আবদুল কাদের মির্জা| ছবি- ঢাকা পোস্ট

নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার শক্তির উৎস কোথায়?- এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে। দলটির তৃণমূল নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ড করেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন আবদুল কাদের মির্জা।

তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। দলীয় গঠনতন্ত্রপরিপন্থী কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে দল থেকে চূড়ান্তভাবে বহিষ্কারের জন্য আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে সুপারিশ করেছে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ। একইসঙ্গে আজ (শনিবার) বিকেলে কাদের মির্জাকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরই সে অব্যাহতিপত্র তুলে নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে কাদের মির্জার বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না সেই প্রশ্নই এখন জনে জনে। 

• কাদের মির্জাকে উপজেলা আ.লীগের নির্বাহী কমিটি থেকে অব্যাহতি
• অব্যাহতির সিদ্ধান্ত ২ ঘণ্টা পরই স্থগিত
• কেন্দ্রীয়ভাবে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, প্রশ্ন জনে জনে 
• তৃণমূল থেকে শাস্তির দাবি উঠলেও নীরব কেন্দ্রীয় নেতারা
• কোম্পানীগঞ্জ আ.লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেন কাদের মির্জা
• এই বহিষ্কারাদেশ দলের গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী

হজ ও ইসলাম বিদ্বেষী মন্তব্যের কারণে ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় প্রবীণ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে। তার দুই সপ্তাহের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সব পর্যায় থেকে বহিষ্কার করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক শাস্তির নজির স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।  

ক্যাসিনোবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে ২০১৯ সালের সংগঠনের সব কর্মকাণ্ড থেকে অব্যাহতি পান তৎকালীন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সহসভাপতি এনামুল হক আরমানসহ প্রায় ডজনখানেক নেতা। ওই সময়ে একই অপরাধে সংগঠন থেকে অব্যাহতি পান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউসার ও সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ।

আবদুল কাদের মির্জা

বিগত বছরের ১১ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশক্রমে ও সংগঠনের গঠনতন্ত্র বিধি মোতাবেক সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার হাবিবে মিল্লাতকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আব্দুল লতিফ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, অব্যাহতি দিতে হলে তাকে শোকজ করতে হবে। কোনো প্রকার শোকজ ছাড়া অব্যাহতি ষড়যন্ত্রমূলক। করোনার জন্য আমরা আমাদের আশা-ভরসার আশ্রয়স্থল জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে পারছি না। আমরা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে আমাদের দুঃখের কথাগুলো বলব। দলে তো শৃঙ্খলা নেই। এখানে কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে কিছু নেতা এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিল্পপতিরা মিলে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। করোনার জন্য আমরা নেত্রী সঙ্গে সংযোগহীন আছি। করোনা গেলেই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে এসব বিষয় তুলে ধরব।

আবদুল কাদের মির্জা

ওই বছরের ১৯ নভেম্বর একই ধরনের বিজ্ঞপ্তিতে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম হিরু এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন ভূঁইয়াকে স্বীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আব্দুল মতিন ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দল করলে দলের শীর্ষ নেতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে।

গত ২৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন পাবনা সদর উপজেলা এবং পাবনা পৌর আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছেন।

দলটির তৃণমূল নেতারা বলছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি গঠনতন্ত্র পরিপন্থীভাবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেছেন আবদুল কাদের মির্জা। তৃণমূল থেকে শাস্তির দাবি উঠলেও অনেকটাই নীরব কেন্দ্রীয় নেতারা।

কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের ছোট ভাই হওয়ার সুবাদে গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন কাদের মির্জা

অভিযোগ আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের

আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সম্মানে এখন পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে আবদুল কাদের মির্জার বিরুদ্ধে কোনো কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের ছোট ভাই হওয়ার সুবাদে গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছেন আবদুল কাদের মির্জা। এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাও। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি তারা।

সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে স্বপদে বহাল থাকার নজির আওয়ামী লীগে নেই

ফেনী আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন

দলীয় গঠনতন্ত্র বিরোধী কর্মকাণ্ড ও দলের শীর্ষ নেতা, সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে স্বপদে বহাল থাকার নজির আওয়ামী লীগে নেই বলে জানান ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সোনাগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান জহির উদ্দিন মাহমুদ লিপটন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি উনি ভেঙে দিতে পারেন না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের এখনও তফসিল ঘোষণা হয়নি, উনি দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছেন। এই এখতিয়ার শুধু আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেবের সম্মানের জন্যই ওনার (আবদুল কাদের মির্জা) বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধরা কিছু বলছেন না। আমি এই বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে প্রতিকার চাই।

কাদের মির্জা শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে অপমানিত করছেন

নোয়াখালী পৌরসভা আ.লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টু

শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার শাস্তির দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নোয়াখালী পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ পিন্টু বলেন, কাদের মির্জা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে অপমানিত করছেন। এসব অশোভনীয় এবং সংগঠনবিরোধী অসদাচরণের জন্য তার শাস্তি দাবি করছি। সম্প্রতি কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করেছেন। যা দলের গঠনতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

এদিন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চাপরাশিরহাট ইউনিয়নের ফকিরা বাজারে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় সংবাদকর্মী গুলিবিদ্ধসহ উভয়পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ, ফাঁকা গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। আহতদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জনকে বসুরহাট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন ছাড়া সংগঠনের কোনো পর্যায়ের কমিটি বিলুপ্ত বা বাতিল করা যাবে না

আ.লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া

গত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন ছাড়া সংগঠনের কোনো শাখার (ইউনিট, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌর, থানা, উপজেলা, জেলা ও মহানগর শাখা) কমিটি বিলুপ্ত না করতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সাংগঠনিক নির্দেশনা প্রদান করেছে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী সম্মেলন/কাউন্সিল ছাড়া সংগঠনের যেকোনো পর্যায়ের কমিটি বাতিল করার ক্ষেত্রে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের বিধি-বিধান অনুসরণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের অনুমোদন ছাড়া সংগঠনের কোনো পর্যায়ের কমিটি বিলুপ্ত বা বাতিল করা যাবে না।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, একইভাবে আওয়ামী লীগের কোনো শাখা কমিটি উক্ত শাখার সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো কমিটি বিলুপ্ত বা বাতিল করতে পারবে না। সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কোনো শাখা কমিটি বিলুপ্ত বা বাতিল করার ক্ষমতা কেবলমাত্র ওই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠনসমূহ স্ব স্ব সংগঠনের গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে সংগঠনের গঠনতন্ত্রের বিধি-বিধান প্রতিপালন করার জন্য কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক নির্দেশনা প্রদান করা হচ্ছে।

এইউএ/এইচকে