তিন দশক আগে যাত্রা শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্ক। আট সদস্যের সংস্থাটি এখন পর্যন্ত মহাসচিব পেয়েছে ১৪ জন। এক দশকেরও বেশি সময় আগে সদস্যপদ পেলেও এখনও জোটের মহাসচিব হতে পারেনি আফগানিস্তান। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী সার্ক মহাসচিবের পদ পাওয়ার কথা রয়েছে দেশটির।

বছর-খানেক আগে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসে তালেবান। ইসলামিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান থেকে হওয়া তালেবান-শাসিত ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তানের এখনও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। ফলে সার্কের মহাসচিব পদ পাওয়া থেকে দেশটির বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে পরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে মহাসচিব হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে, এটি নির্ভর করছে সংস্থাটির অন্য সদস্যদের মতামতের ওপর।

বছর খানেক আগে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসে তালেবান। ইসলামিক রিপাবলিক অব আফগানিস্তান থেকে হওয়া তালেবান-শাসিত ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তানের এখনও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। ফলে সার্কের মহাসচিব পদ পাওয়া থেকে দেশটির বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে পরবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে মহাসচিব হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে, এটি নির্ভর করছে সংস্থাটির অন্য সদস্যদের মতামতের ওপর

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে সার্কের মহাসচিব হিসেবে আছেন শ্রীলঙ্কার কূটনীতিক এসালা রোয়ান ভিরাকুন। মহাসচিব পদে আগামী বছরের মার্চের শুরুতে তার দায়িত্ব শেষ হবে। সার্কের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আদ্যক্ষর দিয়ে মহাসচিব নিয়োগ হয়। নিয়োগ অনুযায়ী পরবর্তী মহাসচিব আফগানিস্তান থেকে আসার কথা। কিন্তু ২০০৭ সালে যে দেশটি সার্কের সদস্য পদ পেয়েছে, সেই আফগানিস্তান বর্তমানে নেই। নতুন আফগানিস্তানের স্বীকৃতি এখনও মেলেনি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্কের মহাসচিব নিয়ে জটিলতা আছে। বর্তমানে দায়িত্ব আছে শ্রীলঙ্কা। বর্তমান মহাসচিব আগামী বছরের ১ মার্চ পর্যন্ত আছেন। মহাসচিব হিসেবে তিনি তার দায়িত্ব নবায়ন করতে চান। কিন্তু সার্কের নিয়ম অনুযায়ী নবায়নের কোনো সুযোগ নেই। পরবর্তী মহাসচিব আফগানিস্তান থেকে আসার কথা। কিন্তু দেশটির তালেবান সরকার এখনও স্বীকৃতি পায়নি। ফলে মহাসচিব নিয়োগ নিয়ে ভালোই জটিলতা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন >> সার্ক বাঁচাতে বাংলাদেশকে পাশে চান মহাসচিব

‘আফগানিস্তান নাম পরিবর্তন করে ফেলেছে। সার্কে যে আফগানিস্তান, সেটা তো নাই। সার্কে যারা মহাসচিব হচ্ছেন, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বছর-খানেক আগে শুরু হয়। কিন্তু বর্তমান মহাসচিবের দায়িত্ব শেষ হতে ছয় মাসও সময় নেই। কিন্তু এখনও নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। সাধারণত আদ্যক্ষর দিয়ে যে সদস্য রাষ্ট্রের নাম আসে তারা পছন্দের ব্যক্তির নাম দেন। সেটা অন্যরা যাচাই-বাছাই করে মতামত জানান। পরবর্তীতে সার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভায় নিয়োগ অনুমোদন দেওয়া হয়।’

আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের মহাসচিব হওয়ার সুযোগ আছে কি না—জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সদস্যরাষ্ট্ররা যদি কাউকে সমর্থন দেয়, তাহলে সম্ভব। যদি আফগানিস্তান থেকে মহাসচিব না দেওয়া হয়, নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশের নাম আসে। সবাই সমর্থন করলে বাংলাদেশের হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং নিজেদের মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির দর্শন নিয়ে ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে সার্ক। ওই বছরের ৭ থেকে ৮ ডিসেম্বর ঢাকা সম্মেলনের মাধ্যমে জোটটি সাংগঠনিক কাঠামো পায়। সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী আদ্যক্ষর দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় সংস্থাটির মহাসচিব পদের। শুরুতে বাংলাদেশের আবুল হাসানকে এ পদে বসানো হয়। তিনি সার্কের প্রথম মহাসচিব হিসেবে চার বছর দায়িত্ব পালন করেন। একযুগ পর ফের সার্কের মহাসচিব হয় বাংলাদেশ। বর্তমান সার্ক মহাসচিব শ্রীলঙ্কার এসালা রোয়ান ভিরাকুন। ২০২০ সালের মার্চে তিনি সার্কের মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার মেয়াদ আগামী মার্চে শেষ হবে।

তালেবান-শাসিত ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তান এখনও রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে সার্কের মহাসচিব পদ পাওয়া থেকে দেশটির বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি / ছবি- সংগৃহীত 

সার্কের মহাসচিব পদে বাংলাদেশের কারও নাম আসা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী আফগানিস্তান থেকে মহাসচিব আসার কথা। কিন্তু তাদের স্বীকৃতি না থাকায় অনেক সদস্য তাদের মেনে নেবে না বা আপত্তি থাকবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কারও মহাসচিব হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পাকিস্তান যেহেতু আফগানিস্তানকে সমর্থন করে, তারা বাংলাদেশের মহাসচিব হওয়া নিয়ে আপত্তি করতে পারে। সেই বিবেচনায় বর্তমান মহাসচিব যেহেতু দায়িত্ব নবায়ন করতে চান, তার হওয়াই ভালো হবে।

ভারত-পাকিস্তানের পর সার্কের ‘কাঁটা’ আফগানিস্তান

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সমন্বয়ের স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও নানা কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সার্ক। জোটটির নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকেই এর বিকল্প দেখারও পরামর্শ দিয়েছেন। সার্কের এমন অবস্থায় আসা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কের তিক্ততাকে দায়ী করছেন কূটনীতিকরা। বর্তমানে সার্কের সামনে এগোনোর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আফগানিস্তানের দায় দেখছেন ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।

ওই কর্মকর্তা বলেন, সার্কের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ কোনো রকম চলছে। প্রায় সাত বছর সার্কের সম্মেলন হচ্ছে না। শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে সম্মেলন বা বৈঠক হচ্ছে না। এসব না হওয়ার মধ্যে ফাংশনাল বা গভর্নিং বডি পর্যায়ে আমাদের কাজগুলো চলছিল। কিন্তু আফগানিস্তানে তালেবান আসার পর আরও জটিলতা তৈরি হয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে বৈঠক বা ফাংশনাল কাজগুলো করাও কঠিন। কিন্তু তাদের প্রতিনিধিত্ব কে করবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার দু-এক সদস্য তাদের নিয়ে আপত্তি করছে।

আরও পড়ুন >> তহবিলে টান, সংকটে সার্ক

এখন পর্যন্ত সার্কের ১৮টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে নেপালে সর্বশেষ সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় / ছবি- সংগৃহীত

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্থিতিশীলতা না থাকলে সেটার কারণে কোনো জোট ভালোভাবে এগোতে পারে না। আফগানিস্তানকে বাদ দিয়ে সামনে এগোনো সম্ভব না। সার্কের গতিশীলতায় ভাটা পড়ার ক্ষেত্রে দুটি দেশের দায় থাকলে সম্প্রতি তাদের মধ্যে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আফগানিস্তান নিয়ে। দেশটি বাদ দিয়ে অন্য সদস্যরাষ্ট্ররা এ বছরের বাৎসরিক চাঁদাও দিয়েছে। আমরা দিয়েছি, ভারত দিয়েছে।

সার্কের গত কয়েক বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের পরস্পর-বিরোধী মনোভাব বা দ্বন্দ্ব সার্কের ধীরগতি অর্থাৎ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলার মূল কারণ। সর্বশেষ, ২০১৪ সালে নেপালে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আর কোনো সম্মেলন হয়নি। এমনকি সার্কের মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হচ্ছে না।

গত বছর জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে প্রস্তাবিত সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকও বাতিল হয়। মূলত, আফগানিস্তানকে ভার্চুয়ালি বৈঠকে রাখায় এটি বাতিল হয়। কারণ, তালেবান সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে পাকিস্তান ছাড়া বৈঠকে বসতে রাজি ছিল না সদস্য রাষ্ট্রগুলো।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফি বিনতে শামস ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্কের গতিশীলতা কমে গেছে, এটা ঠিক। তবে, ধারণা করা হচ্ছে এ সমস্যা কেটে যাবে। সামনে সার্ক কার্যকর হবে। মাস-দুয়েক আগে সার্কের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি সার্কের বিভিন্ন কর্মসূচি ও কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেন। সার্কের টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশ সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

এখন পর্যন্ত সার্কের ১৮টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালে নেপালে সর্বশেষ সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানে সার্কের ১৯তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরির সেনাঘাঁটিতে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিবাদে সম্মেলন বয়কট করে ভারত। ভারতের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। এরপর থেকে মোটামুটি অকার্যকর দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় এ সংস্থা।

এনআই/এমএআর/