শিল্পীর চোখে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর

বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে বন্দর ও অবকাঠামো খাতের সার্বিক চিত্র…

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে দেশে একসঙ্গে নয়টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বর্তমান সরকার। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে তা বিশেষ অবদান রাখবে। বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে বাংলাদেশ।

মেগা প্রকল্পগুলো হলো- পদ্মা সেতু, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মারেল সেতু, দোহাজারী-কক্সবাজার-গুনদুম রেলপ্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর এবং পটুয়াখালী এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্প।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছোঁয়ায় মাতারবাড়ী বন্দর দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেন

সরকারের দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনার অংশ হিসেবে জাপান সরকারের অর্থায়নে কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ছোঁয়ায় মাতারবাড়ী বন্দর দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেন।

বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য তৈরি করা হয় ছয়টি বয়া চ্যানেল

গত বছরের মার্চে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ফাস্ট ট্র্যাক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পটি ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৩৮ দশমিক ৫০ শতাংশ।

প্রকল্পের আওতায় দুটি প্যাকেজের মধ্যে প্যাকেজ ১.১ এর প্রিপারেটরি ওয়ার্ক ফর পাওয়ার প্ল্যান্ট ও পোর্ট ফ্যাসিলিটিজের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। প্যাকেজ ১.২ এর পাওয়ার প্ল্যান্ট ও পোর্ট ফ্যাসিলিটিজ, পোর্ট-প্ল্যান্ট-প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও পরামর্শক সেবা, পল্লী বিদ্যুতায়ন শতভাগ, টাউনশিপের ভূমি উন্নয়ন, পূর্তকাজ আবাসিক ও অনাবাসিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলমান।

চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত টেন্ডারের কাজ হবে। জুলাই ২০২২ সাল থেকে মাঠপর্যায়ে ফিজিক্যালি কাজ শুরু হবে। তার মানে, আগামী এক বছর প্রকল্প এলাকায় ফিজিক্যালি কোনো কাজ করা হবে না

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা ইউনিয়নে ১২০০ মেগাওয়াট আলট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় আমদানি করা কয়লা লোড-আনলোড জেটি, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, টাউনশিপ নির্মাণ, স্থানীয় এলাকায় বিদ্যুতায়ন, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংযোগ সড়ক নির্মাণ হচ্ছে।

বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়ে জাহাজ ভিড়েছে মাতারবাড়ী চ্যানেলে

প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন/সমীক্ষা (ইআইএমএ) এবং সম্ভাব্যতা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সম্পন্ন করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) মধ্যে ২০১৪ সালের ১৬ জুন একটি ঋণ চুক্তি হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (জিডিপি) অনুযায়ী এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট অর্থায়নের ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা সহায়তা হিসেবে জাইকা এবং অবশিষ্ট সাত হাজার ৪৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও সরকারি খাতের ‘কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ (সিপিজিসিবিএল)-এর নিজস্ব তহবিল থেকে সংস্থান হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ দক্ষ জনবল তৈরি হবে।

বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে মালামাল তুলতে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যায় এবং সময় বেশি লাগে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে সময় ও অর্থের অপচয় কমানো সম্ভব হবে

মো. মীর জাহিদ হাসান, প্রকল্প পরিচালক, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর

বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্বার্থে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে সাগরের কোলঘেঁষে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ হচ্ছে। ২০২৬ সালে এটি চালু হওয়ার কথা। এরই মধ্যে প্রকল্পটির ফিজিবিলিটি ও প্রি-ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়েছে। বন্দর নির্মাণে জাপানের নিপ্পন কোই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শক চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে।

সাড়ে ১৮ মিটার গভীর চ্যানেল নির্মাণে চলছে খননকাজ

মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. মীর জাহিদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পটি গত বছরের মার্চে একনেকে অনুমোদন হয়েছে। এরপরই ওই বছরের সেপ্টেম্বরে কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান নভেম্বর থেকে কাজ শুরু করেছে। তারা ডিজাইন ও ড্রয়িংয়ের কাজ করছে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তারা এ কাজ করবে। 

চলতি বছরের জুলাই থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত টেন্ডারের কাজ হবে। জুলাই ২০২২ সাল থেকে মাঠপর্যায়ে ফিজিক্যালি কাজ শুরু হবে। তার মানে, আগামী এক বছর প্রকল্প এলাকায় ফিজিক্যালি কোনো কাজ করা হবে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের কোনো গভীর সমুদ্রবন্দর নেই। গভীর বন্দর না থাকাতে বিভিন্ন দেশ থেকে যে মাদার ভেসেলগুলো (বড় জাহাজ) আসে, সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আসতে পারে না। ফলে মাদার ভেসেলগুলো গভীর সমুদ্রে রাখা হয় এবং লাইটার জাহাজে করে পণ্য খালাস করতে হয়। বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে মালামাল তুলতে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যায় এবং সময় বেশি লাগে। মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে সময় ও অর্থের অপচয় কমানো সম্ভব হবে।’

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছোঁয়ায় মাতারবাড়ী বন্দর দেশের গভীর সমুদ্রবন্দরে পরিণত হচ্ছে

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে যে চ্যানেল হচ্ছে সেটার দৈর্ঘ্য ১৪.৩ কিলোমিটার। এ চ্যানেল দিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া করবে। এটা চওড়া হবে ৩৫০ মিটার আর গভীরতা হবে সাড়ে ১৮ মিটার। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২০২৬ সালের মধ্যে বন্দরের প্রথমপর্যায়ের কাজ শেষ হবে। দ্বিতীয়পর্যায়ের কাজ ২০২৬ সালের পর শুরু হবে। দুটি প্রকল্প মিলে পুরো বন্দরটির কাজ শেষ হবে।’

বিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্থায়নে করা চ্যানেল দিয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক জাহাজ ‘ভেনাস ট্রায়াম্ফ’ জেটিতে ভেড়ে। এ জাহাজ মূলত বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম নিয়ে আসে। ইন্দোনেশিয়া থেকে চার দশমিক চার ড্রাফটের ১২০ মিটার জাহাজটি ৭৫০ টন নির্মাণসামগ্রী নিয়ে আসে।

এর আগে বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জাহাজ চলাচলের পথ নির্দেশনার জন্য ছয়টি বয়া চ্যানেল তৈরি হয়। বন্দরটি হলে বাংলাদেশ পাঁচটি বন্দরের মালিক হবে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, মোংলা সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং মীরসরাই ইকোনমিক জোন সংলগ্ন প্রথম বেসরকারি সমুদ্রবন্দর।

এসআর/জেডএস/এমএআর/