ছবি- ইউনিসেফ

খান হাসান আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজধানীর কাঁঠালবাগানে অবস্থান বিদ্যালয়টির। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সরকারি খরচে পড়ার সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। করোনা মহামারির পর থেকে প্রতিবছর বিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েদের বেলায় কমার সংখ্যাটা আরো বেশি। এর জন্য প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে বাল্যবিবাহকে।

শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য বলছে, বছর পাঁচেক আগেও বিদ্যালয়টিতে গড়ে ৭০০-৯০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। করোনা মহামারির ধাক্কায় গত কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমতে কমতে ৩৫০ থেকে ৪০০তে নেমে এসেছে। এর বড় কারণ হচ্ছে— সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি শেষ করার আগে শতকরা ৫০ ভাগ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে।

নাসিমা আক্তার নামে এক শিক্ষিকা ঢাকা পোস্টকে জানান, এখানে যারা পড়ে তাদের বেশিরভাগ গরীব ঘরের সন্তান। কোভিডের পর শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কমে গেছে। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ একটা প্রধান কারণ। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অনেক মেয়ে হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে যায়। কখনো দেখি— একটা মেয়ে হঠাৎ করে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। পরে খবর পাই তার বিয়ে হয়ে গেছে!

তিনি বলেন, সঠিক পরিসংখ্যান বা হিসাব না থাকলেও করোনার পর থেকে শতকরা ৫০ ভাগ বা অর্ধেক মেয়ে শিক্ষার্থীর সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেকে অষ্টম শ্রেণি পার হতে পারলেও তারা বাল্যবিবাহের জন্য আর বেশি দূর যেতে পারছে না।

বিদ্যালয়টির শিক্ষকদের সহায়তায় বাল্যবিবাহ দেওয়া দুটি মেয়ের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঢাকা পোস্ট। একটি মেয়ের বাবা মাহবুব আলী। তিনি বাংলামোটরে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন। চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কাঁঠালবাগানে একটি টিন শেডের রুমে ভাড়া থাকেন। মেয়ে মরিয়মকে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন তিনি।

কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে মাহবুব আলীর ভাষ্য, বাবারে, মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো ছিল। ইচ্ছা ছিল মেয়েটারে মেট্রিক পাশ করামু। কিন্তু যে ইনকাম কুলাইতে পারি না। মেয়ের মাও ভয় পায় যদি একটা অঘটন ঘটে। সবকিছু চিন্তা করেই মেয়েটারে বিয়ে দিছি।

মাস তিনেক আগে বিয়ে হয় সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া পারভিন আক্তারের। মা আমেনা বেগম বলেন, মেয়ের বাবা রিকশা চালায়। আমি অন্যের বাসায় কাম করি। আমি অনেক সময় কামে যাই, মেয়ের বাবাও থাকে না। মেয়ে বাসায় একা থাকে। যদি একটা অঘটন ঘটে বলা তো যায় না। খারাপ পোলাপান সব জায়গায়। কখন যে কী হয়, সেই ভয়ে একটা ভালো পোলা পেয়ে মেয়েরে বিয়ে দিয়ে দিছি।

বর্তমান আইনে বাংলাদেশে মেয়েরা বিয়ের যোগ্য হয় ১৮ বছর বয়সে, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে এই বয়স ২১ বছর। তবে আইনের তোয়াক্কা না করে শহরে কিংবা গ্রামে হরহামেশা বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও তৎপরতায় করোনা মহামারিতে ভাটা পড়ে। বিগত কয়েক বছরে সরকারের উদ্যোগের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতার সুযোগে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এই সামাজিক ব্যাধি। এতে করে মরিয়ম-পারভিনের মতো অনেক অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের যুক্ত হতে হচ্ছে বাল্যবিবাহের মিছিলে। তাদের স্বপ্নগুলো প্রাথমিক কিংবা নিম্ন মাধ্যমিকে পড়ার সময়েই বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে হঠাৎ করে দেশে বাল্যবিবাহ বেড়ে যায়। কোভিডের পরেও তা বেড়েই চলছে। এর কারণ হিসেবে তারা মনে করছেন— কোভিডের পর থেকে বর্তমান সময় অবধি ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এ কারণেও অনেক পরিবার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের পরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোভিডের পর বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে, এটা দুঃখজনক। দারিদ্র্য তার অন্যতম কারণ। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পরিবারগুলোর কাটছাঁট করে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় প্রাধান্য পায় কন্যা সন্তানের পড়াশোনা। এছাড়া অশিক্ষাও বাল্যবিবাহের একটা বড় কারণ। কখনো কখনো সামাজিক নিরাপত্তা বাল্যবিবাহকে উৎসাহিত করে। কোভিডের পর পড়াশোনায় এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে, তখন অনেক মেয়ে পড়াশোনা থেকে ছিটকে পড়েছে। পড়াশোনায় গ্যাপ তৈরি হওয়ায় অনেক মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়েছে।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাল্যবিবাহ শুধু যে দরিদ্র পরিবারে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। শিক্ষার অভাবে অনেক সচ্ছল পরিবারও কিন্তু ভালো পাত্রের আশায় মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া সবার হাতে হাতে এখন স্মার্ট মোবাইল ফোন। ছেলে-মেয়েদের সম্পর্ক হচ্ছে। তারা অপ্রাপ্ত বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে। কোভিডের পর থেকে বাল্যবিবাহ আসলেই বেড়েছে। এখনই এ ব্যাধি বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের প্রচেষ্টায় এটা করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধার ভাষ্য, কোভিডের সময়ের প্রভাব কমবেশি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে পড়েছে। ওই সময়ে আমাদের যে সামাজিক মনন তৈরি হয়েছিল, সেটা কিন্তু পরিবর্তন হয়ে যায়নি। সামাজিক সেই মননের কারণে বাল্যবিবাহের সংখ্যাটা বেড়েছে। সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপটাও রয়েছে। যদিও বাল্যবিবাহের আরও অনেক কারণ রয়েছে। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ আমাদের সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করছে। বাল্যবিবাহ যাদের দেওয়া হচ্ছে তারা তো শিশু। এর মাধ্যমে শিশু অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে।

রেজওয়ানা করিম বলেন, বাল্যবিবাহ বললে আমরা কেবল মেয়ে চিন্তা করি। আসলে এখানে ছেলে বা মেয়ে নেই। আইন অনুয়ায়ী— ২১ বছরের নিচে ছেলেরা বিয়ে করলে সেটাও কিন্তু বাল্যবিবাহ। সেটিকে কিন্তু সামনে আনা হয় না। কেন মেয়েদের ১৮ আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১? কেন এই দ্বৈত নীতি? রাষ্ট্র কেন এটা করছে? কারণ, রাষ্ট্র মনে করে ছেলেরা দায়িত্ব নেবে, অভিভাবকত্ব নেবে। তাহলে রাষ্ট্র কি ছেলে-মেয়েকে সমান চোখে দেখল?

আইনের ফাঁক

১৯২৯ সালের ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী— মেয়েদের ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনটি বাতিল করে ২০১৭ সালে সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করে। তাতে বেশ কিছু ধারায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। বর্তমান আইনে বয়সের সীমা আগের আইনের মতো একই রেখে কোনো নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোনো পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে শাস্তির সময় এবং অর্থদণ্ডের পরিমাণ বাড়ানো হয়। পাশাপাশি নতুন আইনে শাস্তির আওতায় কারা আসবে তা-ও ঠিক করে দেওয়া হয়।

কিন্তু আইনটির একটি বিশেষ বিধান অনুসারে— কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবা কিংবা অভিভাবকের সম্মতিতে বিধি অনুসরণ করলে সেই বিয়ে বাল্যবিবাহের অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এমন বিধান আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে, যা কাজে লাগাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। কেননা, বিশেষ বিধান সম্পর্কে মানুষকে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যায়নি। আইনে বলা আছে— আদালতের সম্মতি নিয়ে আসতে পারলে তবেই ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যাবে।

বাল্যবিবাহ নিয়ে কাজ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইসরাত হাসান। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে নতুন যে আইন করা হয়েছে ২০১৭ সালে সেখানে বাল্যবিবাহকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু এখানে আইনের অনেকগুলো ফাঁক রয়ে গেছে। ১৮ নম্বর ধারায় সময়সীমা দেওয়া হয়েছে দুই বছর। ওই অপরাধ সংঘটিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে মামলা না করলে কোর্ট বা আদালত এ মামলা আমলে নিতে পারবে না। তাহলে কী দাঁড়াল? অপরাধ করে দুই বছর পার করতে পারলেই হলো। এজন্য সময়সীমা রাখা উচিত হয়নি।

‘তারপর আইনে বলা হলো— মা-বাবা আবেদন করলে ১৬ বছর হলেও বিয়ে দিতে পারবে। যেখানে বাংলাদেশি শিশু আইনের সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে— ১৮ বছর পর্যন্ত যে কেউ শিশু। তাহলে ১৬ বছরে বিয়ের অনুমতি দিচ্ছে কীভাবে? যেটা একটা আইনের সঙ্গে আরেকটা আইনের সাংঘর্ষিক। আইনের এই মারপ্যাচের প্রয়োজন ছিল না।’

ইসরাত হাসান বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭–তে জাতীয় থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। আইনে বলা হয়েছে— কমিটির কাজের জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে কমিটির জবাবদিহিতা নেই। আইন প্রয়োগের কড়াকড়ি নেই। শুধু তাই নয়, বাল্যবিবাহে অনেক ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন সম্ভব হয় না। কারণ, রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে ডকুমেন্ট দরকার সেটা থাকে না। এর ফলে হয় তারা জালিয়াতির মাধ্যমে ডকুমেন্ট বানায় বা তাদের আসল ডকুমেন্ট থাকে না। কারণ ১৮ বছরের নিচে কেউ নিকাহ বা বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে না। বিয়ের রেজিস্ট্রেশন না থাকায় পরবর্তীতে কেউ যদি মামলা করতে আসে দেখা যায়, তার কাবিননামা নেই। তার বিয়ের কোনো প্রমাণ নেই।

এ আইনজীবী বলেন, এই যে কোনো প্রমাণ থাকে না এতে করে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে, তখন একটা মেয়ের পক্ষে তাকে স্বামী হিসেবে প্রমাণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। মেয়ের আইনগত অধিকার নষ্ট হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এগুলোর আইনগত জটিলতা আরও প্রবল। চূড়ান্ত বিপদটা কিন্তু মেয়েটার হয়ে থাকে।

কী বলছে মানবাধিকার কমিশন

বাল্যবিবাহের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের অবস্থা যে খারাপের দিকে যাচ্ছে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা অত্যন্ত শঙ্কার। বাল্যবিবাহ আমাদের এখানে অনেক বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে এতটা নেই। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। একটা মেয়ের কম বয়সে বিয়ে মানে তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাওয়া।

কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, নারীদের ওপর যে সহিংসতার কথা বলা হয়, এগুলোর মূলে কিন্তু বাল্যবিবাহ। মেয়েটার কিছু করার থাকে না। যেহেতু করোনার পর বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে, এখন যত দ্রুত সম্ভব সচেতনতা বাড়াতে হবে। যদি পরিবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা এটার বিরুদ্ধে থাকে তাহলে বাল্যবিবাহ আর আগাতে পারবে না। আমি মনে করি, সচেতনতার জায়গা আগের তুলনায় অনেক ভালো। আমরা গ্রামভিত্তিক ১২ থেকে ২১ বছরের মেয়েদের সংখ্যা নির্ধারণ করার পর কমিটি করি। তাদের বলা হয় বাল্যবিবাহ যেন না হয় সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে। কাজিদের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে, তারা বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে কি না বা ঠিকমতো এনআইডি ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, জন্ম নিবন্ধনের বিষয়টা নিশ্চিত করছে কি না। আমরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী এবং কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। বাল্যবিবাহ যারা করবে বা উৎসাহ দেবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার ৯টি গ্রামকে বাল্যবিবাহ মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সারা দেশে ২১৭টি গ্রামকে যে কোনো সময় বাল্যবিবাহমুক্ত ঘোষণা করা হবে।

প্রশাসন কী বলছে

২০১৮ সালের এক কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনার একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। এ ছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করার কথাও বলা হয়েছিল। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের আওতায়ও ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসব লক্ষ্য অর্জনে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেসা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। করোনার সময়ে বাল্যবিবাহ কিছুটা বাড়লেও এখন সেটা দৃশ্যমান নয়। এ বিষয়ে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো চলমান আছে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে।

জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান চেমন আরা তৈয়ব বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ে সরকার কঠোর একটা আইন প্রণয়ন করেছে। সেই আইনটা বাস্তবায়ন করতে হবে সাধারণ জনগণকে। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় তৃণমূল পর্যায় থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেম্বারদের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করছি। কোভিডের সময় যেটা বেড়েছিল সেখান থেকে আমরা অনেকটা বের হয়ে এসেছি।

মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান বলেন, এখন সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। সরকার যে আইন করেছে, এটা বার বার প্রচার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন করতে হবে। বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।

মুঠোফোনে বাল্যবিবাহ ও কাজির কারসাজি

প্রযুক্তির আশীর্বাদে পাত্র-পাত্রীর উপস্থিতি ছাড়াই অহরহ বিয়ের ঘটনা ঘটছে। পাত্রী দেশে, পাত্র দেশের বাইরে। দুই প্রান্ত থেকে মুঠোফোনে ‘কবুল’ বলার মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে বিয়ে। মুঠোফোনের এসব বিয়ের অনেকগুলোই বাল্যবিবাহ।

লক্ষীপুরের বাসিন্দা মো. জসিম উদ্দিন, থাকেন সৌদি আরবে। সৌদি থেকে পরিবারের সম্মতিতে মুঠোফোনে বিয়ে করেছেন ১৬ বছর বয়সী এক মেয়েকে। জসিমের বড় বোন সুন্নাহ আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ভাই-বোনদের সবার বিয়ে সম্পন্ন হলেও ছোট ভাইটার বিয়ে বাকি ছিল। মায়ের অনুরোধে মেয়ে দেখে মোবাইলে ছোট ভাইকে বিয়ে করিয়েছি।

বাংলাদেশে মেয়েরা বিয়ের যোগ্য হয় ১৮ বছর বয়সে। সেক্ষেত্রে ১৬ বছরের মেয়েকে বিয়ে করানোর প্রক্রিয়া জানতে চাইলে সুন্নাহ বলেন, মেয়ের বাবা তার পরিচিত এক কাজিকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। কাবিননামাসহ অন্যান্য কাগজপত্রে বিয়ের তারিখটা বসানো হলেও খালি রাখা হয়েছে বিয়ে অনুষ্ঠানের সাল। মেয়ের বয়স ১৮ পূর্ণ হলে কাজী কাবিননামায় সালটা বসিয়ে দেবেন। কাজিকে কিছু বাড়তি টাকা দেওয়ায় কাজটা করে দিয়েছেন। 

এছাড়া ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে অনেক পরিবার। তাদেরই একজন কুমিল্লার শাসনগাছার বাসিন্দা সালেহা বেগম। তিনি দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। 
সালেহা জানান, তিনি মেয়েদের জন্ম নিবন্ধনে বয়স পরিবর্তন করিয়ে নিজ এলাকা থেকে অনেক দূরে আত্মীয়র বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে মেয়েদের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন।

দীর্ঘ মেয়াদে কী কী কুফল বয়ে আনে?

বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা শারীরিক ও মানসিক দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শারীরিক ক্ষতিগ্রস্তের দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যাডলসেন্ট গাইনোকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের (পিএজিএসবি) মহাসচিব ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গুলশান আরা বলেন, বাল্যবিবাহের পর বহু মেয়ে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এতে তাদের নানারকম জটিলতা দেখা যায়। তারা অপুষ্টিতে ভোগে এবং শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। তারা বেশিরভাগই শারীরিকভাবে দুর্বল বোধ করে।

তিনি বলেন, বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের গর্ভজাত বাচ্চার যেভাবে বেড়ে ওঠা প্রয়োজন সেটা হয় না। অনেক সময় গর্ভপাত হয়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, ঠিকমতো গ্রোথ না হলে পেটে বাচ্চা মারা যায়। এ ছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে হলে একলামসিয়া নামক রোগ বেশি হয়। উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। শরীরে আরও যে সমস্ত সিস্টেম আছে সেগুলোকেও বাধাগ্রস্ত করে। যেমন- কিডনির সমস্যা হয়। এছাড়া শারীরিক পূর্ণতা না পাওয়ায় ডেলিভারির সময় নানা সমস্যা হয়।

মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের একটা প্রবণতা হচ্ছে, মেয়েরা পরের বাড়ি চলে যাবে, ছেলেরা সংসারে থাকবে। এই যে একটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং মানসিক কাঠামো, এটার কারণে বাবা-মা ছোটবেলা থেকে চিন্তায় থাকে কখন মেয়েটাকে ভালো পাত্রে পাত্রস্থ করা যায়। আবার আমাদের দেশে একটা ধারণা আছে বিয়ে করার পরও মেয়েরা পড়তে পারবে। কিন্তু পরিবার সামলানোর পর শ্বশুর বাড়ির পরিবেশ তার পড়ালেখার জন্য উপযুক্ত হয় না।

প্রফেসর তাজুল ইসলাম বলেন, যদি মানসিক অবস্থার কথা বলি— বিয়ে দেওয়ার জন্য একটা মেয়ের মানসিক একটা পরিপক্কতা অর্জন করতে হয়। কিন্তু তা অর্জনের আগে তার ওপর দায়িত্ব বা বোঝা চাপিয়ে দিলে সে কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়ে। শ্বশুর বাড়ির চাপ, সন্তান হলে তার চাপ; সব মিলিয়ে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়ে যায়। আমাদের অনেক রোগী আসে দেখা যায়, অল্প বয়সে বিয়ের কারণে স্বামী সংসার ছেড়ে বাবার পরিবারে ফেরত আসে। এ রকম অনেক মানসিক রোগী পাই আমরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জীবন বা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনীহা দেখা যায়। অনেক রোগীর অবস্থাটা এমন যে না পারে বাবার বাসায় থাকতে, না পারে শ্বশুর বাড়ি থাকতে। মেয়েগুলো একটা অথৈ সাগরে পড়ে যায়।

তিনি বলেন, মা-বাবারা বুঝতে চান না তার মেয়েটা এখনো পরিণত হয়নি বা সামাজিকভাবে দক্ষ হয়নি। পরবর্তীতে যখন মানসিক সমস্যা গভীর হয় তখন আমাদের কাছে নিয়ে আসে। এভাবে অনেকে মানসিক রোগী হয়ে যায়। তাদের সংসার ভেঙে যায়। কেউ তাদের দায়িত্ব নিতে চায় না।

বাল্যবিবাহে এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ : ইউএনএফপিএ

চলতি বছরের এপ্রিলে ‘এইট বিলিয়ন লাইভস, ইনফিনিট পসিবিলিটিজ’ শিরোনামে বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ বৈশ্বিকভাবে প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএফপিএ)। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিয়ে বলা হয়েছে— বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে এখন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম বাল্যবিবাহ ঘটছে মালদ্বীপে। মাত্র ২ শতাংশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০, পাকিস্তানে ১৮, ভারতে ২৩, ভুটানে ২৬, আফগানিস্তানে ২৮ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে।

প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ইউএনএফপিএ’র প্রতিনিধি ক্রিশ্চিন ব্লুখস ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ অংশের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এশিয়ায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছে। বাল্যবিবাহ বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। বাল্যবিবাহের সার্বিক প্রভাব পড়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে। বাল্যবিবাহের কারণে মা ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে।

বিবিএস এবং বিডিএইচএস-এর জরিপ কী বলছে

চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল স্ট্যাটিসটিকস ২০২২’-এর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরুষের বিবাহের গড় বয়স এখন ২৫ দশমিক ৩ বছর। নারীর বেলায় তা ১৮ দশমিক ৮ বছর।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, গত বছর যাদের বিয়ে হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বয়স ছিল ১৫ বছরের নিচে। আর ১৮ বছরের কম বয়স ছিল ৪০ দশমিক ৯ শতাংশের।

অন্যদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২– এর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশের বেশি। বিডিএইচএস-এর ২০১৭-১৮ সালের প্রতিবেদনে বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৫৯ শতাংশ ছিল।

ব্র্যাকের জরিপ

বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ খুঁজে বের করতে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দেশের ২৭টি জেলার ২ হাজার ৮০ গ্রামের ৫০ হাজার পরিবারের ওপর জরিপ পরিচালনা করেছে ব্র্যাক। ‘বর্ন টু বি আ ব্রাইড’ শিরোনামে জরিপ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি।

জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ৭ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সী। ৭০ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে।

ব্র্যাকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জরিপ হওয়া ২৭টি জেলার মধ্যে পিরোজপুরে ৭৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৬৫ শতাংশের বেশি, নওগাঁয় ৬৫ শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ৬৩ শতাংশ এবং জয়পুরহাটে ৬১ শতাংশের বেশি বাল্যবিয়ে হচ্ছে।

এনআই/এমজে