গত ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের তুলনায় কম তাপমাত্রার পরও বিপর্যস্ত রাজধানী ঢাকার জনজীবন। এর ধারাবাহিকতায় গত ১৫ এপ্রিল ৫৮ বছর আগের রেকর্ডও ভেঙেছে তাপমাত্রা। এ অবস্থায় ঠোঁট ফাটা, শরীর জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যায় ভুগছে মানুষ। একই সঙ্গে ‘হিট স্ট্রোক’ বাড়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন চিকিৎসক ও আবহাওয়াবিদরা।

তারা বলছেন, সম্প্রতি ভারতের মুম্বাইয়ে ৩৮ ডিগ্রির তাপমাত্রার মধ্যে একটি অনুষ্ঠানে হিট স্ট্রোকে ১১ জন মারা গেছেন। ঢাকায় গত এক সপ্তাহে গড়ে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অনুভূত হচ্ছে। এর মধ্যে জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নামতে হচ্ছে লাখো মানুষকে। এতে ‘হিট স্ট্রোকের’ শঙ্কা বাড়াচ্ছে চলমান তাপমাত্রা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন, স্থাপনা, যানবাহন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের সঙ্গে নানা রকম দূষণ, বায়ু, মিথেন, পানি, নদী ও জলাশয় ভরাট করার ফলে শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হচ্ছে।  অবাধে গাছপালা কেটে ফেলা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে নগরায়ণের জন্য কাঠামো ও স্থাপনা তৈরি ক্রমশ শহরাঞ্চলগুলোকে এক একটি তাপীয় দ্বীপের ‘হিট বোম্ব’-এ পরিণত করছে। মূলত ভবন, কংক্রিট, পিচ ও মানুষের কর্মের কারণে শহরগুলোতে তাপমাত্রা গ্রামের তুলনায় উচ্চতর হচ্ছে। এ তাপ বৃদ্ধির ফলে এক-একটি শহর ‘তাপীয় দ্বীপ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

ছাতা ছাড়া বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই, জনজীবনে অস্বস্তি (সংগৃহীত)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলমান তাপদাহে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ঠোঁট ফাটাসহ চামড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। অনেক রোগী এসেছে যারা গরম সহ্য করতে না পেরে অবচেতন হয়ে যায়। এদের মধ্যে অনেকেই মাইনোর ‘হিট স্ট্রোক’ করেছে।

এ চিকিৎসকের মতে, এ ধরনের তাপমাত্রা টানা ১৫ দিনের বেশি থাকলে হিট স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়ে যায়।

আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছে, আগামী অগাস্টেও একই ধরনের তাপপ্রবাহ দেশজুড়ে বয়ে যেতে পারে। চলতি বছর দুইবার দাবদাহের মুখোমুখি হতে হবে দেশের মানুষকে।

তবে আগামী বছরগুলোতে এ ধরনের তাপপ্রবাহ মাসব্যাপী চলার ইঙ্গিত দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। এতে হিট স্ট্রোকের সংখ্যা বাড়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা।

পরিবেশবিদ ও গবেষক ড. আতিক রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানী যেসব এলাকায় সবুজ বেষ্টনী ও জলাশয় আছে সেসব এলাকায় দৃশ্যমান তাপমাত্রার পরিবর্তন অনুভব করা যায়। এটা বুঝার জন্য গবেষণা প্রয়োজন নেই।

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, শাহবাগ মোড় থেকে ঠিক দুই বা তিনশ মিটার ভিতরে জাতীয় জাদুঘর। সেখানে গেলেই তাপমাত্রা ২-৩ ডিগ্রির কম অনুভব হয়। শীতের বাতাসে বুঝার উপায় নেই শহরে অন্যান্য জায়গায় কি চলছে। একই দৃশ্য দেখবেন যখন ক্যান্টনম্যান্টের ভিতরে ঢুকবেন। তাই এটা স্পষ্ট শহরে সবুজ বেষ্টনী বাড়ালে তাপমাত্রা সহনীয় থাকবে।

রাজধানীর মধ্যেই তাপমাত্রার ব্যবধান ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস

ইউনাইটেড স্টেট ইনভারমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) এক প্রতিবেদনে বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশ যেমন- বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকায় গত দুই দশকে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে শহরের তাপমাত্রা গ্রামের চেয়ে ২-৪ ডিগ্রি বেশি অনুভূত হয়। এর অন্যতম কারণ শহরগুলোতে জলাশয় ভরাট, গাছপালা কেটে বহুতল ভবন, রাস্তা এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ।

তাপপ্রবাহে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ (সংগৃহীত)

জলাশয় ও গাছ আছে এমন এলাকা এবং বিপরীত এলাকার তাপমাত্রা সংগ্রহ করে সংস্থাটি দেখেছে, একই শহরের মধ্যে গাছপালা জলাশয় আছে এমন জায়গা থেকে জলাশয়বিহীন এলাকায় তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি বেশি থাকে। সেটি গ্রামের সঙ্গে তুলনা করলে এলাকাভেদে ৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি থাকে।

তাদের গবেষণায় আরও দেখা গেছে, তীব্র তাপদাহে গাছের পাতা থেকে পানি সঞ্চার করে এবং ভূপৃষ্ঠের জলকে বাষ্পীভূত করে বাতাসকে শীতল করে। শহর এলাকায় শক্ত, শুষ্ক পৃষ্ঠ যেমন- ছাদ, ফুটপাত, রাস্তা, ভবন এবং পার্কিং লট-প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের তুলনায় সময়ভেদে ২ থেকে আড়াই ডিগ্রি বেশি আর্দ্রতা থাকে।

ইপিএ গবেষণা আরও বলছে, তাপ দ্বীপের প্রভাবে শহরাঞ্চলে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ২ থেকে ৫ ফারেনহাইট এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় ডিগ্রি ১ থেকে ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট বেশি অনুভূত হয়। আর্দ্র অঞ্চল, বৃহত্তর ও ঘন জনসংখ্যার শহরগুলোতে সর্বাধিক তাপমাত্রার পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ও আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীকে কংক্রিটের শহর বানানো হয়েছে। এর ফলে কী ধরনের পরিস্থিতি হচ্ছে এখনের পরিবেশই তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

তিনি বলেন, তাপদাহে অতিষ্ঠ মানুষ গরম থেকে বাচঁতে এয়ার কন্ডিশন ব্যবহার করছে। এই এয়ার কন্ডিশনগুলো পাশের বাসায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার মানে এখানেও তাপমাত্রার বৈষম্য। এটার একমাত্র সমাধান শহরে সবুজায়ন ও জলশয়গুলোকে রক্ষা করা। যেগুলো ভরাট হয়েছে সেগুলো উদ্ধার করতে হবে।

রাজধানী ও গ্রামের তাপমাত্রার একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা আরও তীব্র হবে

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুধু এ বছর নয়, গত এক দশকে ধীরে ধীরে রাজধানী ও গ্রামের তাপমাত্রার একটা বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা আরও তীব্র হবে।

তিনি বলেন, শহরের মধ্যে ভবন নির্মাণের সময় মাঝখানে কোন গ্যাপ রাখা হয় না। ফলে ভবনের মাঝখানে বায়ু প্রবাহ চলাচল করতে পারে না।

খোঁজ মিলছে না ১০ শতাংশও ফাঁকা জায়গার

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, একটি আদর্শ শহরের জন্য কমপক্ষে ৪০ শতাংশ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু রাজধানীতে ১০ শতাংশ জায়গা ছাড়ার প্রমাণ পায়নি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা। একটি নগরায়ণে ২৫ ভাগ সবুজ এবং ১৫ ভাগ ওয়াটার বডি (জলাশয়) সহমোট ৪০ ভাগ জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু ২০২০ সালে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার মোট ভূমির শতকরা ৮২ ভাগ কংক্রিটে আচ্ছাদিত। আর জলাশয় তো নেই বললেই চলে।

চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি বিপাকে খেটে খাওয়া মানুষ (সংগৃহীত)

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় বেশি গরম অনুভূতের অন্যতম কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও স্থানীয় দূষণগুলো। সবুজ ও ওয়াটার বডি থাকলে তিন-চার ডিগ্রি তাপ কমে যেত।

জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন নীতিমালায় ভবনের সামনে ২৫ ফুট রাস্তা ও ভবনের চারপাশে ২৫ শতাংশ ছাড়ার পর রাজউকের অনুমতি মিলছে। কিন্তু রাজউকের অনুমতি ছাড়া যেসব ভবন নির্মাণ হচ্ছে সেগুলোতে এক ফুট কখনও একই দেয়ালে দুই ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব ভবন এক ধরনের জ্বলন্ত বাম্প হয়ে থাকে।

৩৫ বছরে জলাশয় কমেছে ৩৪ ভাগ

ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) সমীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৮৫ থেকে এ পর্যন্ত ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল হারিয়ে গেছে। জলাশয় ভরাটের এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকায় জলাশয় ও এমন ভূমির পরিমাণ মোট আয়তনের ১০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, সারাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৪২ হাজার একর জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। আর শুধু ঢাকা শহরের দুই সিটি করপোরেশন এলাকা থেকেই বছরে গড়ে ৫ হাজার ৭৫৭ একর জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৯ হাজার ৫৫৬ একরের মধ্যে ভরাট হয়েছে ৩ হাজার ৪৮৩ একর। পাশাপাশি ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১০-এর মধ্যে এক লাখ ৯৩৭ একরের মধ্যে ২২ হাজার ৫১৬ একর জলাশয় ভরাট হয়ে গেছে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আকরামুল হক বলেন, পুকুর যে কত প্রয়োজনীয় তার প্রমাণ মিলেছে বঙ্গবাজার ও নিউ মার্কেটের আগুনে। এছাড়া জলাশয় না থাকা দেশের উপর চলা তাপদাহ বাড়ার অন্যতম কারণ। ভূপৃষ্ঠের জলকে বাষ্পীভূত করে বাতাসকে শীতল করার জন্য যে পরিমাণ জলাশয় প্রয়োজন তা রাজধানীতে নেই।

ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীতে তাপমাত্রা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন। এসব ভবনগুলো কাঁচে আচ্ছাদিত। সঙ্গে উচ্চমাত্রা এয়ারকন্ডিশন লাগানো। এগুলো উল্টো তাপ উৎপাদন করে। আবার যেসব নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয় তাও তাপ উৎপাদন করে।

৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি বলা হলেও অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি বলা হলেও অনুভব হচ্ছে আরও বেশি। অঞ্চলভেদে তাপমাত্রা বাস্তবের চেয়ে ৬-৭ ডিগ্রি বেশি অনুভব করছে মানুষ। দীর্ঘদিনের বৃষ্টি শূন্যতা ও মেঘমুক্ত আকাশে সূর্য সরাসরি কিরণ দিচ্ছে। ফলে দেশের বাইরে থেকে ধেয়ে আসছে লু হাওয়া। এসব কারণে তৈরি হয়েছে এমন পরিস্থিতি।

এ বিষয়ে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকায় ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা হলেও বাস্তবে এটি অনুভব হচ্ছে আরও ৬-৭ ডিগ্রি বেশি। এ কারণে স্যাঁতসেঁতে শরীরে অস্বস্তিকর গরম অনুভূতি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, তাপপ্রবাহের দুটি রূপ আছে। একটি হচ্ছে- শুষ্ক অবস্থা, আরেকটি হলো- আর্দ্র পরিস্থিতি। বর্তমানে আর্দ্রতা কম হচ্ছে। এ কারণে ঠোঁট শুকিয়ে যাওয়াসহ শরীরের চামড়া পুড়ছে বলে মনে হচ্ছে।

এনএম/এমজে