মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হারিছ চৌধুরী ও ওসমান ফারুক

মানবতাবিরোধী অপরাধ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বিএনপির একসময়ের শীর্ষনেতাদের মধ্যে অত্যন্ত তিনজন আত্মগোপনে চলে গেছেন। আইনের চোখে এরা পলাতক আসামি। ওই তিন নেতার মধ্যে দুজনের সঙ্গে দলটির শীর্ষপর্যায়ের যোগাযোগ থাকলেও একজনের খোঁজ নেই। দলটির তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

আত্মগোপনে যাওয়া তিনজনের একজন হলেন বিএনপির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা হারিছ চৌধুরী। সর্বশেষ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তের সঙ্গে সঙ্গেই গা ঢাকা দেন তৎকালীন হাওয়া ভবনের দাপুটে এ নেতা। আজ পর্যন্ত তার কোনো হদিস নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও তার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি জীবিত নাকি মৃত, সেটিও সবার কাছে ধোঁয়াশা। আত্মীয়-স্বজনরাও তার সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছেন না।

এ সরকারের আমলে অপরাধ না করেও অনেকে জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং করছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে গেছেন। রাজনীতি করেন না, এমন অনেক মানুষও সরকারের রোষানলে দেশত্যাগ করেছেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে সবাই দেশে ফিরবেন

শামসুজ্জামান দুদু, ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি

হারিছ চৌধুরীর মতো বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদও আছেন আত্মগোপনে। তবে তার সঙ্গে দলটির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ আছে। বিএনপির অপর নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক ২০১৬ সাল থেকে দেশছাড়া। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা হারিছ চৌধুরী

হারিছ চৌধুরী জীবিত নাকি মৃত, রহস্য এখনও

সিলেটের কানাইঘাট থানা থেকে রাজনীতি শুরু করেছিলেন হারিছ চৌধুরী। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তারপরও তিনি মাঠের রাজনীতি ছেড়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করেন।

হারিছ চৌধুরী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এছাড়া তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা, দুর্নীতিসহ প্রায় শতাধিক মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার কোনো খোঁজ পুলিশের কাছেও নেই

২০০১ সালে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তিনি প্রতাপের সঙ্গে হয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা। দাপটের সঙ্গে হাওয়া ভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিএনপির সর্বোচ্চ মহল ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে গড়ে তোলেন বিপুল অবৈধ সম্পদ।

আমাদের কাছে হারিছ চৌধুরীর কোনো খোঁজ নেই। তিনি কোথায় আছেন, সেটাও জানি না। তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই

নাসিম হোসেন, সভাপতি, সিলেট মহানগর বিএনপি

বিএনপির নেতারা বলছেন, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে দেশে ছেড়ে পালিয়ে যান হারিছ চৌধুরী। কথিত আছে, তখন তিনি সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে অবস্থিত নানা বাড়িতে পালিয়ে যান। সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে স্থানীয় নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং দেশে ফিরে আসার ইচ্ছার কথাও জানান। কিন্তু নেতাকর্মীরা তাকে দেশে না ফিরতে পরামর্শ দেন। এরপর থেকে বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।

সিলেট মহানগর বিএনপি নেতা নাসিম হোসেন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে হারিছ চৌধুরীর কোনো খোঁজ নেই। তিনি কোথায় আছেন, সেটাও জানি না। তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’

হারিছ চৌধুরী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। এছাড়া তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা, দুর্নীতিসহ প্রায় শতাধিক মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তার কোনো খোঁজ পুলিশের কাছেও নেই।

তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে, সেটাও আমরা জানি না

বড় ভাই কামাল চৌধুরী

সিলেটের কানাইঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে হারিছ চৌধুরীর কোনো খোঁজ নেই। আমি এখানে ১ জানুয়ারি যোগ দিয়েছি। তার বাড়ির কে কোথায় থাকে, সেটাও জানা নেই।’

সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট এলাকায় হারিছ চৌধুরীর বাড়িতে বর্তমানে থাকেন তার বড় ভাই কামাল চৌধুরী। হারিছ চৌধুরীর সম্পত্তির দেখভালও করেন তিনি। তবে, তার কাছেও ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই বলে ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন।

কামাল চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে, সেটাও আমরা জানি না।’

সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, হারিছ চৌধুরীর অবস্থান সম্পর্কে কারও কাছেই সঠিক কোনো তথ্য নেই। কখনও শোনা যায়, তিনি ভারতে নানা বাড়িতে থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। আবার কেউ বলেন, তিনি লন্ডনে আছেন। আবার অনেকের কাছে শোনা যায়, তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর মৃত্যুবরণ করেছেন। আসলে হারিছ চৌধুরী জীবিত নাকি মৃত, তা সিলেটের মানুষের কাছে আজও রহস্য।

সিলেট-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে হারিছ চৌধুরীর খোঁজ নেই। কোথায় আছেন, সেটা কেউ বলতে পারেন না। তার যারা আত্মীয়-স্বজন আছেন, তারাও কোনো খোঁজ জানেন না। অথবা তারা জানলেও হয়তো বলেন না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ২০১০-১২ সাল পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষনেতাদের সঙ্গে হারিছ চৌধুরীর যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এরপর বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বলে আমি জানি।

কায়কোবাদ কুমিল্লা-৩ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন

আর রাজনীতি নয় মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ। তিনি ২০১৪ সালের পর থেকে আইনের চোখে পলাতক। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। মামলার অভিযোগপত্রে তাকে পলাতক দেখানো হয়েছে।

কায়কোবাদ কুমিল্লা-৩ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। রাজনীতি শুরু জাতীয় পার্টির মাধ্যমে। ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান তার ভাই কে এম মজিবুল হক

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তিনি অধিকাংশ সময় সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থান করেন। মাঝেমধ্যে দুবাইতেও আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। তবে, কায়কোবাদ দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।

কায়কোবাদ কুমিল্লা-৩ আসনে তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। রাজনীতি শুরু জাতীয় পার্টির মাধ্যমে। ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান তার ভাই কে এম মজিবুল হক।

কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য আতিকুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তার কোনো তথ্য নেই। তিনি কোথায় আছেন, সেটাও জানি না।’

আমাদের কাছে তার কোনো তথ্য নেই। তিনি কোথায় আছেন, সেটাও জানি না

আতিকুল আলম, সদস্য, কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপি

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থানীয় এক নেতা বলেন, তিনি অধিকাংশ সময় মদিনায় থাকেন। এছাড়া তার দুবাইয়ে আসা-যাওয়া রয়েছে। তবে, শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আগামীতে স্থানীয় রাজনীতিতে তার ফেরারও সম্ভাবনা নেই। এ কারণে গত নির্বাচনে তার ভাইকে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রামের বাড়িতে তার মেয়েদের আসা-যাওয়া আছে। তারা দেশেও থাকেন, বিদেশেও থাকেন।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, কায়কোবাদের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে।

মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে দেশ ছাড়েন ওসমান ফারুক 

২০১৬ সালের পর আর দেশে আসেননি ওসমান ফারুক

মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাড়ি দেন বিএনপির আরেক নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক। ২০১৬ সালের ৪ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালে ওসমান ফারুক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ওই সময় পাকিস্তান আর্মিকে সহযোগিতা করেছেন এমন ১১ শিক্ষকের নামসহ একটি কাগজ আমাদের হাতে এসেছে। সেখানে ওসমান ফারুকের নামও রয়েছে। তারা স্বাধীনতাবিরোধী। তবে ঠিক কী করেছেন, তার কোনো উল্লেখ নেই।’ এরপর থেকে দেশ ছাড়েন তিনি।

মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠলে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে পাড়ি দেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুক

এ প্রসঙ্গে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে রয়েছেন। তার বাসা সেখানেই বলে আমি জানি। তিনি তো ২০১৬ সালে দেশ ছাড়ার পর আর আসেননি।’

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে রয়েছেন। তার বাসা সেখানেই বলে আমি জানি। তিনি তো ২০১৬ সালে দেশ ছাড়ার পর আর আসেননি

ফজলুর রহমান, সভাপতি, কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি

বিএনপির তিন নেতার আত্মগোপন প্রসঙ্গে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ সরকারের আমলে অপরাধ না করেও অনেকে জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন এবং করছেন। অনেকে দেশ ছেড়ে গেছেন। শুধু বিএনপির নেতারা দেশ ছেড়েছেন, এমনও নয়। রাজনীতি করেন না, এমন অনেক মানুষও সরকারের রোষানলে দেশত্যাগ করেছেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে সবাই দেশে ফিরবেন।’

এএইচআর/এসএম/এমএআর