ভালো কোনো পরামর্শ থাকলে নির্বাচন কমিশনকে তারা দিতে পারতেন। রাষ্ট্রপতিকেও তারা দিতে পারতেন। সেটা না করে তারা গণমাধ্যমে দিয়েছেন। এটা রাজনৈতিক প্রচার। উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা নয়। তাদের উদ্দেশ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করা...

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতির হাতেখড়ি। তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন রাজনীতির জাতীয় মঞ্চে। গড়ে তুলেছেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কৃষিবিদ হিসেবেও পরিচিত এ রাজনীতিক। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সহকারীও ছিলেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে টানা তিনবার সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলে থাকাকালীন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কারাভোগও করেছেন।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান, রোহিঙ্গা সংকট, ভূ-রাজনীতি এবং দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে। তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দেশের বিশিষ্ট ৪২ নাগরিকের অনাস্থা— এসব বিষয়ে আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমানউল্লাহ আমান

তারা যদি প্রকৃত অর্থেই আমাদের দেশের কল্যাণ চাইতেন তাহলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু তখন তারা প্রতিবাদ করেননি। এটা কি অন্যায় কাজ ছিল না

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানিয়েছেন। আপনি কি মনে করেন নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারছে?

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

বাহাউদ্দিন নাছিম : বেশ কিছুদিন ধরে আমরা দেখছি পত্রপত্রিকায় তারা রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচন কমিশনারকে বাদ দেওয়া, বহিষ্কার করা, নতুন নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এই সিভিল সোসাইটি বলেন, বুদ্ধিজীবী কিংবা বিশিষ্ট নাগরিক বলেন, তারা যদি প্রকৃত অর্থেই আমাদের দেশের কল্যাণ চাইতেন তাহলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনার প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু তখন তারা প্রতিবাদ করেননি। এটা কি অন্যায় কাজ ছিল না? মানুষকে খুন করার মতো জঘন্য অপরাধ, জাতির পিতাকে খুন করা, তার পরিবারের সদস্যদের খুন করা, সেই খুনিদের বিরুদ্ধে তারা কি কোনোদিন কথা বলেছেন? এখনই বা তারা কতজন কথা বলেন? ওই খুনিদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়। সেই সরকারের বিপক্ষে তারা কি কখনও কথা বলেছেন? বিএনপি-জিয়াউর রহমান-খালেদা জিয়া সরকারের বিপক্ষে কথা বলেছেন? ইনডেমনিটি অ্যাক্ট (দায়মুক্তি) যেটা জারি করেছিল তার চাইতে কালো আইন, কুখ্যাত আইন আর কী হতে পারে? সেই আইনের বিপক্ষে কথা বলেছেন কোনোদিন?

তারা নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ ও বিচারের জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে চান। এটা কী? তারা যদি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে, নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী দেখতে চাইতেন, তাহলে ভালো কোনো পরামর্শ থাকলে নির্বাচন কমিশনকে দিতে পারতেন। রাষ্ট্রপতিকেও তারা দিতে পারতেন। সেটা না করে তারা গণমাধ্যমে দিয়েছেন। এটা রাজনৈতিক প্রচার। উদ্দেশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা নয়। তাদের উদ্দেশ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করা। সরকারের ধারাবাহিকতা, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, জনকল্যাণমুখী কর্মকাণ্ড বিতর্কিত করা।

নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জয়ের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জনগণের সমর্থন আদায় করতে না পারলে সরকারে যাওয়া যাবে না, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া যাবে না। জনগণের কল্যাণে, জনগণের জন্য কর্মসূচি দিতে হবে

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

বিএনপি-জামায়াত যেমন সব কর্মকাণ্ডকে বিতর্কিত করতে চায়, এখন তাদের সহশক্তি হিসেবে বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্রপ্রধান একটি প্রতিষ্ঠানিক জায়গা। সর্বশেষ জায়গা রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত করার জন্য তারা কাজটি করেছেন। ইতিবাচক কোনো লক্ষ্য নিয়ে তারা এটি করছেন না। তাদের উদ্দেশ্য সবকিছুকে বাধাগ্রস্ত করা, নেতিবাচক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, বিতর্ক সৃষ্টি করা এবং এর ভেতর দিয়ে বিরাজনীতিকরণকে প্রতিষ্ঠা করা।

মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখছেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম

আমি মনে করি, তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। জনগণের সমর্থন বিএনপি-জামায়াত পায়নি, ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, জনগণের জন্য তারা কিছু করতে পারেনি।

ঢাকা পোস্ট : বিরোধীদের অভিযোগ দেশে গণতন্ত্র নেই, বাক স্বাধীনতাও নেই...

বাহাউদ্দিন নাছিম : মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছি। আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। সেনা ছাউনি থেকে গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনে অবরুদ্ধ, বন্দি গণতন্ত্রকে আমরা মুক্ত করেছি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।

এখন আমরা দেশের মানুষের ভোটের অধিকার ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। গণতান্ত্রিক অধিকার এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে জনগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকারের পরিবর্তন আনবে। জনগণ যাকে চাইবে, তিনিই দেশ পরিচালনা করবেন— এটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা জনগণের আস্থার জায়গা ফিরিয়ে আনতে চাই। আওয়ামী লীগের সবসময় শেষ ভরসার জায়গা জনগণ। জনগণই মূল শক্তি। জনগণ যাকে চাইবে না তিনি দেশ পরিচালনা থেকে দূরে সরে যাবেন। আমরা চাই, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আরও পরিশীলিত হবে, পরিমার্জিত হবে, আরও সুন্দর হবে। এটা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর হবে। এক্ষেত্রে সরকার, বিরোধী দল এবং সিভিল সোসাইটিকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে জনগণকে সংগঠিত করে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করা নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জয়ের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। জনগণের সমর্থন আদায় করতে না পারলে সরকারে যাওয়া যাবে না, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া যাবে না। জনগণের কল্যাণে, জনগণের জন্য কর্মসূচি দিতে হবে।

তারা চোরাগুপ্তা পথে অগণতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। বিদেশি প্রভুদের ওপর তারা নির্ভর করে। ক্ষমতায় আসার জন্য বিদেশি প্রভুদের কাছে ধর্না দেয়। অথচ জনগণের কাছে যায় না। জনগণের কাছেই তাদের ধর্না দেওয়া উচিত

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

বিশ্বাস-আস্থার জায়গায় তারা মানুষকে আনতে চায় না অথবা পারে না। কারণ তারা জনগণের সঙ্গে বারবার প্রতারণা করেছে। মিথ্যা আশ্বাস ও কথায় ভুল পথ দেখিয়েছে। দুর্নীতিতে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে হেয় করেছে। এ কারণেই তারা ধারণা করছে যে কোনোদিন সফল হতে পারবে না। তাই তারা চোরাগুপ্তা পথে অগণতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্ভর করে। বিদেশি প্রভুদের ওপর তারা নির্ভর করে। তাদের কাছে ধর্না দেয়। অথচ জনগণের কাছে যায় না। জনগণের কাছেই তাদের ধর্না দেওয়া উচিত।

ঢাকা পোস্টকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম

মানুষকে সম্পৃক্ত করেই গণঅভ্যুত্থান করা যায়। মানুষকে আশ্বাস দিতে হবে, বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করতে হবে। মানুষের ভরসার জায়গাটা যখন তৈরি হবে তখনই কিন্তু মানুষ তাদের ডাকে সাড়া দেবে। মানুষের সাড়া পাওয়ার জন্য তাদের কোনো প্রচেষ্টা নেই। তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তারা চান যেনতেন পন্থায় ক্ষমতায় যেতে। দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে চায়। উনারা চান সাম্প্রদায়িক শক্তির জাগরণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকুক বা না থাকুক, তাদের কিছু আসে যায় না। ক্ষমতাই তাদের কাছে মুখ্য।

তারা যদি ভালো কোনো কর্মসূচি দেয়, জনগণ যদি সেই কর্মসূচিতে সমর্থন দেয় তাহলে নির্বাচিত হবে। সরকারে আসবে। আমাদের তো এখানে দেখার কিছু নেই, বাধা দেওয়ারও কিছু নেই। আমরা তাদের স্বাগত জানাব

আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, আওয়ামী লীগ

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ব্যবহার করে, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তারা রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান চায় না। যারা জঙ্গিবাদী শক্তিকে পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, করতে চায়; সুযোগ পেলে তারা আবার সেই পথেই হাঁটবে। বাংলার শান্তিপ্রিয় মানুষ, হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান; আমরা একসঙ্গে মিলেমিশে আছি। এটা আওয়ামী লীগের দর্শন এবং জাতির পিতার আদর্শ। এ আদর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটা গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও কল্যাণমুখী বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। সেই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখনও কাজ করে যাচ্ছে এবং কাজ করে যাবে।

বাংলাদেশের লাখো-কোটি জনতা আওয়ামী লীগের এই নীতি ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আজ আমরা বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, সম্মানীত হয়েছি। এ সম্মান অব্যাহত থাকুক এবং আমরা এগিয়ে যাই— এটাই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা।

ঢাকা পোস্ট : অনেকেই বলেন, দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

বাহাউদ্দিন নাছিম : বিরোধী দলে যারা আছেন তারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। কিন্তু তারা কী করতে পারবেন বা অতীতে কী করেছেন সেটা নিয়ে ভাবেন না। অতীতের অপকর্মের জন্য তাদের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। তারা যদি ভালো কোনো কর্মসূচি দেয়, জনগণ যদি সেই কর্মসূচিতে সমর্থন দেয় তাহলে তারা নির্বাচিত হবে। সরকারে আসবে। আমাদের তো এখানে দেখার কিছু নেই, বাধা দেওয়ারও কিছু নেই। আমরা তাদের স্বাগত জানাব। কিন্তু তাদের সঠিক পথে হাঁটতে হবে। মানুষের বিশ্বাসের জায়গায় তাদের আসতে হবে। (চলবে...)

এইউএ/এমএআর/