, ফলে এখানে একটা চাপ আছে। আওয়ামী লীগ সেটার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন নির্বাচিত হয়েছেন, আজ সারাবিশ্ব আশাবাদী হয়ে উঠেছে যে, গণতন্ত্রের হয়তো একটা চর্চা হবে। কারণ, যেহেতু ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই জায়গা থেকে পিছু হটবেন বাইডেন। কিন্তু মূল জায়গায় কি পরিবর্তন আসবে?

তারেক রহমানের সঙ্গে আমার কোনো রকম দ্বন্দ্ব তো নেই বরং আমরা, পুরো স্থায়ী কমিটি অত্যন্ত সুন্দর ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছি। খালেদা জিয়া দুই বছরের মতো কারাগারে বন্দি ছিলেন। এর মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) যে অর্থনৈতিক স্বার্থ, সেটা কি খুব বদলাবে? অর্থনীতির স্বার্থে তাদেরও অস্ত্র বিক্রি করতে হবে। তাদের মার্কেট দরকার। সেক্ষেত্রে তারা ভূরাজনীতিতে কতটুকু পরিবর্তন আনবে, সেটা এখন দেখার বিষয়। ভবিষ্যতে সবকিছু পরিষ্কার হবে।

ঢাকা পোস্ট : রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের দাবি, তারা সফল। কিন্তু এখন পর্যন্ত  কোনো রোহিঙ্গাকে আমরা মিয়ানমারে স্থানান্তরিত করতে পরিনি। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এ সরকার কিছুটা নয়, পুরোপুরি ব্যর্থ। যে ভারতের সঙ্গে তাদের এত ভালো সম্পর্ক, সেই ভারতই সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। চীনের সঙ্গে এত ভালো অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সেখানে চীনও বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তারা মিয়ানমারকে সমর্থন করছে। রাশিয়া, জাপানও মিয়ানমারকে সমর্থন দিচ্ছে। তাহলে আমাদের সরকারের অবস্থানটা কোথায়? 

আসলে আমি মনে করি, বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে, সেটাকে সঙ্গে নিয়েই জনগণ ও দেশের স্বাধীনতার স্বার্থ বড় করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এটাই হচ্ছে বড় কাজ। 

ঢাকা পোস্ট : আপনিই বলেছেন, মেধাবী তরুণরা একসময় রাজনীতি করতেন। এখন তারা রাজনীতিবিমুখ। মেধাবী তরুণ যারা রাজনীতি করতে চান, তাদের ক্ষেত্রে আপনার উপদেশ কী হবে?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : আজ যেসব তরুণ রাজনীতি করছেন বা করতে ইচ্ছুক, তাদের সবার আগে নিজ দেশ সম্পর্কে জানতে হবে। দেশের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। এটা না জানলে সঠিক রাজনীতি করা সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে অর্থনীতিটাকেও জানতে হবে। বিশ্ব রাজনীতি কীভাবে চলছে এখন, সেটা জানাও খুব জরুরি। তাদের বেশি বেশি করে পড়তে হবে। বিশেষ করে রাজনীতি ও অর্থনীতির বইগুলো।

ঢাকা পোস্ট : ছাত্রজীবনে আপনি মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এখন সময় পেলে কী করেন?

মির্জা ফখরুল ইসলাম : যখনই সময় পাই বই পড়ি, গান শুনি। রাতে ভালো সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। এখন তো আর নাটক করার বয়স নেই, তাই এটা সম্ভব হয় না। যখন বয়স ছিল তখন অনেক নাটক করেছি। অনেক খেলাধুলাও করেছি। মাঠেই ছিলাম সবসময়। যৌবনে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া অঙ্গনে আমার একটা পদচারণা ছিল। রাজনীতির মাঠে এসে এখন এগুলো আর সম্ভব হয় না। তবে সেই সময়ের মনটাকে ধরে রাখার চেষ্টা থাকে সবসময়।

এএইচআর/এমএআর