বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে রেল খাতের সার্বিক উন্নয়ন…

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর বছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে শেখ মুজিবুর রহমান সেতুসহ বড় সব প্রকল্পের কাজে গতি এসেছে। করোনা প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ জোর দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে ছিল অবহেলিত। গত এক দশক ধরে রেলে অব্যাহতভাবে বাড়ছে বিনিয়োগ। বর্তমানে রেলে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪১টি প্রকল্পের কাজ চলছে। সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার এখন পর্যন্ত ৮৯টি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৯টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রেলকে নিয়ে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয় ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর। এ খাতে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

গত এক দশক ধরে রেলে অব্যাহতভাবে বাড়ছে বিনিয়োগ। বর্তমানে রেলে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪১টি প্রকল্পের কাজ চলছে। সমন্বিত বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রেলওয়ে দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখাচ্ছে

বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৪৫) মহাপরিকল্পনা। এর অংশ হিসেবে ছয়টি পর্যায়ে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলায় রেলপথ আছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নতুন করে আরও ১৫টি জেলায় রেলসংযোগ হবে। এসব জেলার মধ্যে আছে মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মেহেরপুর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বান্দরবান, কক্সবাজার, নড়াইল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও মানিকগঞ্জ। দ্বীপজেলা ভোলায়ও হবে রেলপথ।

এদিকে সংকট উত্তরণের চেষ্টার মধ্যেই রেলের যাত্রী বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ে নয় কোটি ২৭ লাখ যাত্রী পরিবহন করে। এর আগের অর্থবছরে (২০১৭-২০১৮) যাত্রী ছিল সাত কোটি ৭৮ লাখ। তবে রেলপথে পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। কারণ এখনও চট্টগ্রাম বন্দরের মাত্র ৮ শতাংশ পণ্য পরিবহন হয় রেলপথে। ঢাকার কমলাপুরের ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) পণ্য ওঠা-নামার সক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া গাজীপুরের ধীরাশ্রমে নতুন আইসিডি নির্মাণ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর রেলের কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত যাত্রীবাহী বগি কেনা হয়েছে ২৭০টি। পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয়েছে ৪৪৬টি। ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি। ভারত থেকে আনা হচ্ছে আরও ২০টি ইঞ্জিন। 

২০০৯ সাল থেকে ৪৫১.১৫ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং এক হাজার ১৮০.৮৭ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মোট ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু এবং ৪৬টি বিদ্যমান ট্রেনের সার্ভিস বাড়ানো হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৪৫) মহাপরিকল্পনা। এর অংশ হিসেবে ছয়টি পর্যায়ে পাঁচ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলায় রেলপথ আছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নতুন করে আরও ১৫টি জেলায় রেলসংযোগ হবে

যাত্রীদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রুটে স্বল্প বিরতির একাধিক ট্রেন চালু করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২৫ মে ঢাকা-পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে স্বল্প বিরতির ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ নামে নতুন ট্রেন চালু করা হয়। এছাড়া ঢাকা-রাজশাহী রুটে ‘বনলতা এক্সপ্রেস’, ঢাকা-বেনাপোল-ঢাকা রুটে ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’ এবং ঢাকা-কুড়িগ্রাম-ঢাকা রুটে ‘কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস’ চালু করা হয়েছে।

২০২০ সালের ৯ মে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প এবং ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ সিঙ্গেল রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পের সার্বিক কাজ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প

বাংলাদেশের নির্মাণ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা বহুমুখী সেতু। প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ৬ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি হবে দোতলা। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও জাজিরার মধ্যে নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যান এরই মধ্যে বসানো হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে এর নির্মাণকাজ চলছে।

দোতলা এ সেতুর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতু উদ্বোধনের দিন থেকে যান ও ট্রেন একসঙ্গে চালুর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে নির্মাণকাজ। ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে প্রকল্প নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ঋণ দেবে চীন। বাকি ১৮ হাজার ২১০ কোটি ৩১ লাখ টাকা বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে।

২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বছর রেলের কোনো ইঞ্জিন কেনা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত যাত্রীবাহী বগি কেনা হয়েছে ২৭০টি। পণ্যবাহী ওয়াগন কেনা হয়েছে ৪৪৬টি। ইঞ্জিন সংগ্রহ করা হয়েছে ৪৬টি। ভারত থেকে আনা হচ্ছে আরও ২০টি ইঞ্জিন

প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি)। ২০১৬ সালে পদ্মা রেল সেতুসংযোগ প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে মাওয়া, ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত ১৬৯ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে।

পদ্মা বহুমুখী সেতুর ওপর দিয়ে নির্মিত রেলপথ ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে যশোরকে

বাংলাদেশ রেলওয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ কত দূর এগিয়েছে— জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছিলাম। তা পেয়ে যাচ্ছি। প্রকল্পে এখন অর্থের কোনো সংকট নেই। করোনাকালের মধ্যেও বেশি মাত্রায় কাজ হয়েছে। আমরা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চাই। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ শতাংশের বেশি। মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা অংশে প্রথমদিন থেকেই যাতে ট্রেন চলাচল করতে পারে সেজন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ অংশের কাজ ৬৫ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের অধীনে নির্মিতব্য রেলপথে মাওয়া ও জাজিরা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন ও নড়াইল রেলস্টেশনের অনুমোদিত নকশা পরিবর্তন করা হবে। এগুলো আইকনিক স্টেশন হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’

আমরা অতিরিক্ত বরাদ্দ চেয়েছিলাম। তা পেয়ে যাচ্ছি। প্রকল্পে এখন অর্থের কোনো সংকট নেই। করোনাকালের মধ্যেও বেশি মাত্রায় কাজ হয়েছে। আমরা দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চাই। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৩৯ শতাংশের বেশি। মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা অংশে প্রথমদিন থেকেই যাতে ট্রেন চলাচল করতে পারে সেজন্য বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ অংশের কাজ ৬৫ শতাংশের বেশি সম্পন্ন হয়েছে

গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, পরিচালক, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প

ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা, নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ হবে প্রকল্পের আওতায়। থাকবে মোট ১৭টি রেলস্টেশন। এর মধ্যে ১৪টি স্টেশন নতুন করে নির্মাণ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেতু

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেলসংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর রেলওয়ের উন্নয়নে এটি ছিল প্রথম মাইলফলক। নির্বিঘ্নে আরও বেশি সংখ্যক ট্রেন চলাচল নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে আলাদা রেলসেতু নির্মাণ করছে সরকার। বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকসহ প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে সেতুটি। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিমে নতুন স্টেশন ভবনসহ ইয়ার্ড রিমডেলিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হবে। এছাড়া থাকবে রেল জাদুঘর ও বাংলো। এ সেতুর নির্মাণকাজ চলমান।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সেতুটি নির্মাণ হলে রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে চলাচলকারী ট্রেনগুলোকে ক্রসিংজনিত কারণে অপেক্ষা করতে হবে না। ট্রেনগুলোর যাত্রার সময় গড়ে ২০ মিনিট কমবে। ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন ১২০ কিলোমিটার এবং মিটারগেজে ট্রেন ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল করতে পারবে। বর্তমানে যেখানে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করে, সেতু নির্মাণ হলে সেখানে ৮৮টি ট্রেন চলাচল করবে।

শিল্পীর চোখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেলসেতু। ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকসহ প্রায় ৪.৮০ কি. মি. রেলপথ থাকবে এতে

প্রকল্প সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ৫ এপ্রিল সেতুটি নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ হয়। গত ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ডাবল লাইন হওয়ায় সেতুটির দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বিবেচনা করছে রেলওয়ে।

সেতুর পূর্বদিকের অংশ (প্যাকেজ- ১) যৌথভাবে নির্মাণ করবে জাপানের ওবায়াশি করপোরেশন, তোয়া করপোরেশন ও জেইই হোল্ডিং। পশ্চিমদিকের অংশ (প্যাকেজ- ২) যৌথভাবে নির্মাণ করবে জাপানের আইএইচআই করপোরেশন ও সুমিতোমো মিতসুই করপোরেশন। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর সমান্তরালে ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকসহ প্রায় ৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে সেতুটি। বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিমে নতুন স্টেশন ভবনসহ ইয়ার্ড রিমডেলিং, সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা হবে। এছাড়া থাকবে রেল জাদুঘর ও বাংলো। এ সেতুর নির্মাণকাজ চলমান

সেতুটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা- জাইকা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ দেবে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের বেশি গতি নিয়ে ট্রেন চালালেই ঝুঁকিতে পড়তে হয়। ডাবল-ট্র্যাকের রেলসেতুটি নির্মাণ হলে বঙ্গবন্ধু সেতুতে থাকা রেললাইন তুলে নেওয়া হবে।

আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন

আন্তর্জাতিক রেলওয়ে সংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। পাকিস্তান, ভারত হয়ে রেলপথে চীনে যেতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অতিক্রম করতে হবে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলপথের অন্যতম সদস্য বাংলাদেশ। ঢাকা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ আছে। এরপর পুরোটাই মিটারগেজ। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইন করতে এক দশকে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। রেলপথটি ডুয়েলগেজে উন্নীত করতে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তাতে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০৩৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের আখাউড়া-লাকসাম রুটের ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইন ডুয়েলগেজের নির্মাণকাজ চলছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার ৫০৪ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরকে ডাবল লাইনে উন্নীতের কাজ শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের দূরত্ব ৩২১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৮ কিলোমিটার ডাবল লাইন বিদ্যমান ছিল। তিনটি প্রকল্পের আওতায় লাকসাম-চিনকি আস্তানা অংশে ৬১ কিলোমিটার, টঙ্গী-ভৈরব বাজার অংশে ৬৪ কিলোমিটার এবং দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ছয় কিলোমিটার ডাবল লাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইন করতে এক দশকে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। রেলপথটি ডুয়েলগেজে উন্নীত করতে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। তাতে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০৩৫ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে

বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের ৩২১ কিলোমিটারের মধ্যে ২৪৯ কিলোমিটার রেলপথে ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) অর্থায়নে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নির্মাণকাজ চলছে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের ৩২১ কিলোমিটারই ডাবল লাইনে ট্রেন চলাচল করবে।

আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণকাজ চলমান

প্রকল্পের পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পের কাজ ৭৪ ভাগ এগিয়েছে। লাকসাম-লালমাই অংশে পরীক্ষামূলক ট্রেন পরিচালনা শুরু হবে শিগগিরই।

খুলনা থেকে মোংলা বন্দর রেলপথ

প্রকল্পের অনুমোদন হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হচ্ছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৭ ভাগ। সম্প্রতি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি প্রকল্প কর্মকর্তাদের আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন। প্রকল্প পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো।

এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে তিন হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৪৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে দুই হাজার ৩৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ

ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েলগেজ রেললাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, কাজ এগিয়েছে ৪০ শতাংশ।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েলগেজ

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান লাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঠিকাদারের সঙ্গে ২০১৭ সালের ২০ জুন চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয়।

প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন জটিলতা পার করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৭৪ শতাংশ।

কক্সবাজার-দোহাজারী রেলপথ

১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ এগিয়েছে ৫১ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে চাই। কক্সবাজারে হবে ঝিনুক আকৃতির রেলস্টেশন। তার কাজও চলছে।

কক্সবাজার-দোহাজারী রেলপথ। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ এগিয়েছে ৫১ শতাংশ

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রেলপথ তৈরির জন্য প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাট কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। ৩৯টি সেতুর ৩০টির কাজ শেষ হয়েছে ৮০ শতাংশ। দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। রেলপথে রেলস্টেশন থাকবে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, ডুলাহাজারা, ঈদগাঁও, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও ঘুমধুমে।

প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান আরও বলেন, করোনাকালেও কাজ চলছে। সামনে বর্ষা। প্রতিকূলতা জয় করেই এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ।

সাশ্রয়ী রেলপথ

এক গ্যালন জ্বালানি তেলে ৬০টি ওয়াগনের মালবাহী ট্রেন এক কিলোমিটার চলতে পারে। একই ওজনের পণ্য পরিবহনে লাগে ২১০টি ট্রাক। ট্রাকগুলোর এক কিলোমিটার পথ চলতে লাগে ২১ গ্যালন জ্বালানি। ট্রেন কতটুকু সাশ্রয়ী, এ উদাহরণ থেকেই তা বুঝা যায়।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাত্রীপ্রতি জ্বালানি ব্যয় হয় গড়ে ০.৯৫ থেকে ১.০৬ লিটার। সড়কপথে একজন যাত্রী পরিবহনে ৪ থেকে ৬.২২ লিটার জ্বালানি লাগে।

বিনিয়োগ বাড়লেও গতি বাড়েনি

বর্তমানে বছরে প্রায় ১০ কোটি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নিরাপদ যাতায়াতের জন্য যাত্রীদের প্রথম পছন্দ ট্রেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার ক্ষমতায় এসে ট্রেনে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলেও গতি সেভাবে আসেনি। ঢাকায় ব্রডগেজ ও মিটারগেজের একটি ট্রেন ঘণ্টায় ৩৫ কিলোমিটার গতিতে চলার কথা। বাস্তবে সে গতি ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার।

ট্রেনের গতি বাড়াতে সব রেলপথ ডাবল লাইন করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে এখন প্রকল্পের কাজ চলমান

মো. নূরুল ইসলাম সুজন, রেলপথমন্ত্রী

কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার রাস্তা যেতে সময় লাগে প্রায় আধাঘণ্টা। ৬৮ শতাংশ রেল ইঞ্জিনের আয়ু প্রায় শেষ। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সে তুলনায় বাড়েনি ট্রেনের গতি ও সেবা। এখনও বাংলাদেশে ট্রেনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।

এ বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ট্রেনের গতি বাড়াতে সব রেলপথ ডাবল লাইন করা হচ্ছে। ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে কাজ শুরু করতে কিছুটা দেরি হয়েছে। তবে এখন প্রকল্পের কাজ চলমান।

বাংলাদেশ রেলওয়ের নতুন মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর আমরা বেশি জোর দিচ্ছি।

পিএসডি/এসকেডি/এমএআর/এমএমজে