দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাও সংকুচিত হচ্ছে, বলছেন অনেকে

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ায় এ সংঘাত-সংঘর্ষ! এতে একদিকে দলীয় কোন্দল বাড়ায় দুর্বল হয়ে পড়ছে তৃণমূল, অন্যদিকে খর্ব হচ্ছে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা— মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, দলীয় প্রতীকে প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন দলের অনুগ্রহে। এখানে দলের স্বার্থের পাশাপাশি রয়েছে নিজেদের স্বার্থও। ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা প্রতিষ্ঠান, এলাকা বা জনগণের স্বার্থ খুব কমই দেখছেন।

সংঘর্ষের সার্বিক চিত্র

গত ১৯ মার্চ বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্যপ্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেনের সভায় হামলা চালান বর্তমান ইউপি সদস্য ডালিমের সমর্থকরা। এতে চার নারীসহ ২২ জন আহত হন। সংঘর্ষের এমন চিত্র যেন সর্বত্রই।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশের চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নের মধ্যে ছয় ধাপে তিন হাজার ৯০৫টির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব নির্বাচনে সহিংসতায় ৪১ জন নিহত হন। আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকার প্রার্থী হিসেবে দুই হাজার ২৪২ জন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিএনপির মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী ৩০৫ জন চেয়ারম্যান হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এক হাজার ৩৭৬ জন।

স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংঘাতের একটি খণ্ডচিত্র

তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতায় ১০৮ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ। ওই নির্বাচনে ২০০ জনের বেশি প্রার্থী চেয়ারম্যান হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তাদের অধিকাংশই সরকারি দলের মনোনীত।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এখন সরকারি দলের মনোনয়ন পাওয়া মানে নির্বাচিত হওয়া। এ কারণেই এখন সরকারি দলের মধ্যে বেশি কোন্দল, হানাহানি। বিএনপি নির্বাচনের মাঠে না থাকলেও তাদের কিছু লোক তো থাকবেই। আগামী নির্বাচনে সহিংসতা হবে না— এটা বলা যাবে না। দলের মধ্যে তো হবেই, দলের বাইরেও হতে পারে।

যদি যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত না হন তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা অবদান রাখতে পারেন না। এখন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন দলের অনুগ্রহে, দলের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং নিজেদের স্বার্থে। তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ, এলাকার স্বার্থ, এমনকি জনগণের স্বার্থ কমই দেখেন

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান মনোনয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রার্থীর মানের অবনতি ঘটেছে। মনোনয়ন বাণিজ্য হচ্ছে। প্রভাব খাটানো হচ্ছে। ফলে সঠিক ব্যক্তিরা অনেক সময় মনোনয়ন পাচ্ছেন না। যদি যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত না হন তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তারা অবদান রাখতে পারেন না। এখন প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হচ্ছেন দলের অনুগ্রহে, দলের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং নিজেদের স্বার্থে। তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ, এলাকার স্বার্থ, এমনকি জনগণের স্বার্থ কমই দেখেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা সমাজসেবামূলক কাজ করেন তারা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হতেন। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরু হওয়ার পর তারা এখন ঝামেলায় যেতে চান না। দলীয়ভাবে যারা মনোনয়ন পান, তারা নির্বাচিত হয়েই গেছেন বলে মনে করেন। তাই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কাউকে তিনি দাঁড়াতে দিতে চান না। ফলে সংঘর্ষের সংখ্যা বাড়ছে।’

দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। দলীয় লোকজনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাও সংকুচিত হয়ে যায়

ড. মো. শামসুল আলম, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

তিনি আরও বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত হওয়ায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। দলীয় লোকজনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি তখন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতাও সংকুচিত হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো ওপেন (উন্মুক্ত) করে দেওয়া উচিত। সংঘর্ষ তখন কমে আসবে।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে, বলছেন বিশ্লেষকরা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হচ্ছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও সব পঞ্চায়েত নির্বাচন দলীয়ভাবে হয়। এটা হলে দলের নিবেদিত প্রাণ হিসেবে যারা কাজ করেন, তারা মানুষের জন্য কিছু করার সুযোগ পান।

এখানে তো এমপির মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা (এমপিরা) পছন্দের বা যোগ্য তিন/চারজন প্রার্থীর নাম পাঠাবেন আমাদের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডে। সেখানে আমাদের মাননীয় নেত্রীই দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন

কাজী জাফরুল্লাহ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ

‘এক্ষেত্রে সংসদ সদস্য (এমপি), মন্ত্রীদের কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকেন, তিনি কাকে সমর্থন দেবেন? কিন্তু এখানে তো এমপির মনোনয়ন দেওয়ার সুযোগ নেই। তারা (এমপিরা) পছন্দের বা যোগ্য তিন/চারজন প্রার্থীর নাম পাঠাবেন আমাদের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডে। সেখানে আমাদের মাননীয় নেত্রীই দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন’— যোগ করেন জাফরুল্লাহ।

এইউএ/এসএসএইচ/এমএআর/এমএইচএস