আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেবে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে এমন কৌশল নিয়েছে দলটি। তবে, দলীয় প্রতীক না থাকলেও বর্তমান সংসদ সদস্যদের (এমপি) হাতেই থাকছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থিতা হওয়ার লাগাম। দলের হস্তক্ষেপ না থাকায় সংসদ সদস্যরাই এ বিষয়ে ‘অঘোষিত ক্ষমতা’ পেয়ে যাবেন বলে মনে করছেন দলটির অনেক নেতা।

তারা মনে করছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকলে প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। এখন কে, কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? তারা আরও জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের প্রভাব থাকবে, এটা স্বাভাবিক। তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করবেন। যদিও আইনে বাধ্যবাধকতা আছে। সংসদ সদস্যরা চাইলে ঢাকায় বসেও তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। দলের পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না, সংসদ সদস্যদের প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে সেই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব নাও হতে পারে— মনে করছেন তারা।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের দলীয় প্রতীক না থাকায় প্রার্থীদের ওপর সংসদ সদস্যদের প্রভাব থাকবে কি না— ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো বড় কাজ করতে হলে, ছোট ছোট কিছু বিষয় আছে, সেগুলো এর মধ্যে এসে পড়ে। কারও ইচ্ছায় নির্বাচন প্রভাবিত হবে, এর কোনো কারণ নেই। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী, এবার তারা প্রমাণ দিয়েছে। তারা আরও শক্তিশালী হবে। আরও বেশি করে তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালন করতে পারবে। এটা হলে সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরও বেশি কল্যাণকর হবে, নির্বাচনব্যবস্থা আরও বেশি শক্তিশালী হবে।’

প্রতীক না দিলে প্রার্থীদের ওপর দলীয় সমর্থন থাকবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা কোনো প্রকার সমর্থন দেব না। জনগণ যাকে পছন্দ করবে তাকে নির্বাচিত করবে। যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারবে।’

স্থানীয় সরকার (উপজেলা) (সংশোধন) বিল ২০১৫-তে  বলা হয়েছে, ‘উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ ও সংরক্ষিত) পদের নির্বাচনের জন্য প্রার্থীকে রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে।’ আইনটি পাস হওয়ার পর ২০১৭ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হয় উপজেলায়। এরপর থেকে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়। তবে, ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ওই সময়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে কোনো দলীয় প্রার্থী রাখা হয়নি। তবে, চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন হয়।

গত ২২ জানুয়ারি রাতে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, উপজেলা নির্বাচনে আমরা দলীয় প্রতীকে প্রার্থিতা দেব কি না— ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সবাই মত দেন যে, এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নৌকা ব্যবহার করা হবে না। আমাদের সভাপতি শেখ হাসিনাও সবার অভিমতের সঙ্গে ভিন্ন মত প্রকাশ করেননি।

সভায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে জানান, সভায় উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেখানে দলীয় প্রতীকের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেন নেতারা। তবে, বেশির ভাগ নেতা দলীয় কোন্দল ও সংঘাত থেকে নেতাকর্মীদের দূরে রাখতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক না রাখার পরামর্শ দেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও নেতাদের এ মতামতের প্রতি সমর্থন জানান।

দলীয় প্রতীক না থাকলে সংসদ সদস্যদের আধিপত্য বিস্তারের কোনো প্রবণতা থাকবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষ কাউকে না কাউকে সমর্থন করবে। প্রকাশ্যে না করলেও মনে মনে করবে। আর এমপিরা তো নির্বাচনের কোনো প্রচারে যেতে পারবেন না। ঘরে ডেকে যদি কেউ কাউকে সমর্থন করেন, সেটা তো দেখার বিষয় না। প্রকাশ্যে স্থানীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা কাউকেই সমর্থন দিতে পারবেন না। কারও পক্ষে প্রচার-প্রচারণা করতে পারবেন না। তবে, স্থানীয় রাজনীতিতে পছন্দের প্রার্থী থাকতেই পারেন, সংসদ সদস্যরা মনে মনে কাউকে পছন্দ করতেই পারেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তিনি কিছু করতে পারবেন না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থাৎ উপজেলা নির্বাচনে কারও প্রতি আমাদের সমর্থন থাকছে না।’

উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আলমগীর জানান, আগামী এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে শুরু হয়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ধাপে ধাপে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল ঘোষণা হবে ঈদুল ফিতরের পর। সামনে এসএসসি পরীক্ষা, এরপর রমজান। ঈদের পরই যাতে নির্বাচন হয়, সেভাবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহের মধ্যে এটা শেষ করব।’

তিনি আরও জানান, উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) হতে পারে, ব্যালটেও হতে পারে। আবার ব্যালট ও ইভিএমের সমন্বয় থাকতে পারে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। ইভিএম কী পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য, সেই হিসাব এখনও পাইনি। এটা পেলে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব।

দলীয় প্রতীকে ভোট না হওয়া প্রসঙ্গে ইসি আলমগীর বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দেবে না, এ ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মন্তব্য নেই, সমস্যাও নেই।

আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনের আদলেই হচ্ছে। আমরা দলীয় প্রতীক দিচ্ছি না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের কোনো প্রতিনিধি থাকেন না। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কিন্তু সংসদ সদস্যরা থাকছেন। তিনি চাইলে ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন। অতীতেও করেছেন, সুযোগ পেলে ভবিষ্যতেও করবেন। তবে, দলের যে সিদ্ধান্ত সেটা বাস্তবায়নের জন্য দলীয় এমপিদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এমপিরা যাতে কাউকে সমর্থন দিতে না পারেন, সে বিষয়েও খোঁজখবর রাখতে হবে— জানান তারা।

তাদের ভাষ্য হলো, অনেক স্থানে স্বতন্ত্র এমপি রয়েছেন। তারা চাইবেন, তাদের পছন্দের লোক চেয়ারম্যান হোক। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যিনি হেরেছেন তিনিও চাইবেন তার লোক চেয়ারম্যান হোক। এতে প্রতিযোগিতা যেমন বাড়বে, তেমনি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান অনেক উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বিপক্ষে কাজ করেছেন। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অনেক স্থানে ‘এমপি লীগ’ বনাম ‘উপজেলা চেয়ারম্যান লীগ’-এর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

এমএসআই/