পাখি চোখে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণযজ্ঞ

বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতের সার্বিক চিত্র…

ঢাকা থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে তৈরি হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে রাশিয়ার সহযোগিতায়। জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের আশা, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে দেশের অন্যতম বৃহৎ এ প্রকল্পের কাজ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে একটি কেন্দ্র থেকেই দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। পুরোদমে এ কেন্দ্রের উৎপাদন শুরু হলে ২৪ থেকে ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। অর্থাৎ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে বিপুল জনগোষ্ঠীর।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর ব্যবহার হয়েছে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ মডেলের রিয়্যাক্টর রাশিয়ার নভোভোরোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে সফলভাবে ব্যবহার হচ্ছে

প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর ব্যবহার হয়েছে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ মডেলের রিয়্যাক্টর রাশিয়ার নভোভোরোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটে সফলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এ রিয়্যাক্টরগুলো জেনারেশন থ্রি প্লাস এবং সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তামান অনুযায়ী নির্মিত। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সি (আইএইএ) ও ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রত্যেকটি ধাপ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

২০১৭ সালের নভেম্বরে কংক্রিটের মূল স্থাপনা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ফাস্ট ট্র্যাক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার সময়ও প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্পে প্রায় তিন হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। যেভাবে কার্যক্রম এগিয়ে চলছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে সহযোগী প্রকল্পগুলোর কাজ যদি একই সঙ্গে শেষ করা যায় তাহলে নির্ধারিত সময়েই মিলবে এর সুফল।

ফাস্ট ট্র্যাক প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার সময়ও প্রকল্পের কাজ চলমান ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। প্রকল্পে প্রায় তিন হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। যেভাবে কার্যক্রম এগিয়ে চলছে তাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক তথ্য কর্মকর্তা মো. সৈকত আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্বিকভাবে প্রকল্পের অগ্রগতি ৩৫ শতাংশ বলা যায়। করোনার মধ্যেও প্রকল্পের কাজ ২৪ ঘণ্টা চলমান ছিল। বর্তমানে তিন শিফটে প্রায় ২৪ হাজার লোক কাজ করছেন। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দুটি ইউনিট থেকে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে।

ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর ব্যবহার হয়েছে রাশিয়ার নভোভোরোনেঝ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে

‘২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুধু রূপপুর থেকেই দেড় কোটি পরিবারের আওতায় ছয় কোটি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে ২৪ থেকে ২৫ হাজার মানুষের’— বলেন এ কর্মকর্তা।

২০২৩ সালে প্রথম ইউনিট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুধু রূপপুর থেকেই দেড় কোটি পরিবারের আওতায় ছয় কোটি মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হবে ২৪ থেকে ২৫ হাজার মানুষের

মো. সৈকত আহমেদ, বৈজ্ঞানিক তথ্য কর্মকর্তা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। আট হাজারেরও বেশি দেশি-বিদেশি জনবল নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। করোনার সময়ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ হয়েছে। আশা করি, ২০২৩ সালের মধ্যেই প্রথম ইউনিট চালু করা যাবে। পরের বছর দ্বিতীয় ইউনিট চালুর লক্ষ্য রয়েছে।’

রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিট -১ এর পোলার ক্রেন বিম স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে

উল্লেখ্য, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এর নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। আট হাজারেরও বেশি দেশি-বিদেশি জনবল নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। করোনার সময়ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ হয়েছে। আশা করি, ২০২৩ সালের মধ্যেই প্রথম ইউনিট চালু করা যাবে। পরের বছর দ্বিতীয় ইউনিট চালুর লক্ষ্য রয়েছে

স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী

পাবনার রূপপুরে এ প্রকল্পের পারমাণবিক চুল্লির জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরে কংক্রিটের মূল স্থাপনা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে দ্বিতীয় চুল্লির নির্মাণকাজ শুরু হয়। সরকার আশা করছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রথম ইউনিট জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা সম্ভব। ২০২৪ সালে চালুর টার্গেট সমান উৎপাদন ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটটির।

দেশের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শেষ যন্ত্রাংশ

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশের অন্তত ১৩ জেলায় পৌঁছে দিতে ৬১০ কিলোমিটার গ্রিডলাইন নির্মাণবাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এত হাজার ৫২৭ কোটি টাকা, সংস্থার নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ২৩৫ কোটি টাকা এবং বাকি টাকার সংস্থান হবে ঋণের মাধ্যমে। বৈদেশিক ঋণ হিসেবে আট হাজার ২১৯ কোটি দেবে ভারত। ইন্ডিয়ান লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় এ ঋণ দিতে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিও হয়েছে।

এসআর/এমএআর/