রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকার ব্যবসায়ী দীন মোহাম্মদ শুভ। পারিবারিকভাবে তিনি কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ী। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, লবণের দাম বৃদ্ধি, ট্যানারি মালিকদের কাছে কোটি টাকা বকেয়া, সাভারে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা আড়তসহ বিভিন্ন কারণে পোস্তা এলাকায় চামড়া ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে বলে জানান তিনি।

দীন মোহাম্মদের বাবা মোহাম্মদ দীপুও পোস্তার চামড়া ব্যবসায়ী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পৈত্রিক বাড়ি পোস্তা এলাকায়। ছোটবেলা থেকে বাবাকে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করতে দেখেছি। এখন নিজে করছি, আমার ছেলেও করছে। ভালোই ছিল এই ব্যবসা। কিন্তু এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।

এ বছর পোস্তায় কাঁচা চামড়া তুলনামূলকভাবে খুবই কম এসেছে। এর জন্য সাভারে চামড়া শিল্পনগরের পাশে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ আড়তগুলোকে দায়ী করছেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা।

তিনি বলেন, পোস্তা এলাকার অনেক আড়তদার এরই মধ্যে সাভারে চলে গেছেন। আরও অনেকে ছেড়ে যাবেন বলে শুনেছি। কিন্তু আমার এলাকা এটা, ছেড়ে যাই কীভাবে? এতদূর গিয়ে কীভাবে ব্যবসা করব?

> ট্যানারি নিয়ে সংসদীয় কমিটির সুপারিশে মন্ত্রণালয় ‘হয়ত বিব্রত’

তাঁর মতে সাভারে আড়ত হওয়া মানে চামড়ার ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হওয়া। সরকার উদ্যোগী হলে পোস্তা এলাকার চামড়ার বাজার টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।  

আড়তদাররা জানান, দেশে কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বড় বাজার লালবাগের পোস্তা এলাকায়। এখানে চামড়ার ব্যবসা শত বছরের ঐতিহ্যবাহী। ঈদুল আজহার দিন দুপুর থেকে জমজমাট হয়ে ওঠে পোস্তা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে অন্যবারের তুলনায় এ বছর পোস্তায় কাঁচা চামড়া তুলনামূলকভাবে কম এসেছে। সেজন্য সাভারের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরের পাশে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা অবৈধ আড়তগুলোকে দায়ী করছেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা।

পোস্তার সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে 

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী পোস্তা এখন নানমুখী সংকটে পড়েছে। তারা জানান, পোস্তা একটা ঘিঞ্জি এলাকা। এখানে রাস্তাঘাট সরু, বাড়িঘর বেশি। আগুন লাগলে ঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে পারে না। বাজারের রাস্তা একটা, তাও অনেক সরু। চামড়া কেনাবেচার মার্কেটে বড় রাস্তা লাগে। যাতে চার-পাঁচটি গাড়ি একসঙ্গে চলাচল করতে পারে। সরু রাস্তার কারণে পোস্তায় চামড়া কিনতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়।

অপরদিকে গুলিস্তান থেকে জ্যাম না থাকলে এক ঘণ্টায় সাভারের হেমায়েতপুর যাওয়া যায়। এই বিবেচনায় অনুমোদন না থাকলেও অনেকেই সাভারমুখী হয়েছেন। বছর দুয়েকের মধ্যে পোস্তায় চামড়া আসা আরও কমে যাবে বলে জানান তারা।  

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি আফতাব খান বলেন, ২০১৫ সালের পরে বিশ্বমন্দার কারণে দিনদিন ব্যবসা নষ্ট হওয়ায় অনেকে এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। একটা সময় শতভাগ চামড়া পোস্তা থেকে নেওয়া হতো। এখন ৫০ শতাংশ পোস্তায় আসে, ৫০ শতাংশ ট্যানারি মালিকরা সরাসরি সংগ্রহ করেন।

তিনি বলেন, সরকারিভাবে আমাদের কাঁচা চামড়ার বাজার করে দেওয়া হবে বলে শুনেছি। এজন্য ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে যেভাবে টাকা নেওয়া হয়েছিল, আমাদের থেকেও একইভাবে নেওয়া হবে। এই বাজার সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর তিন কিলোমিটারের মধ্যে হতে পারে।

> বেড়েছে খরচ, বুঝে-শুনে চামড়া কেনার পরামর্শ

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, পোস্তা এলাকার ঐতিহ্য হারানোর শঙ্কা তো আছেই, ১০০ বছরের পুরোনো এ মার্কেট ধ্বংস হওয়ারও উপক্রম হয়েছে। আমরা এটা নিয়ে আতঙ্কিত। এ বছর দেড় লাখ কাঁচা চামড়া কেনার টার্গেট ছিল। কিন্তু  কিনেছি এক লাখের একটু বেশি। এবার যে পরিস্থিতি দেখলাম, আগামী বছর অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে।

তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকরা সরাসরি চামড়া সংগ্রহ করছে এখন। এমনকি এ বছর গত বছরের তুলনায় তাদের সংগ্রহ বেড়েছে। এছাড়া হেমায়েতপুরে ট্যানারির পাশে অবৈধ মার্কেট গড়ে উঠেছে। কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে সেখানে র-হাইডের (কাঁচা চামড়া) বাজার থাকার কথা নয়। এরপরও সেখানে ৫০-৬০টি গুদাম গড়ে উঠেছে। নিয়মিত ব্যবসা করছে তারা। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।

কোরবানির চামড়া কিনতে এবার ৪৩৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকারি-বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ২৫৮ কোটি এবং বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক দিয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে টিপু সুলতান বলেন, এই টাকা শুধুমাত্র ট্যানারি মালিকদের জন্য বরাদ্দ। আমাদের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। দুই তিন বছর আগে ব্যাংকগুলো ক্যাশ টু ক্যাশ ঋণ অফার করেছিল। কিন্তু এটা চামড়া ব্যবসার জন্য যথেষ্ট নয়। কাউকে ১০ লাখ, ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকা দিয়েছিল। দু’চারজন নিয়েছিল কিন্তু ঢালাওভাবে নয়। আমরা মনে করি, র-হাইডও ঋণ পাওয়ার যোগ্য। তারা (ট্যানারি মালিক) ৪৩৩ কোটি টাকা ঋণ পেলে র-হাইডও ৫০-১০০ কোটি টাকা পেতে পারে। কারণ চামড়ার প্রান্তিক যোগান এরাই দিয়ে থাকে।

তিনি বলেন, পোস্তা এলাকায় ৫-৭ বছর আগেও ১৬০০ থেকে ১৮০০ ফড়িয়া এবং ২৯৪ জন আড়তদার ছিল। এখন আড়তদার ও ফড়িয়া অর্ধেক হয়ে গেছে। অনেকেই জীবিকার তাগিদে পোস্তা এলাকা থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। আমরা যদি ঐতিহ্যবাহী এই মার্কেটের জৌলুস হারিয়ে ফেলি, অনেক আড়তদার ও ফড়িয়া ভাইয়েরা নিঃস্ব হয়ে যাবে। সরকার যদি অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তবেই আমাদের একশ বছরের পুরোনো মার্কেট তার জৌলুস ফিরে পাবে।
 
সাভারে অবৈধ আড়ত, কী বলছেন ট্যানারি মালিকেরা

চামড়া সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অবৈধ আড়তের বিষয়ে পোস্তা এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহও।

তিনি বলেন, আমরা আগে অল্পকিছু কাঁচা চামড়া কিনতাম। এমনিতে লবণ দেওয়া চামড়াই বেশি কেনা হতো। ঈদ ছাড়া অন্য সময়গুলোতে সারাদেশ থেকে চামড়া সংগ্রহ করে তারা (পোস্তার ব্যবসায়ীরা)। এরপর সেগুলো লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখার পর আমাদের প্রতিনিধিরা গিয়ে কিনে আনে। তবে গত দুই বছর কোভিডের কারণে চামড়ার আমদানি কম ছিল। এ বছর কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় গত দুই বছরের চেয়ে আমদানি বেশি, আমাদের চামড়া সংগ্রহের পরিমাণটাও বেশি।

সাভারে স্থানান্তরের পর হাজারীবাগের ট্যানারির জায়গাটা রেড জোন করে রাখা হয়েছে। এটা বাতিল করলে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেনা-পাওনার হিসেবটা পুরোপুরি চুকে যাবে বলে মনে করেন ট্যানারি মালিকেরা।

তিনি বলেন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে ঢোকার মুখে অনেকগুলো আড়ত হয়ে গেছে। এই আড়তগুলোর কারণে কিছু চামড়া পোস্তায় না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসে। এগুলো অবৈধ আড়ত। আড়ত করতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। কিন্তু তারা কোনো নিয়মের তোয়াক্কা না করে হঠাৎ করেই এখানে আড়ত করে ফেলল। এটা আমাদেরও কাম্য নয়।

আর পোস্তা তো অনেক পুরোনো বাজার। সেখানকার ব্যবসায়ীরাও পুরোনো। তারা জানে কীভাবে চামড়া সংগ্রহ করতে হয়, সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু এখানে এরা তো চামড়া সম্পর্কে কিছু না জেনেই কেনাবেচা করছে। আমরা চাই, পোস্তা বাজারটা টিকে থাকুক। আমরা তাদের থেকেই চামড়া সংগ্রহ করতে চাই।

চামড়া ব্যবসায়ীদের বকেয়া টাকার বিষয়টি স্বীকার করে বিটিএ’র সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, অভিযোগগুলো আমাদের কাছে আসে। তারা (চামড়া ব্যবসায়ী) অনেকের কাছেই টাকা পান। আসলে এখানে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। কিছু বাকি বকেয়া তো থাকবেই। এছাড়া হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের পর এখনো অনেকে উৎপাদনে যেতে পারেনি। তারা টাকা দেবে কীভাবে?

হাজারীবাগের ‘রেড জোন’ও একটা সমস্যা

সাভারে স্থানান্তরের পর হাজারীবাগের ট্যানারির জায়গাটা রেড জোন করে রাখা হয়েছে। এটা বাতিল করলে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেনা-পাওনার হিসেবটা পুরোপুরি চুকে যাবে বলে মনে করেন ট্যানারি মালিকেরা।

বিটিএ’র সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এখানে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। সরকার জায়গাটা বুঝিয়ে দিলে সেটা বিক্রি করে বা ডেভেলপারদের দিয়ে সেই টাকা দিয়ে ব্যাংক লোন ও ব্যবসায়ীদের দেনার টাকা মেটানো যাবে। সরকার আমাদের জায়গা ছেড়ে দিতে বলেছিল, আমরা ছেড়ে দিয়ে সাভারে এসেছি। কিন্তু কী কারণে সেই জায়গা রেড জোন করে রাখা হয়েছে, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। ওই জায়গায় যেহেতু স্থাপনা করতে দেওয়া হবে না, আমাদের জায়গা বুঝিয়ে দিক।
 
কী বলছে কর্তৃপক্ষ

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিসিক, এসএমই ও বিটাক) কাজী সাখাওয়াত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাভারে অবৈধ আড়তের বিষয়ে অভিযোগ সত্য। আমরা দেখেছি ওই আড়তদাররা পরিবেশ নষ্ট করছে। ঈদের পরদিন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব সেখানে গিয়েছিলেন। সেখানে বসেই তিনি পরিবেশ অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকারের টিম এনে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকেও বলা হয়েছে।

পোস্তার বাজার স্থানান্তর করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আড়ত তো এক জায়গায় হুট করে নেওয়া যায় না। এ ধরনের কোনো প্রস্তাব আমরা এখনও পাইনি, সিদ্ধান্ত তো পরের কথা। ট্যানারির আশপাশে নিতে হলে জায়গা লাগবে। ট্যানারি স্টেটের পাশে আরেকটা ট্যানারি স্টেট করার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। যদি সেটা হয়, তাহলে আরেকটা প্রকল্প হবে। তার মানে এই নয় যে, আড়তগুলো সেখানে নেওয়া হবে। আড়ত শিফট করার বিষয়টি এখনও সামনে আনা হয়নি। যখন প্রস্তাব আসবে, তখন স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

চামড়া ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকট নিরসনে ঋণপ্রাপ্তি সহজ করার সুপারিশ করা আছে উল্লেখ করে কাজী সাখাওয়াত বলেন, আমাদের একটি টাস্কফোর্স আছে। টাস্কফোর্সের সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে অনুরোধ করেছি, তারা যেন সহজ শর্তে চামড়া ব্যবসায়ী আড়তদারদের ঋণ দেন। সেখানে ব্যাংকগুলোও ছিল। আমরা যতটুকু জানি, আগের চেয়ে সহজ শর্তে যাতে ঋণ দেয় সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও নির্দেশনা দিয়েছে।

ট্যানারি মালিকদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, হাজারীবাগের জায়গার বিষয়ে টাস্কফোর্সের সভায় আমরা রাজউককে অনুরোধ করেছি। তারা হয়ে যাবে হয়ে যাবে বলে কালক্ষেপণ করছে। সচিবের নেতৃত্বে সাব-কমিটিও রাজউককে অনুরোধ করেছে যেন দ্রুত ‘রোড জোন’ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
 
এএজে/জেডএস