• কোন্দল মেটাতে তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডাকা হচ্ছে
• কোন্দল মেটানোর তাগিদ দিয়েছেন দলটির সভাপতি
• মানা হচ্ছে না ৪৫ দিনের নির্দিষ্ট সময়সীমাও
• ৩৭টিরও বেশি জেলা ইউনিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে
• ২৭টি জেলা ও শহর ইউনিটে অভ্যন্তরীণ কোন্দল
• ১৮টি ইউনিটে কাউন্সিল হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি

আসন্ন উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনের পর দল গোছাতে চায় আওয়ামী লীগ। বিগত জাতীয় নির্বাচন ঘিরে কোন্দল বা বিভক্তি তৈরি হয়। দলের নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর থেকে শুরু হয় এ কোন্দল। আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে এমন সংঘাত বা কোন্দল নতুন মাত্রা পেতে পারে— এমন আভাস পেয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এর মধ্যে অন্যতম হলো তৃণমূল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের ঢাকায় ডাকা। তাদের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধানের পথ বাতলে দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল সাংগঠনিক নেতারা। উপজেলা নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনরা এ নিয়ে পুরোদমে মাঠে নামবেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, দলীয় সভাপতি মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নতুন করে গঠন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন শাখার সম্মেলন, সহযোগী সংগঠন প্রতিটির অসমাপ্ত সম্মেলন, কমিটি গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বসহ সাংগঠনিক সমস্যার সমাধান করা জরুরি। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা সব শাখাকে ঢাকায় ডেকে বসতে পারেন। সমস্যা ও বিরোধ থাকলে তা সমাধানে অনতিবিলম্বে কাজ শুরু করতে নির্দেশ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

দলীয় সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন দলের জেলা পর্যায়ে ৭৮টি সাংগঠনিক ও উপজেলা পর্যায়ে ৪৯৫টি ইউনিট রয়েছে। ৩৭টিরও বেশি জেলা ইউনিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সেখানে ২৭টি জেলা ও শহর পর্যায়ের ইউনিটে অভ্যন্তরীণ কোন্দল অব্যাহত রয়েছে। জেলা পর্যায়ের ১৮টি ইউনিটে কাউন্সিল হওয়ার পরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হয়নি এখনও। জানা গেছে, গণভবনে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সারা দেশের নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করেন। সভার মূল লক্ষ্য ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কারণে দলের ভেতরে যে দ্বন্দ্ব ও বিভেদ তৈরি হয়েছে তা কমানো। আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে তৃণমূল এবং দলের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরাও বৈঠকে অংশ নেন।

তবে, বিশেষ বর্ধিত সভা হলেও তৃণমূলের কোনো নেতাকর্মী সেখানে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাননি। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুধু বক্তব্য দেন। শীর্ষ দুই নেতার বক্তব্যে ছিল কোন্দল মেটানোর তাগিদ। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের বলেন, আমি জানি অনেকের বক্তব্য দেওয়ার কথা ছিল। তারা কে, কী বলবে; সেটাও বুঝতে পারি। আজ কাউকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে কথা বলার সুযোগ সবাই পাবেন। তবে, কারও কোনো অভিযোগ থাকলে তা লিখিত আকারে জমা দেওয়ার কথা বলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি আরও বলেন, আপনাদের অভিযোগ লিখিত আকারে জমা দেবেন। সেগুলো দেখে আমরা পদক্ষেপ নেব।

সারা দেশের নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের নির্বাচন স্বতন্ত্র ও দলীয়ভাবে করতে গিয়ে অনেকের মধ্যে মন-কষাকষি ও বিরোধ তৈরি হয়েছে। যেটা হয়েছে, সেটা হয়েছে; এখন ভুলে যেতে হবে। সবাই এক হয়ে কাজ করতে হবে। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে কাজ করতে হবে। যদি কোথাও কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তাহলে সেটা সমাধানের জন্য আমরা আছি, কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। তারা সমাধান করবে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কোনো আত্মঘাতী সংঘাত যেন না হয়, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে কেউ জিতেছে, কেউ জিতেনি। এরপরও ক্ষোভ আছে। আমি আশা করি, গণভবনে বসে সব ক্ষোভ মিটিয়ে ফেলবেন। ক্ষোভ মিটিয়ে সবাই এক হয়ে কাজ করবেন। তাহলে কেউ কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষতি করতে পারবে না।

সম্প্রতি হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, গত ৭ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ৩৯টি জেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যকার সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত, ৬০ জন গুলিবিদ্ধ এবং ৪৫০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৃণমূল আওয়ামী লীগ নিয়ে আমাদের কাজ চলছে। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেখানে সমস্যা, সেখানে কাজ চলছে। কাল (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতেও একটা সমস্যার সমাধান করলাম। সকালেও আরেকটা করলাম। এভাবে চলছে।

কোন ধরনের সমস্যা এখন সামনে আসছে— জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘তৃণমূলে নিজেদের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা নিরসনে আপাতত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। নেত্রীর নির্দেশে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দূরত্ব নিরসনে আমরা সফলও হচ্ছি। যেখানে সম্মেলন হয়েছে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি, সেখানেও কাজ চলছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন, বিভিন্ন শাখা কমিটির অনুমোদন দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন শাখার সম্মেলন, সহযোগী সংগঠনের নতুন সম্মেলনের প্রস্তুতি, তৃণমূলে বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যা এবং বিরোধ সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারকরা। অনেক স্থানে সম্মেলন হলেও জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও পৌর শাখা চলছে মূলত দুই নেতার কাঁধে ভর করে। ২২তম জাতীয় সম্মেলনে ৪৫ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হলেও বেশিরভাগ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্তরা তা মানছেন না।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের জেলা কমিটিগুলোর মধ্যে মেয়াদ শেষ হয়েছে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী জেলা ও মহানগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, খুলনা জেলা ও মহানগর, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরিশাল জেলা ও মহানগর, শরীয়তপুর, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, সিলেট জেলা ও মহানগর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা জেলা উত্তর, ফেনী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম উত্তর, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ ৩৭ জেলার। এসব স্থানে সম্মেলনের পর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এর মধ্য নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার সম্মেলন ২০০৩ সালের পর অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে সম্মেলন ছাড়াই কমিটি দেওয়া হয়। বরিশাল জেলা শাখার সম্মেলন ২০১২ সালের পর আর অনুষ্ঠিত হয়নি। শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও কিশোরগঞ্জে ২০১৬ এবং মৌলভীবাজারে ২০১৭ সালের পর কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। একই অবস্থা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জেও।

অন্যদিকে, সম্মেলন হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি নীলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, গাজীপুর মহানগর, মুন্সীগঞ্জ, শেরপুর, সুনামগঞ্জসহ আরও কয়েকটি জেলায়। এ ছাড়া, কেন্দ্রে জমা দেওয়া হলেও লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বরগুনা জেলা কমিটি এখনও অনুমোদন পায়নি। এ ছাড়া, নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দ্বন্দ্বের কারণে কেন্দ্রে পাল্টাপাল্টি কমিটি জমা দেওয়া হয়েছে। যার সুরাহা এখন পর্যন্ত হয়নি। উল্টো দলীয় কার্যালয় দখল নিয়ে চলছে উত্তেজনা।

এমএসআই/