দীর্ঘদিন ধরে নানারকম দূষণে ভুগছে রাজধানী ঢাকা। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ কিংবা রেডিয়েশনকোনোকিছুতেই পিছিয়ে নেই এ শহর। শুধু ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য শহর এমনকি গ্রামেও দূষণের কবলে পড়ছে মানুষ। অতি দূষণের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গর্ভবতী মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যের ওপর।

শিশুদের ক্ষেত্রে প্রি-ম্যাচিউরড জন্মগ্রহণ এবং নানারকম প্রতিবন্ধিতায় আক্রান্ত হওয়ার জন্য এসব বহুমুখী দূষণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখ শিশুর মধ্যে ১ হাজার জনের অটিজম বা প্রতিবন্ধিতার বৈশিষ্ট্য আছে বলে এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

বায়ু মানের সূচক (একিউআই) অনুযায়ী বায়ু দূষণে ঢাকার অবস্থান বিশ্বের মধ্যে কখনো দ্বিতীয় আবার কখনো তৃতীয় হয়। একিউআই সূচকে ঢাকা সবসময় ২০০ বা তার বেশি নেতিবাচক অবস্থানে থাকে। আবার শব্দ দূষণেও জেরবার ঢাকাবাসী। শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ২ গুণ বেশি মাত্রা মিলছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে। আগে যেখানে দিনে গড়ে ১২ ঘণ্টা ধরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ দূষণ হতো, সেখানে এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ এখানেও অতি দূষণ হচ্ছে। এর ফলে নাগকিদের মেটাবলিক সিস্টেম বা খাদ্যের হজম প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির অভিশাপের তালিকায় নতুন সংযোজন রেডিয়েশন। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ু দূষণ ও শব্দ দূষণের চাইতেও ভয়াবহ দূষণ হলো মোবাইল টাওয়ার, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, টেলিভিশন ও বিদ্যুতের লাইনের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন। যা মানুষের ব্রেইন টিউমার, ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, হৃদরোগ ও গর্ভপাতসহ অনেক জটিল রোগের কারণ। অর্থাৎ এই তিন ধরনের দূষণই অটিস্টিক শিশুর জন্মহার বৃদ্ধির পাশাপাশি মাতৃস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

ন্যাশনাল একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজএবিলিটিজের (এনএএএনডি) কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ড. এম সেলিম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, অটিজমের ঝুঁকির সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। জেনেটিক একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, মেটাবলিক সিস্টেম একটি বিষয় এবং হাইপার অ্যাক্টিভিটিজ হয় এমন কিছু বিষয় অটিজমের ঝুঁকির কারণ।

তিনি বলেন, বায়ু দূষণ কিংবা শব্দ দূষণ কোনো না কোনোভাবে মেটাবলিক সিস্টেমকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। আমরা যদি ঢাকায় বসবাসরত শিশুদের কথা বিবেচনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই বায়ু ও শব্দ দূষণের প্রভাবে এই শিশুদের ওপর বায়োলজিক্যাল প্রভাব পড়ছে। শিশুদের শব্দ সেনসেবিলিটি ও মেটাবলিক সিস্টেমের সেনসিবিলিটি রয়েছে। যার কারণে শিশুদের আচরণগত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক বিকাশের উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হচ্ছে। আর অটিজম বা নিউরো ডেভেলপমেন্টে ডিজএবিলিটির সঙ্গে রেডিয়েশনের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। এটা প্রমাণিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাইদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বায়ু দূষণ ও পরিবেশ দূষণের সঙ্গে অটিজমের একটা সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশ দূষণে ভারী কিছু ধাতু থাকে, সেগুলো বাতাসে মিশে গিয়ে গর্ভাবস্থায় শিশুর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সেটা শুধু অটিজম নয়, মানসিক বিকাশজনিত রোগও সৃষ্টি করে। বায়ু দূষণসহ অন্যান্য দূষণের কারণে শিশুর নিউরো ডেভেলপমেন্টে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। গর্ভাবস্থায় নবজাতকের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে বায়ু দূষণ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, আমরা অপরিকল্পিতভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন কাজ করছি। এতে আমাদের আর্থিক সক্ষমতা ও বিলাসিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করার কারণে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। যা পূর্বে ছিল না, এমন অনেক কিছু এখন যোগ হয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আমাদের মাটি, পানি, বায়ু কিংবা শব্দসহ অন্যান্য বিষয়কে দূষিত করে তুলছে। এটা সম্মিলিতভাবে জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। শুধু এককভাবে পরিবেশ দূষণ নয়, আমাদের খাদ্যাভ্যাসও স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি করছে। অতি দূষণের সম্মিলিত ফল হচ্ছে জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয়; যার একটি হচ্ছে অটিজম।

বায়ু দূষণ, মাতৃস্বাস্থ্য অটিজম

প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা বায়ু মানের সূচক (একিউআই) একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয়। একিউআই অনুসারে বায়ু দূষণে রাজধানী ঢাকার অবস্থান বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয়। আর সূচক সব সময়েই ২০০ বা তার বেশি থাকে। সূচক যত বেশি তত বায়ুর মান খারাপ বোঝায়।

বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বায়ু দূষণজনিত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। দূষিত বায়ুর কারণে ২০১৭ সালে দেশে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ।

পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান তিনটি উৎস হলো-  ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলো। যার প্রভাবে ঢাকার চারদিকে কুয়াশার মতো ধূলিকণা ভাসছে। আশঙ্কার কথা হলো, সম্প্রতি গবেষকরা ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ঢাকাবাসীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে রাজধানীর বাতাসের বিষে চরম ঝুঁকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। যার মধ্যে অন্যতম হলো গর্ভে পূর্ণ সময় থাকার আগেই শিশুর জন্ম এবং দূষণের শিকার মায়েদের কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়া কিংবা অটিস্টিক শিশুর জন্ম হওয়া।

গর্ভাবস্থায় বায়ু দূষণ ও অটিজমের যোগসূত্রের বিষয়ে ২০১৫ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পার্সপেক্টিভ নামে জার্নালে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের একটি গবেষণা টিম ১ হাজার ৭৬৭ শিশুর ওপর জরিপ চালায়।

প্রাপ্ত ফলাফলে বলা হয়, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের মধ্যে ২৪৫ জন অটিজমে আক্রান্ত এবং ১ হাজার ৫২২ জন স্বাভাবিক। যেসব শিশু অটিজমে আক্রান্ত তাদের মা গর্ভকালীন সময়ে এমন পরিবেশে ছিলেন, যেখানে উচ্চ মাত্রার দূষণ ছিল।

গবেষকরা বলছেন, উচ্চ মাত্রার দূষণ অটিজমের সম্ভাবনা দ্বিগুণ করে দেয়। বায়ুতে মিশে থাকা দূষিত ক্ষুদ্র কণা ফুসফুস থেকে রক্তে প্রবাহিত হয়ে শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৩.৭ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর'বি) গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় কম বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের তুলনায় অধিক বায়ুদূষণে ভোগা মায়েদের ‘প্রিটার্ম বার্থ’ (সময়ের আগে জন্মদান) ও কম ওজনের বাচ্চা প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেশি।

২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া ৩ হাজার ২০৬টি নবজাতককে নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি। অকালে সন্তান জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি। তুলনামূলকভাবে বেশি দূষণের শিকার মায়েরা বেশিসংখ্যক কম ওজনের শিশু জন্ম (লো ওয়েট বার্থ) দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে সময়ের আগে সন্তান জন্ম (প্রিটার্ম বার্থ) দেওয়ার হারও বেশি।

ঢাকার বায়ু দূষণের প্রধান তিনটি উৎস হলো-  ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণকাজের ধুলো। যার প্রভাবে ঢাকার চারদিকে কুয়াশার মতো ধূলিকণা ভাসছে। আশঙ্কার কথা হলো, সম্প্রতি গবেষকরা ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। ঢাকাবাসীর নিঃশ্বাসের সঙ্গে ওই কণা শরীরে প্রবেশ করছে

গবেষকরা বলেন, একজন নারী তার গর্ভধারণকালে (৯ মাসে) কত দিন বায়ুদূষণের শিকার হয়েছেন তা সরাসরি পরিমাপ করা যায়নি। ৯ মাসের প্রতিদিন এবং ৩ হাজারের বেশি নারীর প্রত্যেকের ক্ষেত্রে কাজটি করা সময়সাপেক্ষ ও জটিল। তবে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দিনে একজন মানুষ কতটা দূষণের শিকার হতে পারে তা পরিমাপ করা সম্ভব। এভাবে গর্ভধারণের পুরো ৯ মাসে মোট দূষণের পরিমাণ বের করেছেন গবেষকরা।

চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার ২০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ।

কোনো শিশুর জন্ম মায়ের গর্ভধারণের পর থেকে ২৫৯ দিনের আগে হলে তা অকালিক শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়। গবেষকরা দেখেছেন, সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েরা ৯ শতাংশ অকালিক শিশুর জন্ম দিয়েছেন। বেশি দূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে এই হার ১৫ শতাংশ।

অন্য এক গবেষণায় উঠে আসে, বাতাসে থাকা অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পিএম ২.৫) কারণে ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে আনুমানিক ২৮ লাখ কম ওজনের ও ৫৯ লাখ অকালিক শিশুর জন্ম হয়েছিল। সময়ের আগে জন্ম নেওয়া এবং কম ওজন অর্থাৎ অপরিণত জন্ম বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। আর বাংলাদেশে প্রতি ৪০টি নবজাতকের একটি জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে মারা যায় অপরিণত অবস্থায় জন্মের কারণে।

বায়ু দূষণ ও শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসঙ্গে একাডেমি ফর অটিজম অ্যান্ড নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজএবিলিটিজের (এনএএএনডি) কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ড. এম সেলিম চৌধুরী বলেন, বায়ু দূষণের ফলে বর্তমানে বাচ্চাদের দ্রুত ঠান্ডা লাগার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা কমন একটি বিষয়। যত বেশি অসুস্থ হবে তত তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আর ঠান্ডাজনিত রোগ নিরাময়ে যে ওষুধ দেওয়া হয় সেটি শিশুর মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে। বায়ু দূষণে শিশুর নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হয় অর্থাৎ মস্তিষ্ক যতটুকু অক্সিজেন পাওয়ার কথা সেটা পায় না। অক্সিজেন না পেলে শিশুর মস্তিষ্ক যথাযথভাবে বৃদ্ধি পাবে না। বায়ু দূষণের কারণে শিশু ব্রনকাইটস ও শ্বাসকষ্টজনতি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিএসএমএমইউর সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাইদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়নের ফলে নবজাতক শিশুর বিকাশজনিত রোগ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। যা সময়ের সাথে সাথে আরও বেড়ে যাচ্ছে। যদিও এটা যে অটিজমের জন্য দায়ী, সেটা সরাসরি বলতে পারছি না। কারণ এখনো পূর্ণাঙ্গ গবেষণা হয়নি। কিছু গবেষণা হয়েছে, আমি মনে করি আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে এটা সত্যি অতি দূষণের সঙ্গে শিশু স্বাস্থ্যের অবশ্যই সম্পর্ক রয়েছে।

শব্দ দূষণে গর্ভবতী নারী শিশুর ঝুঁকি

শব্দ দূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী, ঢাকার জন্য দিনের বেলায় শব্দের আদর্শ মান (সর্বোচ্চ সীমা) ৬০ ডেসিবল। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে শব্দের তীব্রতা মানমাত্রা ছাড়িয়েছে। নগরের বিভিন্ন স্থানে সাধারণভাবে শব্দের গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার থেকে প্রায় ১.৩ থেকে ২ গুণ বেশি শব্দ পাওয়া গেছে।

রাজধানীতে আগে গড়ে ১২ ঘণ্টা সময় ধরে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ দূষণ হতো। এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থলের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৫টি স্থান ছিল। ওইসব স্থানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬.৮০ ডেসিবল আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা ৮০.৫৬ ডেসিবল পাওয়া গেছে। শব্দ দূষণের উৎসগুলো হলো- যানবাহন চলাচলের শব্দ (হর্ন, ইঞ্জিন, চাকার ঘর্ষণ ও কম্পনের শব্দ), নির্মাণকাজ যেমন ইট ও পাথর ভাঙার মেশিন ও টাইলস কাটার মেশিন থেকে শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানার শব্দ, জেনারেটরের শব্দ ও সামাজিক নানা অনুষ্ঠানের মাইকিংয়ের শব্দ।

শব্দ দূষণের ফলে শ্রবণ শক্তি কমে যাওয়া, বধিরতা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, কম ঘুম হওয়া, হৃদরোগ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্ন হওয়াসহ নানা রকম সমস্যা দেখা যায়। আর উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা, হৃদরোগীর জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের মানসিক বিকাশ। যার সঙ্গে অটিজমের ঝুঁকি জড়িত।

এ বিষয়ে ড. এম সেলিম চৌধুরী বলেন, আমাদের ব্রেনেরও শব্দ সহনশীলতার মাত্রা রয়েছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত বেশি শব্দের মধ্যে থাকছি। এতে আমাদের ব্রেইন হাইপার হয়। ব্রেইন অতিরিক্ত হাইপার হওয়ার কারণে কাজে মনোযোগ দিতে পারি না। পারিবারিক কলহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে আন্তঃসম্পর্কের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। একইভাবে গর্ভবতী মায়ের ব্রেইন যখন বায়ু কিংবা শব্দ দূষণে অতিরিক্ত হাইপার থাকে তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়ে। আমরা জানি, গর্ভাবস্থায় শিশুর প্রতিটি অর্গান সক্রিয় থাকে। সেই সময় যদি অসহনশীল শব্দ পায়, তাহলে ওই বাচ্চার অতিরিক্ত হাইপার অ্যাক্টিভিটি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর নেতিবাচক প্রভাব আমরা দেখতে পাব। অর্থাৎ শব্দের সঙ্গে ব্রেইনের সুস্থ বিকাশের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, শব্দের সঙ্গে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডারের (এডিএই্চডি) সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এডিএই্চডি অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ। এটি বর্তমানে আমাদের সমাজে প্রবল আকারে দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ শব্দ দূষণ। যেমন, একটি শব্দ-সংবেদনশীল শিশু যখন রাস্তায় বের হয়, তখন উচ্চমাত্রার শব্দ দূষণে তার আচরণগত হাইপার অ্যাক্টিভিটি বাড়িয়ে দেবে। তার মধ্যে অস্থিরতা অনেক বেশি দেখা দেবে। শিশুটির আচরণ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। তার মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু তাই নয় তার মানিসক বিকাশ উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হবে। এটা প্রমাণিত সত্য।

রেডিয়েশন অটিজম ঝুঁকি

জীবনকে সহজ করতে আমরা হরেক রকমের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি। যার মধ্যে রয়েছে, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, স্মার্টফোন, টিভি, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ওয়াইফাই ইত্যাদি। আর আছে পুরো দেশজুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মোবাইল টাওয়ার। কিন্তু এসব ডিভাইস থেকে বিচ্ছুরিত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনই প্রতিনিয়ত শরীরের ক্ষতি করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের প্রভাবে শরীরের মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, অনিদ্রা, দেহের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, শুক্রাণু মান ও সংখ্যা হ্রাস, বন্ধ্যাত্ব ও গর্ভপাত, ব্রেন টিউমার এমনকি ক্যান্সারও। যার প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ১৯৮০ সালে প্রতি ৫০০ জনে একজন শিশু অটিজম আক্রান্ত হতো, যা এখন প্রতি ৬৮ জনে একজনে দাঁড়িয়েছে। যার অন্যতম কারণ রেডিয়েশন।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সড়কের মোট ৮২টি সংযোগস্থলের শব্দের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৩৭টি এবং উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ৪৫টি স্থান ছিল। ওইসব স্থানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় শব্দের গড় মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬.৮০ ডেসিবল আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শব্দের গড় মাত্রা ৮০.৫৬ ডেসিবল পাওয়া গেছে

বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ ও শব্দ দূষণের চাইতেও ভয়াবহ দূষণ হলো রেডিয়েশন। ২০১৩ সালে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডস (ইএমএফ) রেডিয়েশন বিশেষজ্ঞ ডা. মার্থ হারবার্ট তার গবেষণাপত্রে অটিজমের সঙ্গে রেডিয়েশন দূষণের যোগসূত্র দেখিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ড. গোলাম মোহাম্মদ ভূঞা তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, রেডিয়েশন সবার জন্যই ক্ষতিকারক। বাচ্চাদের শরীরে ফ্লু্ইড বেশি থাকায় তারা বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। শিশুদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও এ রেডিয়েশন ভূমিকা রাখার আশঙ্কা আছে। এর বাইরে যে কারো মধ্যেই জেনেটিক পরিবর্তন, অবসন্নতা, লিউকেমিয়াসহ আরও কিছু রোগের ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে রেডিয়েশনের কারণে।

রেডিয়েশন সম্পর্কে এনএএএনডির কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ড. সেলিম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেডিয়েশন নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি গবেষণা হয়েছে। তারা প্রমাণ করে দিয়েছে অটিজম বা নিউরো ডেভেলপমেন্টে ডিজএবিলিটির সঙ্গে রেডিয়েশনের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। সেটা হতে পারে, মোবাইল টাওয়ার, টিভি, মোবাইল ও ল্যাপটপসহ এরকম যেকোনো বিভিন্ন ডিভাইসের রেডিয়েশন। বিশেষ করে বর্তমানে বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ওই মোবাইল থেকে যে রেডিয়েশন বিচ্ছুরিত হচ্ছে, তা শিশুর ব্রেইনকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। তাদের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। বিশেষ করে দুই থেকে আড়াই বছরের বাচ্চাদের এমন ঝুঁকির মাত্রা বেশি। এজন্য আমাদের প্রত্যক্ষ গবেষণা হওয়া দরকার এবং গবেষণার আলোকে নীতিমালা হওয়া দরকার।

রেডিয়েশন সম্পর্কে বিএসএমএমইউয়ের সহকারী অধ্যাপক ডা. সিফাত ই সাইদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নবজাতকের ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের নেতিবাচক প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রেডিয়েশন থেকে বাঁচানোর জন্য গর্ভাবস্থায় মায়ের এক্সরে করা হয় না। রেডিয়েশনের প্রভাব নতুন কিছু নয়, এটা ক্ষতিকর যা এরই মধ্যে প্রমাণ হয়েছে। আর প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত ডিভাইস ও যন্ত্রপাতি থেকে বিচ্ছুরিত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নবজাতকের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।

-বর্জ্যও গর্ভবতী মা শিশুর ক্ষতির কারণ

২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে। ২০৩৫ সাল নাগাদ এই ই-বর্জ্য বছরে ৪৬ লাখ টনে দাঁড়াবে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছরে দেশে ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিং শিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে।

ই-বর্জ্য গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং নবজাতক শিশুর জন্য। গবেষণায় দেখা গেছে, ই-বর্জ্যের প্রভাবে মানুষের বিভিন্ন টিস্যু, অঙ্গ এবং সিস্টেম বিষাক্ত হচ্ছে। যা শ্বাসযন্ত্র, অন্তঃস্রাব, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্নায়ু, মূত্রতন্ত্র এবং প্রজনন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এর সঙ্গে অটিজমেরও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই বছরের ১৫ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হয়, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।

প্রতিবেদনে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদরোস আধানম গেব্রেয়াসুসকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, পৃথিবীজুড়ে ‘ই-বর্জ্যের সুনামি’ চলছে। মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়ছে। যে কারণে ই-বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান হুমকি থেকে মূল্যবান সম্পদ ও শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি জোর দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, মোবাইল টাওয়ার, মোবাইল, ওয়াইফাই ও টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের রেডিয়েশনও শিশু মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমনকি ওই সব ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহারের পর ই-বর্জ্যও আমাদের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে। যা এখন গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে। পরিত্যক্ত এসব বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে বিষাক্ত বাতাসে শিশুরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

অটিজম কী?

অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার স্নায়ু বিকাশজনিত সমস্যা। অটিজমের আবিষ্কারক অস্ট্রীয়-আমেরিকান মনোচিকিৎসক ড. লিও ক্যানারের মতে, অটিজম বিরল ধরনের এক প্রকারের বৈকল্য। অটিজমের কোনো দেশ, সীমানা বা বর্ডার নেই, জাতীয়তা নেই, জাতিগত বা সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে একে দেখার কোনো উপায়ও নেই।

বিজ্ঞানীদের মতে, এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে পাঁচ ধরনের অটিজমের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অ্যাস্পারগারস সিনড্রোম, পারভেসিব ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, অটিস্টিক ডিসঅর্ডার এবং রেটস সিনড্রোম ও চাইল্ডহুড ডিসইন্টিগ্রেটিভ ডিসঅর্ডার বিরল শ্রেণির। ২০১৩ সালের মে মাসের পর অটিজমের সবকটি প্রকারকে একটি স্পেকট্রামের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এখন থেকে অটিজমের শিকার প্রত্যেকেই ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার, সংক্ষেপে ‘এএসডি’ নামে পরিচিত।

আরএম/এসকেডি