‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’— জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার মতোই পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলছে নারী। কোথাও পিছিয়ে নেই তারা। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। দেশের বিচার বিভাগেও রয়েছে নারীদের দৃপ্ত পদচারণা। বিচারকার্যের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন তারা। 

দেশের অধস্তন আদালতে ৫৮০ জন নারী বিচারক কর্মরত রয়েছেন। উচ্চ আদালতে বর্তমানে সাতজন নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা সবাই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রায় দিয়ে দেশজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তারা। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিও হবেন নারী।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধস্তন আদালতের তুলনায় উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা একেবারেই কম। উচ্চ আদালতে অবিলম্বে কমপক্ষে আরও ১০ জন নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিচার বিভাগে নারীদের অবদান অনেক। নারীরা মায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিচারকের দায়িত্বও পালন করছেন। দেশের অধস্তন আদালতে প্রায় ১৬০০ বিচারকের মধ্যে ৫৮০ জনই নারী। এটা খুবই বড় সংখ্যা। কিন্তু উচ্চ আদালতে ১১০ বিচারপতির মধ্যে মাত্র সাতজন নারী। মাত্র পাঁচ পারসেন্টের মতো। আনুপাতিক হারে একেবারেই কম। আমার জানামতে অধস্তন আদালতে এখনই উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেওয়ার মতো ১০ জন নারী বিচারক রয়েছেন। আবার আইনজীবীদের মধ্যেও অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন নারী আছেন। সেখান থেকেও উচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।

বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, বিচার বিভাগকে নেতৃত্ব দেবেন নারীরা। কারণ, জুডিশিয়াল সার্ভিসের সব পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকেন নারীরা। আমি নারীদের নিয়ে অনেক আশাবাদী। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নারী প্রধান বিচারপতি পাবে— এটা আশা করতেই পারি।

উচ্চ আদালতের ৭ নারী বিচারপতি

বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী : বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরীর বাবা সাবেক বিচারপতি এ টি এম মাসুদ। ১৯৮১ সালের ২২ আগস্ট তিনি ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৮৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরে ১৯৯৬ সালের ১৪ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই বছর পর ২০০৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব : বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার আরও একটি পরিচয় তিনি সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মেয়ে।

আজিমপুর কবরস্থান রক্ষার রায়, ধর্ষণের শিকার নারীদের দ্রুত মামলা নেওয়ার বিষয়ে নীতিমালা করে রায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার রক্ষার রায়, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর ঘটনায় শিশু জিহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের রায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্যানেল শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণের রায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বাধ্যতামূলকের রায়সহ অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি।

বিচারপতি নাইমা হায়দার : সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর মেয়ে বিচারপতি নাইমা হায়দার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এছাড়া কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৮৯ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন নাইমা হায়দার। ১৯৯৩ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী এবং ২০০৪ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৯ সালের ৬ জুন তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০১১ সালের ৬ জুন হাইকোর্টের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি নাইমা হায়দার ‘মাকে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে স্বীকৃতি’, ‘কাবিননামায় কুমারি শব্দ বাতিল করে রায়’সহ অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইডের প্রথম নারী চেয়ারম্যানও তিনি।

বিচারপতি কাশেফা হোসেন : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মোহাম্মদ হোসেনের মেয়ে বিচারপতি কাশেফা হোসেন। তিনি ইংরেজি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া লন্ডনেও একই বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে জেলা আদালতে আইন পেশায় যোগ দেন।

২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন কাশেফা হোসেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট তিনি হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফাতেমা নজীব : নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ বেগম ফাতেমা নজীব ২০১৮ সালের ৩০ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২০ সালের ৮ জুন তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৯৮৪ সালে মুন্সেফ হিসেবে বিচার বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হংকং, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কাসহ বেশকিছু দেশ ভ্রমণ করেন।

বিচারপতি কাজী জিনাত হক : একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা বিচারপতি কাজী জিনাত হক। তিনি দুই মেয়াদে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কাজী জিনাত হক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।

বিচারপতি ফাহমিদা কাদের : নাটোরের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান ফাহমিদা কাদের কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৮১ সালে ঢাকার অগ্রণী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৩ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (সম্মান) ডিগ্রি নেন। তিনি আইন বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৯১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে সহকারী জজ (প্রবেশনার) হিসেবে যোগ দেন। বিচারক নিয়োগের ওই পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অর্জন করে নিজ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। সেখান থেকেই শুরু বিচারিক জীবনের পথ চলা।

সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর পরই ১৯৯৬ সালে প্রথম পদন্নোতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে কুমিল্লার আদালতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে চাঁদপুরে যোগ দেন। ২০০৪ সালে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালে সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় স্পেশাল জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত টাঙ্গাইলের জেলা জজ ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালন করার স্বীকৃতিস্বরূপ গত বছরের ৩১ জুলাই তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাকে এই নিয়োগ দেন। বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ওমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ফাহমিদা কাদেরের স্বামী মকবুল আহসান টিটো ছিলেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ। তিনি এখন অবসরে আছেন। এই দম্পতির তিন সন্তান। তারা পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি করছেন। ফাহমিদা কাদের ভারত, ইউএসএ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

এমএইচডি/এসএম