থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ করব— এটি ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। তবে, নির্মাণকাজ চলাকালীন (২০২০ সাল) করোনা ভাইরাসের কারণে গোটা পৃথিবী স্থবির হয়ে পড়ে। নির্মাণকাজের গতি নিয়ে আমরাও তখন শঙ্কায় ছিলাম। তবে, প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত, অনুপ্রেরণা ও সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকায় করোনার মধ্যেও তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। অবশেষে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। নান্দনিক ও দৃষ্টিনন্দন এ টার্মিনাল দেখে সবাই মুগ্ধ হবেন। খুলবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার...

২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসেই সরকারের স্বপ্ন ছিল ঢাকার বিমানবন্দরকে অত্যাধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন করা, নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ ছিল ২০১৭ সালের অক্টোবরে। এদিন শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ করে তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় একনেক। ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় পরের বছরের এপ্রিলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল হলেও এ প্রকল্পের ব্যয় এক টাকাও বাড়েনি, কাজ শেষ হচ্ছে নির্ধারিত সময়েই। সফল এ প্রকল্প নিয়ে ঢাকা পোস্টকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের প্রধান প্রতিবেদক আদনান রহমান।

ঢাকা পোস্ট : আপনার দৃষ্টিতে কেমন হলো তৃতীয় টার্মিনাল?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী : আমার চোখে সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি, লন্ডনের হিথ্রো, থাইল্যান্ডের সুবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মতোই দৃষ্টিনন্দন হয়েছে টার্মিনালটি। পাশাপাশি এসব অত্যাধুনিক বিমানবন্দরের যাত্রীরা যে মানের সেবা পান, আমাদের থার্ড টার্মিনালেও একই মানের সেবা পাবেন।

বিশ্বের অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মতোই এ টার্মিনালে ৩৭টি প্লেন রাখার অ্যাপ্রোন (প্লেন পার্ক করার জায়গা), স্ট্রেইট এস্কেলেটর (মুভিং ওয়াকওয়ে), যাত্রীদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সোফা ও বসার ব্যবস্থা, নামাজ ও উপাসনালয়, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক চেইন রেস্টুরেন্ট ও সুপার-শপ এবং যাত্রীদের জন্যে থাকবে ওয়াই-ফাই ব্যবস্থা। এ ছাড়া, বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক বিমানবন্দরের মতো অত্যাধুনিক এবং একই রকমের ব্যাগেজ বেল্ট, মায়েদের ব্রেস্ট ফিডিং বুথ, ডায়াপার পরিবর্তনের জায়গা, বাচ্চাদের স্লিপার-দোলনাসহ একটি চিলড্রেন প্লে-এরিয়াও করা হয়েছে।

এ টার্মিনালের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ আরও সহজতর হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ টার্মিনালের সঙ্গে মেট্রোরেলের সংযোগ দেওয়া হবে। এতে ঢাকা শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে মেট্রোতে চড়েই সরাসরি বিমানবন্দরে চলে আসতে পারবেন যাত্রীরা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় চান আকাশপথে মানুষ আসার সময় যেন বাংলাদেশের উন্নয়ন অনুভব করতে পারেন। সে অনুযায়ী তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তারই একটি অন্যতম নিদর্শন টার্মিনাল- ৩।

ঢাকা পোস্ট : তৃতীয় টার্মিনাল প্রকল্পটি কতটুকু চ্যালেঞ্জিং ছিল?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী : টার্মিনালটি আমাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল। তবে, নির্মাণকাজ চলাকালীন (২০২০ সাল) করোনা ভাইরাসের  কারণে গোটা পৃথিবী স্থবির হয়ে গিয়েছিল। নির্মাণকাজের গতি নিয়ে আমরাও তখন আশঙ্কায় ছিলাম। তবে, প্রধানমন্ত্রীর সাহসী সিদ্ধান্ত, অনুপ্রেরণা ও সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকায় করোনার মধ্যেও তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই কাজ করেছেন এবং আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পেরেছি।

ঢাকা পোস্ট : থার্ড টার্মিনালে অত্যাধুনিক কী কী প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী : টার্মিনালটিতে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সেলফ চেক-ইন মেশিন বসানো হবে। এগুলোতে নিজের পাসপোর্ট ও টিকিটের তথ্য প্রবেশ করালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসবে বোর্ডিং পাস ও সিট নম্বর। এরপর নির্ধারিত জায়গায় যাত্রী তার লাগেজ রেখে দেবে। পাশাপাশি ম্যানুয়ালি চেক-ইন করার জন্য থাকবে ১০০টি চেক-ইন কাউন্টার। নতুন টার্মিনাল ভবনের বহির্গমন পথে ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট কন্ট্রোল বা ই-গেইট থাকবে। এতে করে যাত্রীরা ইমিগ্রেশন পুলিশের মুখোমুখি না হয়ে সরাসরি নিজেই নিজের ইমিগ্রেশন সেরে ফেলতে পারবেন।

ঢাকা পোস্ট : টার্মিনাল, এয়ারক্রাফট ও যাত্রীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী : নতুন এ টার্মিনালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে থাকবে ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ১১টি বডি স্ক্যানার বসানো হয়েছে। এগুলো টার্মিনালে প্রবেশ করা একজন যাত্রীকে বিমানে ওঠা পর্যন্ত হাতের স্পর্শ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে তল্লাশি করা যাবে। সেক্ষেত্রে যাত্রীকে বডি স্ক্যানার মেশিনের ভেতর দুই হাত তুলে দাঁড়াতে হবে। ফলে যাত্রী ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সময় বাঁচবে। স্ক্যানিংও হবে নির্ভুল ও স্বচ্ছ।

নিরাপত্তার দায়িত্বে এভিয়েশন সিকিউরিটির (এভসেক) পাশাপাশি এপিবিএন, র‍্যাব, পুলিশ, আনসারসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন। নতুন টার্মিনাল ভবন এলাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশন করা হয়েছে। সেখানে থাকবেন একজন পৃথক ফায়ার স্টেশন ম্যানেজার। থাকবে আগুন নেভানো ও জরুরি উদ্ধার কাজের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা।

ঢাকা পোস্ট : এ টার্মিনালের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ কীভাবে লাভবান হবেন?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী :  টার্মিনালটির মাধ্যমে দেশ ও সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হবে। প্রখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিনের নকশায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক থার্ড টার্মিনালের মাধ্যমে বছরে অতিরিক্ত ১২ মিলিয়ন যাত্রী চলাচলের সুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। যা পরবর্তীতে দুটি পিয়ার এক্সটেনশনের মাধ্যমে ১৬ মিলিয়নে উন্নীত হবে। ফলে ভবিষ্যতে এ বিমানবন্দরের মাধ্যমে বছরে মোট ২৪ মিলিয়ন যাত্রী চলাচল করতে পারবেন।

সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ আয়তনের আমদানি-রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্স নির্মিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বছরে দুই লাখ ৭৩ হাজার টন কার্গো আমদানি এবং পাঁচ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪১ টন কার্গো রপ্তানি করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, তৃতীয় টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং এর পূর্বপাশে নির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে একাধিক এলিভেটেড রোড/ইউলুপ ও আন্ডার পাস থাকছে। ফলে যাত্রীদের কোনো প্রকার ট্র্যাফিক সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।

এ এলাকায় সরকারের পরিকল্পনাধীন মেট্রোরেল, বিমানবন্দর রেলস্টেশন ও হজ ক্যাম্পের সঙ্গেও থার্ড টার্মিনালের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্মানিত যাত্রীগণ যেমন স্বাচ্ছন্দে বিমানবন্দর দিয়ে চলাচল করতে পারবেন তেমনি দেশের পর্যটন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসারেও ভূমিকা রাখবে এ বিমানবন্দর। এ দেশের এভিয়েশন সেক্টরে এ টার্মিনাল নির্মাণ করা ছিল একটি বড় ধরনের বিপ্লব।

ঢাকা পোস্ট : দেশের এভিয়েশন সেক্টরের উন্নয়নে বর্তমান সরকার আর কী কী উদ্যোগ নিয়েছে?

প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী : আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব বিমানবন্দর অত্যাধুনিক রূপ দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছি। পাঁচ হাজার ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ও এয়ার ফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে শক্তিশালীকরণ প্রকল্প শেষ হয়েছে। দুই হাজার ৭৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন টার্মিনাল ভবন, কন্ট্রোল টাওয়ার, প্রশাসনিক ভবন, কার্গো ভবন নির্মাণসহ বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা এবং আঞ্চলিক হাবে পরিণত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। কক্সবাজারে পাঁচ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে  নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ এবং রানওয়ের দৈর্ঘ্য নয় হাজার ফুট থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার ৭০০ ফুট করার প্রকল্প চলমান রয়েছে। যশোর বিমানবন্দর, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়ে বৃদ্ধিসহ নানা উন্নয়ন কাজ চলমান। যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সৈয়দপুর বিমানবন্দর আঞ্চলিক এভিয়েশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ চলছে।

এআর/