রাজধানীর চকবাজার থেকে প্রায়ই প্রসাধনসামগ্রী (কসমেটিকস পণ্য) কেনেন আশরাফুন্নাহার অ্যামি। ধানমন্ডির একটি মার্কেটে সেগুলো বিক্রির পাশাপাশি পার্লারও পরিচালনা করেন তিনি। গত ৯ ডিসেম্বর চকবাজার থেকে বিদেশি ব্র্যান্ডের সাবান, লোশন, ক্রিম, শ্যাম্পুর পাশাপাশি পার্লারের জন্য কিছু প্রসাধনীও কেনেন। শত ভাগ আসল পণ্য মনে করেই সেগুলো কেনা। কিন্তু পার্লারে আনার পর ধরা পড়ে, আসল পণ্যের সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার টাকার নকল পণ্যও তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অ্যামির ভাষায়, পূর্বপরিচিত ও বিশ্বস্ত বলেই যাচাই-বাছাই না করে পণ্যগুলো নেওয়া। কিন্তু আমাকে ভেজাল পণ্য ধরিয়ে দেওয়া হলো। এটা তো খুবই ভয়ানক। আমি ব্যবসায়ী, আমার সঙ্গে এটা হয়েছে; তাহলে সাধারণ ভোক্তারা কোথায় যাবেন?

সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, প্রসাধনসামগ্রী প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের লাখ লাখ ভোক্তা সরাসরি বিভিন্ন ছোট-বড় দোকান থেকে হরেক রকমের প্রসাধনী কেনেন। তাদের অনেকেই না জেনে, না বুঝেই নকল ও মানহীন পণ্য সংগ্রহ করছেন। ভোক্তা-সংশ্লিষ্ট বৃহৎ এ খাতে যথাযথ নজরদারির অভাবে এক শ্রেণির অসাধু কারবারি মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য যা বলছে

২০২১ সালে ভেজাল প্রসাধনী পণ্যের বিরুদ্ধে ২৫০৯টি অভিযান পরিচালনা করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন— র‌্যাব। অভিযান শেষে মামলা হয় ১৩ হাজার ৫৭টি। অভিযানে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) ৪৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৪ টাকা জরিমানা আদায় করে। অভিযান শেষে ৯৮২ জনকে সরাসরি জেলহাজতে পাঠানো হয়।

ক্ষতিকর রাসায়নিক সমৃদ্ধ ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারে শুধু ক্যান্সার নয়, হতে পারে স্নায়ুবিক দুর্বলতা / ছবি- সংগৃহীত

র‌্যাবের এমন একটি অভিযানে ভেজাল পণ্য তৈরির কারখানা থেকে জব্দ করা হয় নকল জনসন বেবি লোশন। প্রত্যেকটি লোশনের গায়ে আসলের আদলে লাগানো লেভেলে লেখা ‘MANUFACTURED BY Johnson's & Johnson's LIMITED’ (জনসন এবং জনসন লিমিটেড কর্তৃক তৈরি)। এছাড়া জব্দ করা হয় এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা মূল্যের আট কার্টন লুসি অলিভা অলিভ অয়েল- ১০০ এমএল (মিলিলিটার)। যার প্রতিটি কাচের বোতলের গায়ে লাগানো লেভেলে ইংরেজিতে লেখা ‘Products of Spain’ (স্পেনের পণ্য)।

২০২১ সালে ভেজাল প্রসাধনী পণ্যের বিরুদ্ধে ২৫০৯টি অভিযান পরিচালনা করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন— র‌্যাব। অভিযান শেষে মামলা হয় ১৩ হাজার ৫৭টি। অভিযানে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) ৪৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৪ টাকা জরিমানা আদায় করে। অভিযান শেষে ৯৮২ জনকে সরাসরি জেলহাজতে পাঠানো হয়

এছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাব ১৩১টি অভিযান চালায়। মামলা দায়ের হয় ৫০৭টি। জরিমানা করা হয় তিন কোটি পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। কারাগারে পাঠানো হয় ৪৪ জনকে। র‌্যাব জানায়, ৫৬টি অভিযান পরিচালিত হয় ভেজাল পণ্য উৎপাদন সংক্রান্ত। এর মধ্যে ১৪টি প্রসাধনসামগ্রী (কসমেটিকস) সংক্রান্ত।

এসব ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য ও ত্বকের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর— বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে অথবা সচেতনতার কথা বলেও বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল প্রসাধনসামগ্রী দাপট। প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতা, ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন আসল পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

২০২১ সালে ভেজাল প্রসাধনী পণ্যের বিরুদ্ধে ২৫০৯টি অভিযান পরিচালনা করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন— র‌্যাব / ছবি- সংগৃহীত 

শুধু ক্যান্সার নয়, দেখা দিতে পারে ভয়ানক শারীরিক জটিলতা

লেজার ট্রিট ও ঢাকা ডার্মাটোলজি ইনস্টিটিউটের চিফ কনসালটেন্ট ডা. সরকার মাহবুব আহমেদ শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহারে অনেকে দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগে ভুগছেন। এমন অনেক রোগী আমাদের চেম্বারে আসছেন। নকল প্রসাধনীতে অতিমাত্রায় স্টেরয়েড, মার্কারি ও হাইড্রোকুইনোন থাকায় স্থায়ীভাবে চামড়া পাতলা হয়ে যায়। ত্বক অনিরাময়যোগ্য সংবেদনশীল হয়ে যায়। অনেকের চামড়ায় দীর্ঘস্থায়ী লালচে ভাব চলে আসে। ইদানীং অনেক পার্লারে ভেজাল প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়। রাখা হয় গলাকাটা দাম। যাদের ত্বকে সেনসিভিটি (সংবেদনশীলতা) রয়েছে তাদের উচিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে প্রসাধনী ব্যবহার করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল রিচার্স সেন্টারের পরিচালক ও ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষতিকর রাসায়নিক সমৃদ্ধ ও মানহীন প্রসাধনী ব্যবহারে শুধু ক্যান্সার নয়, হতে পারে স্নায়ুবিক দুর্বলতা। এমনকি বিকল হতে পারে কিডনি। তাই প্রসাধনীর মান নিয়ন্ত্রণ ও ভেজালমুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি।

‘গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, কাছাকাছি নাম বা বানান এদিক-সেদিক করে ব্র্যান্ড পণ্যের মতো বাজারজাত করা হচ্ছে নকল প্রসাধনী। সেখানে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান তো থাকেই, থাকে লেদার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল রং। ফলে ক্যান্সার, চর্মরোগ, অ্যালার্জিসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, এসব ভেজাল প্রসাধনী তৈরির কারখানা ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থিত। যা এখন ওপেন সিক্রেট। স্থানীয়রা বিষয়টি জানলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে তা আসছে না! এটা তো মানা যায় না। এ বিষয়ে ভোক্তাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয়।’

র‌্যাবের পরিচালিত মোবাইল কোর্ট গত বছর মোট ৪৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৪ টাকা জরিমানা আদায় করে / ছবি- সংগৃহীত

আসল আর নকলে বিস্তর ফারাক

গত ১৩ মার্চ মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পক্ষ থেকে পরিচালিত এক অভিযানে এ ধরনের বেশকিছু পণ্য জব্দ করা হয়। জব্দ করা ভেজাল প্রসাধনীর (কসমেটিকস) দুটি নমুনা (স্যাম্পল) আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। আসল প্রসাধনী পণ্যে যে মান নির্ধারণ করা আছে তার চেয়ে অনেক কম বা উপকরণের প্রমাণ মেলে বিএসটিআই রিপোর্টে।

বিএসটিআই থেকে সংগ্রহ করা সেই রিপোর্টের দুটি কপি এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে। সেখানে দেখা যায়, সাবানের (বেবি শপ) নমুনায় টোটাল ফ্যাটি ম্যাটার (মোট চর্বিযুক্ত উপাদান) থাকার কথা কমপক্ষে ৭৮ শতাংশ। কিন্তু রয়েছে ৬৬.৬৮ শতাংশ। ময়েশ্চার অ্যান্ড ভোলাটাইল ম্যাটার (আর্দ্রতা ও উদ্বায়ী উপাদান) সর্বোচ্চ যেখানে থাকার কথা ১৫.০, সেখানে মিলেছে অতিরিক্ত ২.৯১ শতাংশ।

অন্যদিকে, বেবি স্কিন লোশনের বিএসটিআই ল্যাব টেস্টের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ মান (বিডিএস ১৩৮২:২০১৯) অনুযায়ী এ ক্রিমে পানির পরিমাণ বেশি। স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস থাকার কথা ১০ জিএম, সেখানে পরীক্ষার ফলে উপাদানটির উপস্থিতি একেবারেই নেই। একই ভাবে অনুপস্থিত সিউডোমোনাস এরুগিনোসা ( Pseudomonas Aeruginosa)।

চলতি বছরের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত র‌্যাব ১৩১টি অভিযান চালায়। মামলা দায়ের হয় ৫০৭টি / ছবি- সংগৃহীত 

বিএসটিআই’র মান নির্ধারণ কমিটির কসমেটিকস অ্যান্ড রিলেটেড প্রোডাক্টস শাখার সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নূরনবী ওই রিপোর্ট প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফ্যাটি ম্যাটার হচ্ছে যেকোনো সাবানের (বেবি শপ) মূল উপাদান। একটি গুণগত মানসম্পন্ন সাবানের জন্য ফ্যাটি ম্যাটার থাকতে হয় কমপক্ষে ৭৮ শতাংশ। সেখানে ওই ভেজাল সাবানে রয়েছে ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ গুণগত মান উত্তীর্ণ নয় এটি।

দ্বিতীয়ত, ময়েশ্চার অ্যান্ড ভোলাটাইল ম্যাটার যেখানে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়েছে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ, ভেজাল ওই সাবানের ক্ষেত্রে তা তিন শতাংশ বেশি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ গুণগত মান পরীক্ষায় এটিও উত্তীর্ণ হয়নি। মূলত, আসল উপাদান ফ্যাটি ম্যাটার কম দিয়ে ময়েশ্চার বাড়িয়ে ব্যালান্স করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইনসলুবেল ইথানল (অদ্রবণীয় ইথানল) দেড় শতাংশের জায়গায় পাওয়া গেছে প্রায় চার শতাংশ। এটি বেশি দেওয়া হয়েছে কারণ, সাবানটা শক্ত থাকবে,  পিচ্ছিল ভাব কমবে। ক্রেতা বেশিদিন এটি ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু এটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে স্কিন ড্যামেজ (ত্বকের ক্ষতি) হবে, প্রদাহ বাড়াবে। যেসব ভোক্তার অ্যালার্জিজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য পরবর্তীতে এটি ভয়ানক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ইনসলুবেল ইথানলের উপস্থিতির পরিমাণ বেশি মানে সাবানটি মানহীন। এটি স্বাস্থ্যের জন্য অনুপযোগী।

ভেজাল নিয়ন্ত্রণে অনেকটা ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’- দশা বিএসটিআই’র— বলছেন অধ্যাপক ড. মো. নূরনবী / ফাইল ছবি

জনসনের নকল বেবি স্কিন লোশন পরীক্ষার রিপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেবি লোশনের ক্ষেত্রে আমরা পিএইচ (পোটেনশিয়াল অব হাইড্রোজেন)-এর মান নির্ধারণ করেছি ৫ থেকে ১০ শতাংশ। সেখানে পাওয়া গেছে ৬.৮৩ শতাংশ। এটা ভালো। কিন্তু এই ভালো সামাল দিতে গিয়ে ভেজাল কারবারিরা নন-ভোলাটাইল ম্যাটার কমপক্ষে ১০ শতাংশের জায়গায় দিয়েছে মাত্র চার শতাংশ। আবার ওয়াটার কনটেন্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এ ধরনের বেবি লোশন কেনার ক্ষেত্রে ক্রেতারা লুজার হবেন। কারণ, পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে খরচ কমিয়ে দিয়েছেন ভেজাল কারবারিরা।

ড. মো. নূরনবীর ভাষায়, “কসমেটিকস খুবই জনগুরুত্বপূর্ণ প্রডাক্ট। এটি মোটামুটি কম-বেশি সব শ্রেণির মানুষ ব্যবহার করে থাকেন। আমাদের কাছে বিভিন্ন সময় স্যাম্পল আসে, কানেও আসে যে ‘ভেজালে সয়লাব কসমেটিকসের বাজার’। কিন্তু ভেজাল নিয়ন্ত্রণে অনেকটা ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার’- দশা বিএসটিআই’র। তারা মান নির্ধারণ করছে, অনুমোদনও দিচ্ছে। কিন্তু নকল বা ভেজাল সামাল দিতে পারছে না। ভেজাল বন্ধে তাদের কোনো কর্মকৌশল নেই, অন্তঃসারশূন্য প্রতিষ্ঠান।”

দ্বিতীয় পর্বে থাকছে-
হুবহু জার-মোড়ক, লোগোয় আসল-নকলে ধাঁধা

জেইউ/এমএআর/