সায়লা ফারজানা / ছবি : ঢাকা পোস্ট

সায়লা ফারজানা। জন্ম গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বাটিকামারী গ্রামে। বিসিএস ১৭ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে চট্টগ্রামে সহকারী কমিশনার পদে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। পরে একাধিক জেলায় মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত।

এছাড়া সিভিল সার্ভিসে কর্মরত নারীদের সংগঠন ‘বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্ক’-এর মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তিনি ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন প্রশাসনে নারীদের বর্তমান অবস্থান, তাদের সফলতা ও প্রতিবন্ধকতার নানা অধ্যায়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক।

ঢাকা পোস্ট : আমরা নারীদের সমান অধিকারের কথা বলছি। সব জায়গায় সমান অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করা যাচ্ছে কি না?

সায়লা ফারজানা : যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নারী দিবস এলো, সেই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নারী শ্রমিকরা এক সময় বৈষম্যের শিকার ছিলেন। তাদের আন্দোলনের ফল হচ্ছে আজকের নারী দিবস। সেই শ্রমিক থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বে যেখানেই কর্মজীবী নারীরা রয়েছেন, তাদের প্রতি বৈষম্য দূর করাই নারী দিবসের মূল্য উদ্দেশ্য। নারীদের প্রতি বৈষম্যে কথা চিন্তা করেই দিনটির উদযাপন।

একজন নারীর অধিকারের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে তার সক্ষমতা থাকতে হবে। শুধু নারী বলেই যে পদ-পদবি দিতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। আমরা চাই নারীরা প্রথমেই বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশে কাজ করবে। আমরা এখন আর নারীর সমান অধিকার নিয়ে কথা বলছি না। আমি একজন মানুষ, একজন কর্মকর্তা; কর্মক্ষেত্রে সঠিক স্পেস পাওয়া আমার অধিকার। আমার সক্ষমতা বা দক্ষতা দিয়েই আমাকে বিচার করতে হবে। একজন পুরুষের সঙ্গে আমাকে তুলনা করছি না। এখানে তুলনা নয় বরং সক্ষমতা অনুযায়ী মূল্যায়ন বা বিচার করার প্রসঙ্গ। একজন নারী প্রথমে একজন মানুষ। এরপর একজন কর্মকর্তা। যার নিজস্ব শিক্ষা আছে, জ্ঞান আছে, দক্ষতা আছে, সক্ষমতা আছে; সেগুলো মূল্যায়ন করে পদায়ন করতে হবে।

সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যেন শুধু নারী বলেই তাকে পেছনে না রাখি। আমরা উইমেন নেটওয়ার্ক থেকেও এ বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছি। প্রতিটি নারী যোগ্যতা অনুযায়ী যাতে সঠিক কর্মপরিবেশ পায়, বিষয়টা নিশ্চিত করতে উইমেন নেটওয়ার্ক কাজ করছে। 

ঢাকা পোস্ট : মাঠ প্রশাসনের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন। সেখানে নারীদের অবস্থান খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার মূল্যায়ন... 

সায়লা ফারজানা : মাঠ প্রশাসনে নারীদের অবস্থান অনেক ভালো। বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলা একদম গ্রাম্য পর্যায়ের। কিন্তু সব জায়গায় একই সমস্যা বা সুবিধা থাকে না। বরগুনার একটি গ্রাম কিন্তু খাগড়াছড়ির একটি গ্রামের মতো এক হবে না। প্রত্যেকটা জায়গার ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট বা বৈশিষ্ট্য আছে, দরিদ্রতার একটি বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানে যদি কোনো রিসোর্স থাকে সেটারও ভিন্নতা আছে। আমি মাঠ প্রশাসনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, দুর্গম এলাকাগুলোতে যে সব সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা সেটা দ্রুত বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নিতে পারেন। একই সঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন।

কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একটু সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। সেটা ছেলে হোক কিংবা মেয়ে; তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এই সাপোর্ট একটু বেশি প্রয়োজন। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পুরুষের অবদান অনেক। আমাদের স্যাররা যদি আমাদের সাপোর্ট না দিতেন তবে আজ এখানে আসাটা আরও কঠিন হতো। আর যারা পেছনে নারীদের কথা বলে তারা সহজাতভাবে সমালোচনা করতে পছন্দ করেন। নারীদের অগ্রগতি পছন্দ করেন না। আমাদের আজকের এ অবস্থানের পেছনে পুরুষ সহকর্মীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারাই তো আমাদের এগিয়ে দিয়েছে। সংকটে পাশে থেকেছে। সাহস যুগিয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : আজকাল নারীরা উদ্যোক্তা হচ্ছেন; চাকরি, শিক্ষা ও রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছেন। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? 

সায়লা ফারজানা : মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের মূল অনুপ্রেরণা। প্রধানমন্ত্রীর আশীর্বাদ না থাকলে এত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক বা প্রিন্সিপাল দেখতে পেতেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর একটা নিজস্ব চাওয়া যে মেয়েরা সব ক্ষেত্রে কাজ করুক। সেই চাওয়া থেকেই আমরা আজ এ অবস্থানে এসেছি।

ঢাকা পোস্ট : সিভিল সার্ভিসে আসার পর নারী হিসেবে আপনার প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

সায়লা ফারজানা : পঁচিশ বছর আগের প্রশাসন আর এখনকার প্রশাসনের মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে অনেক। তখন স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষা ও চাকরিতে মেয়েদের শতকরা হার অনেক কম ছিল। এখন সে সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই সঙ্গে তখন যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সেটাও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে পরিবর্তন এসেছে। তবে, একজন নারী হিসেবে চাকরির শুরুতে আমি কখনও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি; পঁচিশ বছর পরেও না।

ঢাকা পোস্ট : সহকর্মীদের কটূক্তি বা প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন কি না?

সায়লা ফারজানা : এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে, অনেক নারী কর্মকর্তার কাছে শুনেছি যে তারা বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তাদের অভিজ্ঞতায় জানতে পেরেছি, বেশির ভাগ পুরুষ অভিযোগ করেন ‘মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে বসে সংসারের খবর নেয়। বারবার ফোন করে বাচ্চা খেয়েছে কি না, খাবার রান্না করেছে কি না, অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে সংসার নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন’। আমার সম্পর্কে হয়ত আমার সামনে কেউ কিছু বলেননি; কিন্তু পেছনে কেউ না কেউ বলেছেন।

তবে, এটাও সত্য যে আমাদের সংসারেরও খোঁজ নিতে হয়। একজন নারী, একজন কর্মকর্তা; সে তো একজন মাও। দুঃখ, কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি এবং দায়িত্ববোধ তো তারও আছে। এমন খোঁজ আমিও নেই। তবে, আমার কাজের ক্ষেত্রে সেটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। কোনো পুরুষ অফিসারের চেয়ে আমরা কোথাও কম কাজ করি না। আমরা খোঁজ নেই, আবার কাজটাও করি। আমাদের পুরুষ সহকর্মীরা আমাদের অলক্ষ্যে বলেন, 'এরা কাজ করে না। শুধু বাসায় ফোন করে স্বামী-সন্তান কী খেল, কী করল— সেগুলার খবর নেয়। তবে, আশার কথা হচ্ছে এ সংস্কৃতি এখন অনেক কমে আসছে।

ঢাকা পোস্ট : কর্মস্থলে নারীদের এগিয়ে নেওয়া এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোনো উদ্যোগ আছে কি না?

সায়লা ফারজানা : অবশ্যই আছে। আমাদের নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে যে তারা যদি কখনও কটু বাক্য, বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি, হেয় কিংবা হয়রানির শিকার হন তবে তা গোপন রাখতে চান। অনেকে আবার এ পরিবেশের সঙ্গেই মানিয়ে নিতে চান। আমি তাদের ব্যক্তিগতভাবে অনুপ্রাণিত করি যে এগুলো গোপন না রেখে শেয়ার করতে। শেয়ার করলে যিনি এসব করেন তিনি অন্তত দমে যাবেন। কর্মক্ষেত্রে কোনো পুরুষ বা নারী সহকর্মী যদি হেয় করেন, সঙ্গে সঙ্গে ঊর্ধ্বতন অফিসার, পিআর গ্রুপ কিংবা আমাদের জানানোর অনুরোধ করি। আমাদের উইমেন নেটওয়ার্ক থেকেও এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছি।

ঢাকা পোস্ট : প্রশাসনে পুরুষের তুলনায় নারীদের সংখ্যা এখনও কম। বিষয়টি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সায়লা ফারজানা : এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অনেক মেয়ে রয়েছেন যারা উচ্চশিক্ষা নিয়েও চাকরিতে আসছেন না। অপরদিকে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর কোনো পুরুষ কিন্তু চাকরি ছাড়া থাকতে চান না। সুতরাং নারী-পুরুষের শতকরা হার সমান হতে আরও সময় লাগবে।

ঢাকা পোস্ট : একজন নারী হিসেবে আজ আপনি সফল। এ সফলতার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?

সায়লা ফারজানা : আমি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন বাবা খুব অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। বিয়ের পর আমার স্বামী, প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। তার সহযোগিতা ছাড়া আমার এ পথ আসলেই বেশ কঠিন ছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি পাশে থেকেছেন। অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। ভেঙে পড়ার সময়গুলোতে এই মানুষটা আগলে রেখেছেন। শিখিয়েছেন ‘অন্ধকারের পরেই আসে অবারিত আলো’।

ঢাকা পোস্ট : বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের কাজের পরিধি সম্পর্কে জানতে চাই...

সায়লা ফারজানা : আমরা ২০১০ সালে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করি। গত ১২ বছরের প্রাপ্তি অনেক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজের পরিধিও বেড়েছে। ২৬টি ক্যাডার থেকে সব নারী কর্মকর্তা সম্পৃক্ত হচ্ছেন। প্রতিটি ক্যাডারের সঙ্গে আমাদের আন্তঃক্যাডার সম্পর্ক আরও বেড়েছে। এটা বড় অর্জন। এখন ফিশারিজ বা লাইভস্টক ক্যাডারে কর্মরত কোনো নারী কর্মকর্তা যদি বিপদে পড়েন, আমরা তাৎক্ষণিক সেটা জানতে পারছি। তাদের পাশে থাকতে পারছি।

ক্যাডার সার্ভিসের অনেক নারী কর্মকর্তা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও তাদের অসুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারছেন; সমাধান পাচ্ছেন। তারা ঢাকাতে আসতে না পারলেও আমরা তাদের হেল্প করছি। আগের চেয়ে আমাদের বন্ধন এখন আরও বেশি মজবুত। এছাড়া সংগঠনটির নির্বাহী কমিটিতে আমরা যারা কাজ করছি তারাও বেশ অ্যাকটিভ এবং রেসপনসিভ। নারীদের উন্নয়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উইমেন নেটওয়ার্ক সবসময় কাজ করে যাচ্ছে।

এছাড়া যদি কোনো মেয়ে প্রতিবন্ধক পরিবেশে কাজ করে এবং সামগ্রিক বিষয়টি নিজে মানিয়ে নিতে না পারে সেক্ষেত্রে উইমেন নেটওয়ার্কে জানালে আমরা তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিই। প্রয়োজন হলে তার অথরিটির সঙ্গে কথা বলি এবং তাদের পাশে থাকি। মাঠ প্রশাসন হোক বা সচিবালয়; যেখানেই নারীরা কাজ করুক তাদের অতিরিক্ত একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। যেটা ছেলেদের থাকে না। আমি তো বলতেই পারি, মা হওয়া একটা চ্যালেঞ্জের কাজ। মা হওয়ার পর বাচ্চা লালনপালন করা আরেকটি চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সংসার সামলানোও একটি চ্যালেঞ্জ। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং পৃথিবীর উন্নত সব দেশেও নারীদের এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুতরাং এ চ্যালেঞ্জ সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে তাদের কাজে কোনো ঘাটতি না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এ জায়গাটি নিয়েও উইমেন নেটওয়ার্ক কাজ করছে।

ঢাকা পোস্ট : নারী দিবসে শ্রমজীবী সাধারণ নারীদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে?

সায়লা ফারজানা : যে সব নারী সমাজে এখনও কিছুটা পিছিয়ে আছেন, তাদের মধ্যেও অনেক সুপ্ত সম্ভাবনা থাকে। তারা একা একা হয়ত সবকিছু করতে পারেন না। হাত ধরে পথ দেখানোর অন্তত একটা লোকের প্রয়োজন হয়। সাহস দেওয়ার লোকের প্রয়োজন হয়। একজন মেনটর বা লিডার প্রয়োজন হয়। সমাজে এখনও এসব লোকের অভাব রয়েছে। জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় দেখেছি, গ্রামের অল্প শিক্ষিত বা যে শিক্ষা গ্রহণ করেননি, এমন মেয়েদেরও সুযোগ দিলে ভালো কিছু করতে পারেন। তাদের এগিয়ে নিয়ে আসতে উদ্যোগ নিতে হবে। কাজের সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া সমাজে বা প্রতিটি গ্রাম-মহল্লায় নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের জন্য এখনও অনেক কাজ করার আছে। এগুলো করতে পারলে সফলতার জায়গাটা আরও সমৃদ্ধ হবে।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

সায়লা ফারজানা : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা।

এমএম/এসএম