চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয় দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ ছাড়া, রাজস্ব খাত থেকে পাঁচ লাখ কোটি টাকা আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বাজেট ঘাটতি পূরণে সবচেয়ে বড় উৎস হিসেবে সঞ্চয়পত্র, বন্ড ও ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া ঋণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অথচ, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেওয়া পুঞ্জীভূত ঋণ আট লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে, বৈদেশিক উৎস নিয়ে বরাবরই কঠিন অঙ্ক কষতে হচ্ছে। ফলে সরকারের একমাত্র অগ্রাধিকার এবার রাজস্ব আদায় ও পরিধি বৃদ্ধি করা। সে কারণেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ‘ক্যাশ অ্যান্ড ডেবিট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র (সিডিএমসি) এক সভায় বাজেট ঘাটতির অর্থায়নে রাজস্ব বৃদ্ধির নির্দেশনা এসেছে।

সম্প্রতি সিডিএমসি’র ৫২তম সভা থেকে আসা এমন নির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ওপর। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে, সঞ্চয়পত্র হতে সরকারের অর্থায়ন হ্রাস পাওয়া এবং ব্যাংক ঋণে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজেট ঘাটতি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে ‘রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির বিকল্প নেই’ বলে মত এসেছে। যদিও রাজস্ব আদায়ে প্রতিষ্ঠানটির সফলতা খুব বেশি নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বড় ধরনের ঘাটতির মুখোমুখি প্রতিষ্ঠানটি। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে আছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই ঘাটতি ছিল ছয় হাজার ৭৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা

যেমনটা মনে করেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। বিভিন্ন পরিকল্পনার পরও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। রাজস্ব আদায় বাড়ানো মানে বাজেট ঘাটতি কমানো। এটা নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সবাই একমত।’

“রাজস্ব আয় বাড়ানোর দুটি পদ্ধতির একটি হলো- যুগোপযোগী করনীতি ও কর বহির্ভূত রাজস্ব নীতিমালা। অপরটি হলো- রাজস্ব আদায়ে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং দুর্নীতি কমানো। এ বিষয়ে আইএমএফ’রও একটি গাইড লাইন রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- বর্তমান কাঠামোর মধ্যে যতটুকু রাজস্ব আদায় সম্ভব, ততটুকু অন্তত অর্জন করা। বর্তমান রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় একটি বিষয় হলো- কর অব্যাহতি ও কর রেয়াত। এনবিআরের হিসাব অনুসারে, যার পরিমাণ আড়াই লাখ কোটি টাকা। যদিও চূড়ান্ত হিসাব তারা প্রকাশ করেনি। নির্দিষ্ট একটি সময় ও লক্ষ্য নিয়ে করছাড় দেওয়া হলেও তা বছরের পর বছর চলছে। এটা নিয়ে আগের অর্থমন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যান পর্যন্ত সরব হয়েছেন। করসুবিধা বন্ধ না করে অন্তত যৌক্তিককরণ করা প্রয়োজন। এটা কতটা করা হবে, আগামী বাজেটে তা দেখা যাবে।”

অন্যদিকে, ক্যাশ অ্যান্ড ডেবিট ম্যানেজমেন্ট কমিটির (সিডিএমসি) সিদ্ধান্তের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সঞ্চয়পত্র হতে সরকারের অর্থায়ন হ্রাস পাওয়ার পর অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের জন্য বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারভিত্তিক অর্থায়নের বড় উৎস হলো ব্যাংক খাত। বাণিজ্যিক ব্যাংক হতে অর্থায়নের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, বাজারে ইতোমধ্যে সুদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

তিনি বলেন, এ কারণে সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, বাজেট ঘাটতি একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে এবং সরকারের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত বা বৃদ্ধি করতে হলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিই একমাত্র সমাধান। এটা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় এনবিআরের ওপর।

অথচ রাজস্ব আদায় কিংবা আহরণের বিষয়ে স্বস্তিতে নেই এনবিআর। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বড় ধরনের ঘাটতির মুখোমুখি প্রতিষ্ঠানটি। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে আছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই ঘাটতি ছিল ছয় হাজার ৭৮২ কোটি ২১ লাখ টাকা। যদিও ছয় মাস শেষে রাজস্ব আহরণ বিগত অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ১৩.৮৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮৮ ভাগ অর্জিত হলেও বড় ঘাটতি এড়াতে পারেনি এনবিআর। এ সময়ে এক লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সরকারের খাতায় রাজস্ব জমা হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ৬২৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ আট হাজার ৫৬৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। একই সময়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাটে ঘাটতি হয়েছে ছয় হাজার ৭০ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আয়কর খাতে ঘাটতির পরিমাণ আট হাজার ৫৯২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। 

এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি কমাতে কতটুকু অবদান রাখতে পারবে এনবিআর, সেটাই বড় প্রশ্ন। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হলেও প্রকৃতপক্ষে আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে না— এমন কথা উল্লেখ করে জাহিদ হাসান আরও বলেন, ‘কর-জিডিপির অনুপাত এখনও আটের নিচে। যদি করকর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে দুর্নীতি কমানো সম্ভব হয় তাহলে এ কর কাঠামোতেই কর অনুপাত ১০-এর কাছাকাছি নেওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে নতুন করে কর আরোপের প্রয়োজন হবে না।’

‘আমার মতে, বাজেট ঘাটতি কমানোর দুটি উপায় হলো- ব্যয় কমানো কিংবা রাজস্ব আয় বাড়ানো। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলার সংকটের এ অবস্থায় বাজেট ঘাটতি বাড়লে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এমন পরিস্থিতিতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।’

তবে আশার কথা হচ্ছে, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাজেট ঘাটতি না হয়ে উদ্বৃত্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, এ সময় ঘাটতি বাজেট পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ না নিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে ছয় হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ছয় হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। যদিও অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতি এড়ানো ‘অসম্ভব’ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে পাঁচ লাখ কোটি টাকা আসার কথা রাজস্ব আয় হিসাবে। মোট বাজেটের দুই লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

আরএম/এমএআর/