বহুল আলোচিত নরসিংদী- ২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান ওরফে পোটনের বিরুদ্ধে এবার এক লাখ ৮৪ হাজার ৭১ টন সার লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।

সরকারিভাবে আমদানি করা ওই সার বন্দর থেকে খালাসের পর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) গুদামে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু তা পৌঁছায়নি। এমন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

এর আগে জানুয়ারি মাসে ৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করে সরকারের ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি করার পৃথক একটি অভিযোগের অনুসন্ধান দুদকে চলমান রয়েছে। যা এখন শেষ পর্যায়ে আছে বলে জানা গেছে।

নতুন অভিযোগ অনুসন্ধানে বিএডিসির চেয়ারম্যানের কাছে ইতোমধ্যে রেকর্ডপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। চিঠিতে আগামী ২৪ অক্টোবরের মধ্যে বিএডিসিকে রেকর্ডপত্র দুদকে জমা দিতে বলা হয়েছে। গত ৫ অক্টোবর ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, কামরুল আশরাফ খান ওরফে পোটনের বিরুদ্ধে বিসিআইসি’র আমদানি করা ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ৭২ হাজার টন সার আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান। এখন নতুন করে তার বিরুদ্ধে বিএডিসি’র আরও এক লাখ ৮৪ হাজার ৭১ টন সার আত্মসাতের অভিযোগ এসেছে। এসব সারের মূল্য প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।



জানতে চাইলে অনুসন্ধান টিমের প্রধান মো. রফিকুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। চিঠিপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলা যাবে না। আপনি জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করেন।’ যদিও জনসংযোগ শাখা বিষয়টি অবগত নন বলে জানিয়েছে।

দুদক থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, সার আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) সাবেক সংসদ সদস্য ও সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি। তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তার বিরুদ্ধে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিএডিসির বিদেশ থেকে আমদানি করা এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের এমপিও, টিএসপি ও ডিএপি- এ তিন ধরনের এক লাখ ৮৪ হাজার ৭১ টন সার আত্মসাতের অভিযোগ জমা হয়েছে দুদকে। কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটির উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান পোটনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যানকে দেওয়া চিঠিতে দুদক ‘চাহিদাকৃত নথিপত্র আগামী ২৪ অক্টোবরের মধ্যে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে।’



যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে

চিঠিতে যেসব নথিপত্র চাওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আটটি জাহাজে বিদেশ থেকে আনা সারের বিল অব এন্ট্রিসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র। বন্দরে জাহাজ পৌঁছানোর পর যে ড্রাফ সার্ভে করা হয়েছে সে রিপোর্টের কপি, জাহাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের তালিকা, মাদার ভেসেল থেকে লাইটার ভেসেলে খালাসের চালান ও ছাড়পত্র, ঘাট (লাইটার জাহাজ) থেকে যেসব পরিবহনে সার নিকটবর্তী গুদামে পৌঁছানো হয়েছে সেসব পরিবহনের ছাড়করণ ও গ্রহণের রেকর্ডপত্র, পোটন ট্রেডার্সের সার পরিবহন সংক্রান্ত দৈনিক ও সাপ্তাহিক স্টেটমেন্ট। এক্ষেত্রে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম ও পদবি, আটটি জাহাজ বন্দরে (চট্টগ্রাম ও মংলা) পৌঁছার পর থেকে সার খালাস পর্যন্ত সময়ে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নাম, পদবি ও দায়-দায়িত্ব (ছক আকারে), পোটন ট্রেডার্স চুক্তি অনুযায়ী গুদামে নির্ধারিত সময়ে যে পরিমাণ সার সরবরাহ করেছে তার প্রমাণপত্র এবং যেসব সার সরবরাহ করেনি তার প্রতিবেদন।

আরও পড়ুন

পোটন ট্রেডার্স চুক্তি অনুযায়ী সার যথাসময়ে গুদামে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কী ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার তথ্য, পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আটটি জাহাজের সার রিসিভার চালান, আন্ডারটেকিং সার্টিফিকেট ও এমআরআরের কপি, পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে আটটি জাহাজের চুক্তির বিপরীতে ব্যাংক গ্যারান্টির কপি, আটটি জাহাজের সার আত্মসাতের ঘটনায় বিএডিসি থেকে যেসব বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে সেই তদন্ত প্রতিবেদনের কপি, আমদানিকৃত সার গুদামে সরবরাহ সংক্রান্ত পরিবহন নীতিমালা ও বিধি-বিধান থাকলে তার কপি। এ ছাড়া, এ সংক্রান্ত আর কোনো রেকর্ডপত্র থাকলে তা দিতে বলা হয়েছে দুদকের চিঠিতে।

কামরুল আশরাফ খান ওরফে পোটন



৫৮২ কোটি টাকার সার লোপাটে পৃথক অনুসন্ধান

৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করে সরকারের ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি করার পৃথক একটি অভিযোগের অনুসন্ধান দুদকের চলমান রয়েছে। যা এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে ও সঠিক সময়ে সার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তিন লাখ ৯৩ হাজার টন ইউরিয়া সার আমদানি করে সরকার। অভিযোগ উঠেছে, ওই সারের মধ্যে ৭২ হাজার টন সার আত্মসাৎ করে সাবেক এমপি পোটনের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। এ ঘটনায় সরকারের প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বিসিআইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।

সার আত্মসাতের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি দুদককে নির্দেশনা দেয় আদালত। হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর কমিশন এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এ বিষয়ে গত ২৯ মার্চ দুদকের উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে।

কামরুল আশরাফ খান পোটন ২০১৪ সালে নরসিংদী- ২ আসনে জাসদের প্রার্থী জায়েদুল কবিরকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জায়েদুল মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। পোটন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বর্তমানে এ আসনের সংসদ সদস্য তার ভাই আনোয়ারুল আশরাফ খান, যিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত।

আরএম/এমএআর