দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে চলমান আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেই এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ওই এলাকায় অন্যকোনো প্রার্থীকে দাঁড়াতে বা ঢুকতে দেওয়া হয়নি— এমন অভিযোগ এনে রিট করলেও তা আমলে না নিয়ে ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। 

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের সব প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। সেখানে চেয়ারম্যান হন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সেলিম খান।

এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে চেয়ারম্যান পদে মোট ছয়টি ফরম নিয়েছিলেন প্রার্থীরা। এর মধ্যে চারজনই আওয়ামী লীগের। এছাড়া সদস্যরা একটি করে ফরম নিলেও একটি ওয়ার্ডে একাধিক ফরম তোলা হয়। কিন্তু পরে আমাকে এক প্রার্থী জানান, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার আত্মীয়, তাই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। এর বাইরেও আমি সব প্রার্থীকে ফোন দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো অভিযোগ করেননি।’

প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার আত্মীয়, তাই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না। এর বাইরেও আমি সব প্রার্থীকে ফোন দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো অভিযোগ করেননি

দেলোয়ার হোসেন, নির্বাচন কর্মকর্তা, সদর উপজেলা, চাঁদপুর

‘কেউ অভিযোগ না করলে আমি তো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি’— বলেন ওই নির্বাচন কর্মকর্তা।

চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩ ফেব্রুয়ারি। যাচাই-বাছাই হয় ৪ ফেব্রুয়ারি।

এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. সেলিম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করল কি করল না, এটা তাদের জিজ্ঞাসা করেন। আপনি ভালো থাকেন। আমি আর বেশিকিছু বলতে পারব না।’ এরপর তিনি ফোন কেটে দেন।

এ প্রসঙ্গে শনিবার (৬ মার্চ) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইলেকশন থেকে সিলেকশনের পথে হাঁটছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপির নির্বাচন নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশিদ আলম খান একটি রিট করেছিলেন। কিন্তু কোর্ট কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।’

নির্বাচনে কেউ অংশগ্রহণ করল কি করল না, এটা তাদের জিজ্ঞাসা করেন। আপনি ভালো থাকেন। আমি আর কিছু বলতে পারব না

মো. সেলিম খান, নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান, লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন

‘অভিযোগ ছিল, এলাকায় কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে সবাই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। পরবর্তীতে যখন গেজেট হবে তখন আপত্তি জানানো হয়। আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট বলেছে, নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয় হলে ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। এটা কোর্ট টু কোর্ট ভেরি করে, অনেক কোর্ট হস্তক্ষেপ করে, আবার অনেক কোর্ট করে না।’

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের যে মডেল হচ্ছে, আইনের দৃষ্টিতে এটা কীভাবে পর্যালোচনা করবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘হয়তো ওই এলাকার জনগণ চিন্তা করছেন যে, নির্বাচন হলে হানাহানি, মারামারি, অনেক লোক মারা যাবে। তাই কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। এটাও একধরনের চিন্তা হতে পারে। কারণ নির্বাচন মানেই তো এখন হানাহানি। হানাহানি বন্ধের যে হাতিয়ার ইসির কাছে আছে, সেই হাতিয়ার তারা ব্যবহার করেন না। শুধু এ নির্বাচন নয়, তারা কোনো নির্বাচনেই হাতিয়ার ব্যবহার করেন না।’

‘বিদ্যমান আইনে তাদের যে বিশাল ক্ষমতা আছে, এটা তারা ব্যবহার করতে শেখেননি। ফলে সব নির্বাচনই এখন ইচ্ছার ওপরে হয়ে যায়। কেউ নির্বাচনে যেতে পারবেন না, গেলেও ঘর থেকে বের হতে পারবেন না, ঘর থেকে বের হলেও ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হবে— এগুলো এখন স্বাভাবিক ঘটনা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা মোটামুটি অকার্যকরের জন্য যা যা দরকার সবই করা হচ্ছে।’

ক্ষমতা উনাদের (ইসি) আছে। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহার না করে পকেটে রেখে দিলে তো কোনো লাভ নাই। এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মাত্রাটা আরও বাড়বে। এক বছর পর এটা তিনগুণ হয়ে যাবে

মনজিল মোরসেদ, আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটা আইনের পরিপন্থী কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘গণতন্ত্র বাদ দেন, শুধু উনাদের (ইসি) হাতে যে আইনটা আছে, সেই আইনেরও পরিপন্থী। কারণ, আপনি একটা এলাকায় নির্বাচন করবেন, সেখানে প্রার্থীরা যদি যেতে না পারেন, সেটা নির্বাচন কমিশনকে জানালে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবেন। অথবা যে বাধা দিচ্ছে তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারেন। এই ক্ষমতা আইনে আছে। অথবা কমিশন বলে দিতে পারেন, তোমার এলাকার নির্বাচন স্থগিত করে দিলাম। কারণ, যারা নির্বাচন করছে তারা তো দাঁড়াতে পারছে না। এসব ক্ষমতা উনাদের (ইসি) আছে। কিন্তু ক্ষমতা ব্যবহার না করে পকেটে রেখে দিলে তো কোনো লাভ নাই। এই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মাত্রাটা আরও বাড়বে। এক বছর পর এটা তিনগুণ হয়ে যাবে।’

‘এখন যে অবস্থা হয়েছে তাতে প্রতি বছর নির্বাচন পরিচালনার জন্য শত শত কোটি টাকার বরাদ্দ না দিয়ে লটারির সিস্টেম করে দিলেই ভালো। অর্থের অপচয় হবে না।’

ইসিসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এর আগেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি, পৌরসভায় নির্বাচিত হওয়ার নজির রয়েছে। নোয়াখালী, ফেনীর দিকে এরকম ঘটনা গতবার হয়েছিল।

আমি মিডিয়ায় দেখেছি, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সমালোচনা করায় সিইসি (কে এম নুরুল হুদা) তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং বাড়ছে। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি করছে বর্তমান কমিশন

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার যুগ্ম সচিব ফরহাদ আহম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবাই নির্বাচিত হয়েছেন— এমন বিষয়ে আমাদের জায়গা থেকে কিছুই করার নেই। কারণ কমিশন যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার পর আমরা সেটা বাস্তবায়ন করি। কোনো কিছু করার থাকলে সেটা কমিশনই করতে পারে।’

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের হার বাড়ছে। আমি মিডিয়ায় দেখেছি, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সমালোচনা করায় সিইসি (কে এম নুরুল হুদা) তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে এবং বাড়ছে। সুতরাং নির্বাচন ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি করছে বর্তমান কমিশন।’

এসআর/এমএআর/