শহর চিরে নদী, নদীর নিচে রাস্তা, সাংহাই আদলে গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম

বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে অবকাঠামো খাতের সার্বিক চিত্র…

ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ঐতিহাসিক বছর পার করছে। ৫০ বছরে এসে সম্ভাবনাময় শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বকে জানান দিচ্ছে বাংলাদেশ।

দেশের উন্নয়নযাত্রা অব্যাহত রাখতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে একের পর এক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়াসহ প্রচুর অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। রাজধানী ঢাকা ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা আর চীন সরকারের ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা

বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই প্রদেশের আদলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বিশাল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে দেশের ইতিহাসে প্রথম টানেল নির্মাণ হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পতেঙ্গা ও আনোয়ারায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সড়ক নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। কাজের বর্তমান গতি ধরে রাখতে পারলে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

এ বিষয়ে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়নের হার ৬৫ শতাংশ। এটি বাস্তবায়ন হলে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের চারদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। মূল শহরটা চীনের সাংহাইয়ের মতো দেখতে হবে।’

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়নের হার ৬৫ শতাংশ। এটি বাস্তবায়ন হলে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের চারদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। মূল শহরটা চীনের সাংহাইয়ের মতো দেখতে হবে

মো. হারুনুর রশিদ, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক

তিনি বলেন, ‘এখানে কোরিয়া ইপিজেড ও চীনের বড় বড় ব্যবসা আছে। সুতরাং ভবিষ্যতে এখানে ব্যবসার আরও প্রসার ঘটবে। এটি আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর দুটি ব্রিজ আছে। এ ব্রিজ দুটি দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ অংশের সঙ্গে মূল শহরের কোনো সংযোগ নেই। এখানে টানেল না করে ব্রিজ করলে বন্দরের কার্যক্ষমতা কমে যেত। বন্দরের কার্যক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রেখে টানেলের মাধ্যমে যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। চট্টগ্রামকে বাইপাস করতে এ টানেল কার্যকর ভূমিকা রাখবে। কারণ যে দুটি ব্রিজ আছে, সেগুলো চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। টানেল হয়ে গেলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণের লোকজন টানেলটি ব্যবহার করে সহজে চট্টগ্রাম শহরে আসতে পারবে।’

২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘টানেল বোরিং’ কাজের উদ্বোধন করেন

জানা যায়, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা আর চীন সরকারের ঋণ পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন পায়।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে

এ বছর জানুয়ারি মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় দুটি টিউব সম্বলিত ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার মূল টানেল নির্মাণে ঋণ দিচ্ছে চীন সরকার। আর টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজ (ভায়াডাক্ট) নির্মাণে অর্থায়ন করছে বাংলাদেশ সরকার।

ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়নের হার ৬৫ শতাংশ

জি টু জি পদ্ধতিতে ইপিসি কন্ট্রাক্টে টানেল নির্মাণের জন্য চাইনিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসিসিসি লিমিটেড ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে ২০১৫ সালের ৩০ জুন বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) ও চীন সরকারের (দ্য এক্সিম ব্যাংক অব চায়না) মধ্যে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর ঋণ চুক্তি কার্যকর হয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ফিন্যান্সিয়াল এবং ইকোনমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ শতাংশ ও ১২.৪৯ শতাংশ। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ‘বেনিফিট কস্ট রেশিও’র (বিসিআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১.০৫ ও ১.৫০ শতাংশ। ফলে কর্ণফুলী টানেল জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী ‘টানেল বোরিং’ কাজের উদ্বোধন করেন। এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৪৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের প্রথম টিউবের সম্পূর্ণ বোরিংয়ের কাজ রিং প্রতিস্থাপনসহ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উদ্বোধন করেন। এ কাজ এখনও চলছে।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে

চীনের জিনজিয়াং শহরে চলছে টানেলের সেগমেন্ট নির্মাণের কাজ। এরই মধ্যে ১৯ হাজার ৬১৬টি সেগমেন্টের মধ্যে ১৯ হাজার ২০৪ সেগমেন্টের নির্মাণ হয়েছে। যার মধ্যে ১৫ হাজার ৭৮৪টি সেগমেন্ট প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে এবং নয় হাজার ৭৮৪ সেগমেন্ট টানেলের অভ্যন্তরে স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণের অগ্রগতি প্রায় ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে ১২১টি কাস্ট ইন সিটু বোরড পাইল, ১০৩টি কংক্রিট পিয়ার ও ৪৬টি কলার বিমের শতভাগ কাজ, ৪৬টি পিয়ার ক্যাপের মধ্যে ৪৬টির শতভাগ কাজ এবং ২০৩টি প্রি-ফেব্রিকেটেড বক্স গার্ডারের মধ্যে ১২২টির ৫৮ দশমিক ৬২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৩৮২ দশমিক ৮২১ একর ভূমির মধ্যে ৩৬২ দশমিক ৩২২১ একরের অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ১৯ দশমিক ৭৬ একর ভূমির প্রস্তাব ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন আছে এবং তা শিগগিরই হস্তান্তর হবে বলে প্রতিবেদনে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আইএমইডি সচিব।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে যেসব সুফল মিলবে 

১. কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হবে। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন হবে।

টানেল হয়ে গেলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব কমে আসবে 

২. কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। ফলে ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং পূর্বপ্রান্তের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন সহজ হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্বপ্রান্তে পর্যটন শিল্প বিকশিত হবে।

৩. সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ, আধুনিকায়ন, শিল্প-কারখানার বিকাশ সাধন এবং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে কর্ণফুলী টানেল বেকারত্ব দূরীকরণসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।

৪. প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ফিন্যান্সিয়াল এবং ইকোনমিক আইআরআর-এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯ শতাংশ ও ১২.৪৯ শতাংশ। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল ও ইকোনমিক ‘বেনিফিট কস্ট রেশিও’র (বিসিআর) পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১.০৫ ও ১.৫০ শতাংশ। ফলে কর্ণফুলী টানেল জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।

এসআর/জেএস/এমএআর/