বর্ষার ভরা মৌসুমেও দেশে এখন চৈত্র-বৈশাখের মতো তীব্র খরতাপ চলছে। প্রায় বৃষ্টিহীন তপ্ত আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ মানুষের জীবনযাত্রা। গরমে নানা রোগে অক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ডিহাইড্রেশনসহ বিভিন্ন কারণে বেড়েছে ডায়রিয়ার প্রকোপ। প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ছুটে যান পাড়া-মহল্লার ওষুধের দোকানে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন তারা। এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমন ঝুঁকির কথা জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. ইকবাল হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : গরমে ডায়রিয়ার প্রকোপ কেন বাড়ে?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : গরম আসলে সব বয়সীরাই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। গরমের কারণে সবাই পিপাসার্ত থাকেন। যেখানে যে পানি পান সেটিই তারা পান করতে চান। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন সুপেয় পানি। সেই পানি আমরা অনেক সময় পাই না। যে কারণে বাধ্য হয়ে রাস্তার পাশের ময়লাযুক্ত পানি পান করতে হয়।

আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের সবার বাসাতেই ফ্রিজ নাই। খাবার তৈরির পর সেটি আমরা বেশ কিছুক্ষণ বাইরে রাখি। কিন্তু এই গরমে শীতের মতো খাবার অধিক সময় ভালো থাকে না। যে কারণে খাবারে অল্পপরিমাণ জীবাণু থাকলেও সেটি গরমে অনেকটা মাল্টিপ্লাই (সংখ্যা বৃদ্ধি) হয়। তাদের (জীবাণু) শরীর থেকে রস বের হয়। এ কারণে অল্প পরিমাণ খাবার খেলেও আমাদের ডায়রিয়া হয়।

ঢাকা পোস্ট : ডায়রিয়া হলে করণীয় কী?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি ও লবণ বের হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না। তবে, এর চিকিৎসা পদ্ধতি খুবই সহজ। যতবার পাতলা পায়খানা হবে, ততবার একটি করে খাবার স্যালাইন (৫০০ এমএল) সুপেয় পানিতে গুলিয়ে পান করতে হবে। একবার স্যালাইন গোলানো হলে তা ১২ ঘণ্টা ভালো থাকে।

ঢাকা পোস্ট : ডায়রিয়ায় আক্রান্ত একজন রোগী কী পরিমাণ স্যালাইন খাবেন?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : বাচ্চার যত কেজি ওজন তত চা-চামচ স্যালাইন প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর খাওয়াতে হবে। ওজনটা না জানলে আরেকটা পদ্ধতি আছে। সেটি হলো- যদি দুই বছরের নিচে বাচ্চার বয়স হয় তাহলে ৭৫ এমএল বা ১৫ চা-চামচ স্যালাইন খাবে। এভাবে যতবার তার পায়খানা হবে ততবারই সে এই প্রক্রিয়ায় স্যালাইন খাবে।

যদি বাচ্চার বয়স দুই থেকে ১০ বছরের মধ্যে হয় তাহলে তারা স্যালাইন পান করবে ১৫০ এমএল অর্থাৎ ৩০ চা-চামচের সমপরিমাণ। ১০ বছরের ওপর থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত ২৫০ এমএল স্যালাইন পান করবেন। এভাবে খেলে ধীরে ধীরে ডায়রিয়া ভালো হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রে আমাদের একটা খারাপ অভ্যাস আছে, তা হলো ওষুধ আনতে আমরা ফার্মেসিতে যাই। তারা অ্যান্টিবায়োটিক দেয়। কিন্তু সাধারণ ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না। অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে ডায়রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। আমাদের পরামর্শ হলো, ডায়রিয়া হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক কোনোভাবেই খাওয়া যাবে না। স্যালাইন হলো এর কার্যকর চিকিৎসা। কেউ যদি দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন, সেটি তার ঝুঁকির কারণ হতে পারে।

ঢাকা পোস্ট : ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে খাওয়া-দাওয়ায় কোনো বিধিনিষেধ আছে কি না?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর প্রধান খাবারই হলো স্যালাইন। এর বাইরে কিছু খেতে চাইলে প্রতিদিন একটা বা দুটা ডাবের পানি পান করতে পারবেন। এছাড়া চিড়ার পানি, ভাতের মাড় খাওয়া যাবে। যদি দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া বা আমাশয় হলে কাঁচা কলা খেতে পারবে। সেটি সিদ্ধ করে ভর্তা বা তরকারি আকারে খাওয়া যাবে। তবে, খেয়াল রাখতে হবে ওই কাঁচা কলা ছয় মাস বয়সের কম কেউ খেতে পারবে না। ডায়রিয়া হলে ৬ মাসের নিচের শিশুরা ১/২টা করে এবং ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুরা ১টা করে জিংক ট্যাবলেট ২ চা-চামচ বা ১/২ কাপ পানিতে মিশিয়ে প্রতিদিন ১ বার খাবে মোট ১০ দিন।

এরপরও যদি রোগীর অবস্থা খারাপ হয়, কোনো রোগী যদি ১২ ঘণ্টা ধরে প্রস্রাব না করে বা শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। এর বাইরে হাসপাতালে ভিড় করার কোনো কারণ নেই।

হাসপাতালে গুরুতর রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ দিতে হবে। রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হলে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সবারই এটা লাগে না। প্রথমপর্যায়ে যদি তারা ঠিকমতো স্যালাইন গ্রহণ করতেন, পচা ও বাসি খাবার না খেতেন, রাস্তায় ময়লাযুক্ত পানি পান না করতেন তাহলে ডায়রিয়া দ্রুত ভালো হয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : ডায়রিয়া প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : এতক্ষণ আমরা বলেছি ডায়রিয়া হলে কী করব। আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে ডায়রিয়া যেন না হয়। সেক্ষেত্রে একটি বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর থেকেই সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। বাচ্চা হবার প্রথম দুই বছর পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধই খাওয়াতে হবে। ছয় মাস পর্যন্ত অন্য কোনো দুধ খাওয়ানো যাবে না। কিন্তু সচরাচর আমরা দেখি, মানুষ তাদের বাচ্চাদের কৌটার দুধ, গরুর দুধ ইত্যাদি খাওয়ায়। এগুলো প্রায় সময়ই পরিষ্কার থাকে না। যে কারণে ডায়রিয়ার জীবাণু শিশুদের দেহে প্রবেশ করে।

পানি খাওয়ার বিষয়ে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। পরিষ্কার পানি নিয়েও যদি কারও কনফিউশন থাকে, তাহলে ফুটিয়ে পান করতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : পানি ফুটানোর আসল প্রক্রিয়া কোনটি? কেমন তাপমাত্রায় পানি বিশুদ্ধ হয়?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : পানি ফুটানো নিয়ে অনেকের মধ্যে কনফিউশন থাকে। অনেকে বলেন, আধাঘণ্টা ফুটাতে হবে। কেউ কেউ বলেন, ২০ মিনিট পর্যন্ত ফুটাতে হবে। আসল নিয়ম হলো, পানি ফুটতে শুরু করার পর পাঁচ মিনিট সেভাবে রাখতে হবে। এরপর চুলা থেকে নামিয়ে সেই পানি ঠান্ডা করে পান করতে হবে।

আর একটি বিষয় হলো, প্রস্রাব-পায়খানার পর আমরা সেভাবে হাত পরিষ্কার করি না। কিন্তু সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় ধরে হাত ধুতে হবে। খাবার আগেও একইভাবে হাত ধুতে হবে। খাবার প্লেট বা থালাবাসনও ঠিক মতো পরিষ্কার করতে হবে। দেখা যায়, আমরা বাচ্চার খাবার হয়তো ফুটানো পানি দিয়ে তৈরি করছি। কিন্তু তার খাবারের বাটিটা নরমাল পানিতে ধৌত করছি। অবশ্যই সেগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে, প্রয়োজনে গরম পানি দিয়ে ধুতে হবে। এসব নিয়ম মানলে ডায়রিয়া অনেকাংশে কমে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : কোন বয়সের মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন বেশি এবং কেন?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : এই মুহূর্তে আমরা যেটা দেখছি, বড়দের তুলনায় ছোটরাই বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু যখন অনেক গরম পড়ে, তখন বড়দের আক্রান্ত হওয়ার হারও বেড়ে যায়। বিশেষ করে যারা কায়িক পরিশ্রম বেশি করেন, সারাদিন বাইরে বাইরে থাকেন, যেমন- রিকশাওয়ালা; তারা তো গরমে পিপাসার্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তারা পিপাসা নিবারণে বাইরের দূষিত পানি, রাস্তার পাশের লেবুর শরবত বা নানা রঙের শরবত জাতীয় পানীয় খান। সাময়িকভাবে তৃপ্তি দিলেও এটি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এক্ষেত্রে তাদের করার কিছুই থাকে না। বাধ্য হয়েই তাদের এটি পান করতে হয়। অনেকে আবার অসতর্কতাবশত খেয়ে থাকেন। ফলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

ঢাকা পোস্ট : শুধু কি গরমের কারণেই ডায়রিয়া হয়, নাকি অন্য সময়েও হয়?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : সাধারণত গরমের সময় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। শীতের সময়ও এটি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময়ে ছোট বাচ্চারা আক্রান্ত হয় বেশি। রোটা ভাইরাসের কারণে এমনটি হয়। গরম হোক বা শীতে হোক, এর চিকিৎসা-ব্যবস্থা কিন্তু একই। স্যালাইনের বাইরে আর কোনো ওষুধের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক তো নয়ই।

অ্যান্টিবায়োটিক তখনই লাগে যখন রক্ত আমাশয় হয় বা একদম পানির মতো পায়খানা হয়। তবে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

ঢাকা পোস্ট : ডায়রিয়ার সঙ্গে প্রায় সময়ই জ্বরে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে কোন ধরনের চিকিৎসা-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : কিছু টাইপের ডায়রিয়া আছে, যেগুলোর কারণে জ্বর হয়। সেক্ষেত্রে স্যালাইন খেতে থাকবে। জ্বর যদি ১০০ ডিগ্রির বেশি হয়, তাহলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। ছোট বাচ্চারা প্রতি কেজিতে ৫০ মিলিগ্রাম ডোজ একেকবার খাবে, বড়রা ৫০০ মিলিগ্রামের প্যারাসিটামল খেতে পারবে। এক্ষেত্রে দিনে তিনবার, বেশি জ্বর হলে চারবারও খেতে পারবে। আশা করি জ্বর কমে যাবে। যদি না কমে তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : এই মুহূর্তে কোন কোন এলাকা থেকে ডায়রিয়ার রোগী বেশি আসছে?

ডা. মো. ইকবাল হোসেন : ঢাকায় ডায়রিয়ার কিছু পকেট আছে, বিশেষ করে দক্ষিণ খান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর এরিয়া। এসব এলাকা থেকে রোগী একটু বেশিই আসে।

ঈদুল আজহা গেল, এর তিন-চারদিন বা এক সপ্তাহ আগে থেকেই রোগীর সংখ্যা একটু কম। কারণ, ঈদে অনেকে বাড়ি গেছেন। তবে, খুব যে কম তাও বলা যাচ্ছে না। প্রতিদিন প্রায় সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো রোগী হাসপাতালে আসছেন। আমার ধারণা, শনিবারের (১৬ জুলাই) পর থেকে আক্রান্তের সংখ্যাটা বেড়ে যাবে। ঢাকার লোক সংখ্যা যত বেশি হবে রোগীর সংখ্যাও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।

তবে, আমাদের জন্য একটা ভালো খবর হলো, দু-তিন সপ্তাহ আগে আমরা কলেরা টিকার একটা ক্যাম্পেইন করেছি। অসংখ্য মানুষকে আমরা কলেরা টিকার আওতায় আনতে পেরেছি। আশা করছি, এ টিকার কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ অনেকটা কমে আসবে। পরবর্তী ছয় মাস থেকে আগামী তিন-চার বছর পর্যন্ত ওইসব এলাকায় (যেসব এলাকায় টিকা দেওয়া হয়েছে) ডায়রিয়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

টিআই/এমএআর/