১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। গত দুই নির্বাচনে জোট গঠনসহ নানা নাটকীয়তায় সময় পার করলেও চলতি বছর আন্দোলন-সমাবেশের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলটি। বছরজুড়ে (২০২২ সাল) নানামাত্রিক কার্যক্রমে শীর্ষ নেতৃত্বশূন্য দলটির মধ্যে নতুনভাবে আশার সঞ্চার হয়েছে। ফাঁকে-ফাঁকে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করলেও শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তে দলকে তেমন একটা বিপাকে পড়তে হয়নি। উপরন্তু বছরের শেষ কয়েক মাসে রাজনৈতিকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নতুন প্রত্যাশা তৈরি করেছে দলটি।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপে বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিদায়ী বছরকে অনেকটা এভাবে মূল্যায়ন করেছেন।

২০২২ সালের প্রথম দিন ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা দিয়ে বিদায়ী বছরের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু বিএনপির। আগামী ৩০ ডিসেম্বর যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিল দিয়ে সেই যাত্রার সমাপ্তি করবে দলটি।

আরও পড়ুন >> ১০ ডিসেম্বর : কী খেলা হবে? 

বিদায়ী বছর পুরোটাই সাংগঠনিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও যুগপৎ আন্দোলনে আগ্রহী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে পার করে বিএনপি। দলটির এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা পেয়েছে ঢাকাসহ সারাদেশের ১০ বিভাগীয় সমাবেশ এবং যুগপৎ আন্দোলনের জন্য নতুন-পুরাতন সঙ্গীদের এক জায়গায় নিয়ে আসা।

শর্তবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশনা আর লন্ডনে নির্বাসিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের শারীরিক অনুপস্থিতিতে এসব কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্রে রেখে রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে ৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে উত্তরার বাসা থেকে মির্জা ফখরুলকে তুলে নেয় ডিবি পুলিশ। 

বিএনপির সিনিয়র নেতারা ঢাকা পোস্টকে জানান, মির্জা ফখরুল দলের চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে বিগত বছরগুলোতে বিএনপিকে এগিয়ে নিয়েছেন। চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রাক্কালে তার গ্রেপ্তার ছিল আকস্মিক। নেতারা তার অভাব অনুভব করেছেন। 

আরও পড়ুন >> বিএনপির রূপরেখা : ‘ইতিবাচক’ হলেও ‘সন্দিহান’ তারা

তবে, মির্জা ফখরুলের গ্রেপ্তারে দলের ভেতরে অভাব অনুভব হলেও প্রকাশ্যে নেতারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বিশেষত, একজন নেতার গ্রেপ্তারে তৈরি হওয়া শূন্যস্থান অন্য আরেকজনকে দিয়ে পূরণ করা এবং আন্দোলন চালিয়ে নিতে নেতৃত্বের নানা স্তর নির্ধারণ করে রেখেছে বিএনপি।

নেতারা জোর দিয়ে বলছেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বিএনপি আন্দোলনে আছে। কোনো নেতার গ্রেফতারে দলের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া থামিয়ে রাখা যাবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে আন্দোলন সফলভাবে চলছে। দেশের মানুষ এটা প্রমাণ করেছে। লাখ লাখ মানুষ ১০টা সমাবেশে সব বাধা উপেক্ষা করে এসেছে। সবকিছুই হচ্ছে তারেক রহমানের নেতৃত্বে। উনিই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং, আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। আন্দোলন চলছে।’

আরও পড়ুন >> নির্বাচনী বছরে উত্তপ্ত রাজনীতি ও অর্থনীতি

‘নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে আমরা যাব না। জনগণ ভোট দিয়ে একটি সরকার নির্বাচিত করবে। একটা সংসদ নির্বাচিত করবে। সেখানে বিএনপি যদি জয়ী হয়, তাহলে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের উপস্থিতি হবে খুবই স্বাভাবিক। এটা কেউ বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’

এদিকে, দলের বছরব্যাপী কর্মসূচি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদায়ী বছরে পরিকল্পিতভাবে নাগরিক দুর্ভোগের ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল বিএনপি। বন্যায় তহবিল গঠন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানী এবং সারাদেশে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। একইসঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির অভিযোগ এনে তার প্রচার করেছে বিএনপি। 

নেতারা মনে করেন, বিদায়ী বছরে বিএনপির রাজনৈতিক সফলতা হচ্ছে সরকারের নানা ধরনের ‘উসকানি’ সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণভাবে ১০টি সমাবেশ শেষ করা। ওই ১০ সমাবেশের মধ্যে কুমিল্লা ব্যতীত প্রতিটি বিভাগীয় সমাবেশ বানচালে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন বিএনপির নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।

আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ভাষ্য, ‘মানুষ এ সরকারকে আর এক দিনও ক্ষমতায় চায় না। চায় না বলেই বিএনপির ১০টি সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে প্রাণিত করেছে। বিএনপির সমাবেশে মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেল-নৌকা-স্পিডবোটে চড়ে যোগ দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি সমাবেশের নির্ধারিত তারিখের তিন দিন আগে সমাবেশস্থলে কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে। চিড়া-মুড়ি খেয়ে, রাস্তায় ঘুমিয়ে, হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে, এমনকি জীবন দিয়েও প্রতিটি সমাবেশ সফল করেছে তারা। দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতিতে এ রকম ঘটনা আর দেখা যায়নি। এটাই হচ্ছে বিএনপির স্পিরিট, গণমানুষের স্পিরিট।’

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে একাধিক বিএনপি নেতা উল্লেখ করেন, বিদায়ী বছরে বিএনপির রাজনৈতিক সাফল্য হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী সমমনা ২৩টি দলের সঙ্গে সংলাপ করে এক ছাতার নিচে আনা। যার ফল ইতোমধ্যে বিএনপি পেতে যাচ্ছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি গণমিছিলে যুগপৎভাবে রাস্তায় নামার ঘোষণা দিয়েছে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। এছাড়া বিদায়ী বছরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য তহবিল গঠন করে তাদের কাছে সাহায্য নিয়ে যাওয়াও একটি দলের জন্য সাফল্য।

আরও পড়ুন >> বিএনপি ঘরানার ‘১২ দলীয় জোটের’ আত্মপ্রকাশ

এ বিষয়ে চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং ও বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘২০২২ সালে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে। বিএনপি প্রতিটি ইস্যুতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে বিএনপিসহ অঙ্গ-সংগঠনের সাতজন শহীদ হন। এছাড়া বন্যায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মানুষের পাশে থেকেছে বিএনপি। এমনকি জনগণের অধিকার আদায়ে এখনও আন্দোলনরত দলটি। জনগণের বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এটি চলবেই।’

তবে, বিভাগীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে সারাদেশে নেতাকর্মীদের একনিষ্ঠতা, সাতজন নিহত এবং কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে বিএনপির আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে বলেও মনে করেন অনেক নেতা।

ছিল অস্থিরতাও

রাজনীতিতে বিদায়ী বছর সফলভাবে পার করার পাশাপাশি বিএনপির ভেতরে একটা আতঙ্কভাব ছিল। প্রবাসে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেওয়া কয়েকটি সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে দলের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা ছড়ায়। দল থেকে বহিষ্কার করা হয় কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কু, নারায়ণগঞ্জের তৈমুর আলম খন্দকারসহ অনেককে।

আরও পড়ুন >> দলাদলি নয় গলাগলি হোক 

চলতি বছরের ৮ আগস্ট কর্মসূচির ধরন নিয়ে বক্তব্য দিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ান মির্জা ফখরুল আর স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। পরবর্তীতে মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বরকে দলের বাইরে গিয়ে এমন বক্তব্য দেওয়ার কারণও জানতে চান তারেক রহমান। শুধু তা-ই নয়, দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ওই দুই নেতার বক্তব্য নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান মির্জা ফখরুল। যা নিয়ে দলের ভেতরে উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

বিএনপির নেতারা বলছেন, বিদায়ী বছরে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মির্জা ফখরুল দলকে যেমন সুসংঘটিত করেছেন, তেমনি রাজনীতিতেও দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের শারীরিক অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এছাড়া গত ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশি অভিযানের সময় অন্য নেতারা যখন নিরাপদে বাসায় অবস্থান করছিলেন তখন মির্জা ফখরুল সাড়ে চার ঘণ্টা কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

যদিও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য দাবি করেছেন, স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা সেদিন নয়াপল্টনে যেতে চাইলে বারণ করেন স্বয়ং মির্জা ফখরুল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি সিদ্ধান্ত জানাবেন— এমন পরামর্শও দেন অনেক নেতাকে। 

বিএনপি মহাসচিব প্রসঙ্গে কোনো-কোনো নেতার মন্তব্য, যুগপৎ আন্দোলনের ১০ দফা এবং বিএনপির রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা প্রস্তাব তৈরিতে সামনে থেকে কাজ করেছেন মির্জা ফখরুল। কিন্তু যখনই এ বিষয়গুলো জাতির সামনে তুলে ধরার সময় এলো তখনই তাকে আটক করা হলো।

আরও পড়ুন >> টানা দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, আইনসভায় উচ্চকক্ষ

স্থায়ী কমিটির এক নেতার ভাষ্য, বিএনপির মনোবল ভেঙে দিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একান্ত আগ্রহে বিএনপির মহাসচিবকে কারাগারে যেতে হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক এক সম্পাদক বলেন, ‘মির্জা ফখরুল অনেক দিন ধরে দলের মহাসচিব। দলে তার অবস্থান শক্ত। এটা বুঝেই সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে। দেশে আইনের শাসনে এত দুরবস্থা যে তাকে যে অপরাধে জেলে নেওয়া হয়েছে সেই ফৌজদারি কার্যবিধিতে তিনি জামিনের হকদার। কিন্তু জামিন দেওয়া হচ্ছে না। কাজেই তিনি কখন জামিন পাবেন, নিশ্চিত করে বলা যায় না। আইনের শাসন থাকলে তিনি আটক হতেন না, আর আটক হলেও জামিন পেতেন।’

বিএনপির বছরব্যাপী কার্যক্রম ও বিদায়ী বছর মূল্যায়ন করতে গিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত ১৫ বছর ধরে গণতন্ত্রহীন ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে কাটছে আমাদের জীবন। তারা দেশটাকে তো একটা জেলখানা বানিয়ে রেখেছে। বিগত বছরে বিএনপির অর্জন হলো মানুষের কাছে যেতে পারা। মানুষও আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে।

আরও পড়ুন >> আন্দোলনের ডামাডোলে থাকুক শান্তির বারতা 

‘রাজনৈতিকভাবে আমরা আগের থেকে সুসংগঠিত হতে পেরেছি। মানুষের দুর্ভোগের বিষয় নিয়ে রাস্তায় নেমেছি। একটি গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে যেভাবে আমরা রাস্তায় নামতে পারতাম, সেভাবে হয়তো পারিনি। এরপরও মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সারাদেশে আমাদের সাত নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে।’

মির্জা ফখরুলের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি একটা মুভমেন্টের গতি এনেছে এবং সেটার নেতৃত্ব দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই মুভমেন্ট থেকে সরকার তাকে সরিয়ে দিয়েছে। দেশে যে গণতন্ত্র নেই, একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের অধীনে আমরা আছি— এটা তারই প্রমাণ। বিএনপি একটা বিশাল দল। এখানে নেতৃত্বের কোনো শূন্যতা নেই। একজন না থাকলে আরেকজন দল পরিচালনা করবে। তবে, এটা ঠিক যে মির্জা ফখরুল যেভাবে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটার অভাব আমরা অনুভব করছি।’

এএইচআর/এমএআর/