জাহাজীকরণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আইসিডিতে জমা পড়েছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই ১০৯টি কনটেইনার / ছবি- সংগৃহীত

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর চারটি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে (আইসিডি) পড়ে আছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই ১০৯টি কনটেইনার। বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, কিছু জাহাজ হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার নিচ্ছে না, আবার কিছু কারখানায় এগুলো ফেরত চলে যাবে। এই কারণে ডিপোতে ১০৯টি কনটেইনার পড়ে আছে।

এদিকে, সিঙ্গাপুর তার বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া বড় বড় শিপিং লাইনগুলোর জাহাজ আপাতত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার পরিবহন করছে না বলে ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।

গত ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বলা হচ্ছে, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকা কনটেইনারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ৪৮ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হন।

সিঙ্গাপুর তার বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়া বড় বড় শিপিং লাইনগুলোর জাহাজ আপাতত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার পরিবহন করছে না

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড কোনো দাহ্য পদার্থ নয়। তবে এটি আগুনের তীব্রতা বাড়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। আগুন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডভর্তি জেরি ক্যানগুলোর সংস্পর্শে আসায় সেখানে একাধিক বিস্ফোরণ ঘটে, যা আগুনের তীব্রতা বাড়িয়ে তোলে। ফলাফল, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তিন দিন সময় লেগে যায়। ৪৮ জনের প্রাণহানি হয়।

সীতাকুণ্ডের ঘটনার পর সিঙ্গাপুর তার বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে / ছবি- সংগৃহীত  

ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর মেইনলাইন শিপিং কোম্পানিগুলো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার বহনে অনিচ্ছা দেখায়। ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের চারটি বেসরকারি আইসিডিতে জমা পড়েছে ১০৯টি হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার। বন্ডেড এরিয়া হওয়ায় বিপুল এই রাসায়নিক সরাতে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিক সমিতির (বিকডা) মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে পড়ে থাকা ১০৯টি কনটেইনার জাহাজীকরণ বিলম্বিত হচ্ছে। কিছু জাহাজমালিক এগুলো নিতে চাচ্ছেন না। কিছু কনটেইনার উৎপাদিত প্রতিষ্ঠানে ফেরত যাবে। 

গত ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের পর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বলা হচ্ছে, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থাকা কনটেইনারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ৪৮ জন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হন

বিস্ফোরণের ওই ঘটনার পর ডিপোগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে— জানতে চাইলে বিকডা মহাসচিব বলেন, কোথাও আমাদের সিকিউরিটি ঘাটতি আছে কি না, সেটা দেখা হচ্ছে। ঘাটতি থাকলে আমরা সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। ১৫ বছর ধরে কিন্তু হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখা হচ্ছে ডিপোগুলোতে। এর আগে এমন (বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনা) কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমরা এখন আগের চেয়ে বেশ সতর্ক।  

সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বীভৎস দৃশ্য। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে প্রশাসন / ছবি- সংগৃহীত 

‘শিপিং লাইন, রপ্তানিকারক, প্রস্তুতকারক— সবারই উচিত নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। আমরা তো শুধু কনটেইনার রাখার জায়গা দিই। যারা এসব বানাচ্ছেন এবং যেসব জারে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখছেন; সেগুলো নিরাপদ কি না, তা আগে দেখতে হবে। আমরা নরমাল কনটেইনার হ্যান্ডলিং করি। রপ্তানিকারকরা কনটেইনারে যা পাঠান তা আমরা ডিপোতে রাখি। পরে তা নির্দিষ্ট দেশে জাহাজীকরণ করা হয়।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে মেইনলাইন শিপিং প্রতিষ্ঠানগুলো বিএম ডিপোর ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর আপাতত কোনো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার জাহাজে নিচ্ছে না। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এমন অনেক কনটেইনার ডিপোতে পড়ে আছে বলে জানতে পেরেছি। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘদিন ধরে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি হচ্ছে। সীতাকুণ্ডের ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কেন এবং কী কারণে দুর্ঘটনা হয়েছে তা দ্রুত বের করা দরকার। কারণটা বের হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এই মুহূর্তে কোনো শিপিং লাইন রিস্ক নিতে চাচ্ছে না। কনটেইনার ডিপোতে এত বড় ঘটনা আগে ঘটেনি। স্বাভাবিকভাবে এর বিশাল একটা প্রভাব পড়েছে সবার ওপর।

সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নীল ড্রাম। ধারণা করা হচ্ছে এসব ড্রামে ভর্তি ছিল হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড / ছবি- সংগৃহীত

‘এর আগে বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার পর অনেক শিপিং লাইন এই ধরনের পণ্য (রাসায়নিক পদার্থ) পরিবহন করা থেকে বিরত থাকে। যারা করতো তারা আপাতত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পরিবহন করতে চাচ্ছে না।’ 

হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান সীমিত করেছে সিঙ্গাপুর

এদিকে, গত বৃহস্পতিবার শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে সিঙ্গাপুর তার বন্দর দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালান পরিবহন সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। সিঙ্গাপুর বন্দরের ওই নোটিশে বলা হয়েছে, গত ৪ জুন রাতে বাংলাদেশের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের পিএসএ টার্মিনালে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বহনকারী কনটেইনার খালাসের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

নিরাপত্তার অজুহাতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড-বোঝাই কনটেইনার পরিবহন করছে না জাহাজগুলো / ছবি- সংগৃহীত  

সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স (এসপিএফ) হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে একটি বিস্ফোরক দ্রব্য হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করে। এসপিএফের লাইসেন্স মোতাবেক পিএসএ-তে দ্রব্যটি মজুতের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিসীমা রয়েছে। 

নোটিশে আরও বলা হয়, বর্তমানে বন্দরটিতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের চালানের মজুত বেড়ে গেছে। নিরাপদ সীমার মধ্যে রাখতে নতুন করে এর চালান গ্রহণ না করতে পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিঙ্গাপুর বন্দরে এই জাতীয় কনটেইনার রাখার নিদিষ্ট একটা জায়গা আছে। এগুলো দেশটির পুলিশও তদারকি করে। এই মুহূর্তে সেখানে এসব কনটেইনার রাখার জায়গা কমে গেছে। এজন্য তাদের জায়গাটা ক্লিয়ার না হওয়া পর্যন্ত কনটেইনার পরিবহন সীমিত করেছে। আবার যখন স্পেস খালি হবে তখন তারা ওপেন করে দেবে— মনে করেন সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।

যুদ্ধবিধ্বস্ত কোনো ধ্বংসস্তূপ! সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর এমন চিত্র চোখে পড়ে / ছবি- সংগৃহীত 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি হয় ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, নেপাল, তানজানিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। মূলত সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কার বন্দর দিয়ে এসব পণ্য রপ্তানি হয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি করে দুই কোটি ৩৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৯ ইউএস ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। 

কেএম/এমএআর/