রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ নামে বহুতল ভবনে আগুনের ঘটনার পর ঢাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার অভিযানকে বাড়াবাড়ি হিসেবে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করতে হয়। এখন পর্যন্ত ঢাকায় ৪০টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন সংস্থার ১২টি লাইসেন্স থাকার পরও সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়েছে। এসব ঘটনাকে জুলুম হিসেবে আখ্যা দিয়েছে রেস্তোরাঁ মালিকদের সংগঠনটি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, কার কী করণীয়- এসব বিষয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তার সঙ্গে কথা বলেছেন রাকিবুল হাসান তামিম

ঢাকা পোস্ট : চলমান অভিযান নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?

ইমরান হাসান : বহুজাতিক কোম্পানির হাতে ব্যবসা তুলে দেওয়ার জন্যই এই অশান্তি হচ্ছে। কথায় আছে- আগুনে কারো ঘর পুড়ে, আর সেই আগুনে কেউ আলু পোড়া দিয়ে খায়। আজকে আমাদের ঘর পুড়েছে এখন একটি গোষ্ঠী এখান থেকে ফায়দা লোটার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন গলিতে-গলিতে পুঁজিপতিরা ব্যবসা নিয়ে গেছে। সেখানে রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন প্রোডাক্ট বিক্রি করছে। ২০-২৫ দিনের পুরনো বাসি খাবার বিক্রি করছে। আর সরকারে তাদের (বহুজাতিক কোম্পানির) পেইড এজেন্ট রয়েছে। এসব আমলারা অবসরে যাওয়ার পর ওইসব বহুজাতিক কোম্পানিতে যুক্ত হয়। সে জন্যই তাদের বিরুদ্ধে (বহুজাতিক কোম্পানির) এরা কখনো ব্যবস্থা নেয় না। গতকাল কর্ণফুলীতে এসআলম গ্রুপের চিনির কারখানায় আগুন লেগেছে। সেটা নিয়ে তো কেউ স্টেটমেন্ট দিলো না। এই আগুনের ঘটনাকে আমরা সেবটাইজ মনে করি। এর ফলে খুচরা বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

ঢাকা পোস্ট : এই মুহূর্তে আপনারা কী চান?

ইমরান হাসান : বর্তমান সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন। তার হস্তক্ষেপ না হলে বেকারি শিল্পের মতো রেস্তোরা শিল্পও ধ্বংস হবে। কেউ আমাদের দেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলুক সেটি আমরা চাই না। তিলে তিলে আমাদের যে শিল্প গড়ে উঠেছে সেটিকে রক্ষা করতে হবে। এসব অভিযান লোক দেখানো। সব চাটুকারের দল। আসল জায়গায় কেউ হাত দেয় না। এই ব্যর্থতার দায় কেউ নেবে না। আমরা মালিক সমিতি হিসেবেও ব্যর্থ হয়েছি। 

আপনারা জেনে অবাক হবেন, আমরা ৫৬৭টা চিঠি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দিয়েছি। একটা মন্ত্রণালয় থেকেও আমাদের কোনো সহযোগিতা করা হয়নি। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি অবশ্যই আছে। তাই বলে কি সব বন্ধ করে দেওয়া লাগবে? শিক্ষা, পরিবহন, চিকিৎসা সেক্টরেও ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে? তার মানে তো এই নয় যে, সব বন্ধ করে দেবেন। আমরা এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চাই। তার কাছে আমরা বিষয়টি জানাতে চাই। উনি যদি মনে করেন আমরা দোষী তাহলে আমরা সব বন্ধ করে দেব।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে ৪ লাখ ৮১ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। সেখানে ৩০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ কোটি মানুষ এ পেশার ওপর নির্ভরশীল। হয়রানি না করে টাস্কফোর্স গঠন করে রেস্তোরাঁ ব্যবসা চালু রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। দীর্ঘ দিন ঘুরেও লাইসেন্স পাওয়া যায় না। কোনো অবৈধ রেস্তোরাঁ নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি সাক্ষাতের সময় দিলে সব সমস্যা নিয়ে কথা বলা হবে। আর যদি সময় না দেন তাহলে সব চাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে পাঠিয়ে দেব। কারণ প্রধানমন্ত্রী যদি আমাদেরকে সহযোগিতা না করেন তা হলে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। আমরা চাই একটি রেগুলেটরি করা হোক। সবাইকে একটি নীতিমালার নিচে নিয়ে আসা হোক।

ঢাকা পোস্ট : সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানকে নেতিবাচকভাবে নেওয়ার কারণ কী?

ইমরান হাসান : আমরা দেখেছি, নিরাপদ খাদ্যের চেয়ারম্যান হিসেবে যাকে বসানো হয় তিনি এই ফুডের কোনো কিছুই জানেন না। আপনাকে ফুড এক্সপার্ট নিয়ে আসতে হবে। অন্য দেশে কিভাবে রেস্তোরাঁ এবং ফুড সেক্টরকে সমৃদ্ধ করেছে সেটি আপনাকে দেখতে হবে। এখানে যে যার মত আসে। মন মতো প্ল্যান করে।

ঢাকা পোস্ট : চলমান এই অভিযান কি ফলপ্রসু হবে?

ইমরান হাসান : আপনার যদি মাথা ব্যথা হয় তাহলে কি মাথা কেটে ফেলবেন? গাছের শিকড় কেটে তারপর পানি ঢাললে তাতে কোনো লাভ হবে? আমরা বারবার বলেছি, একটি স্পষ্ট নীতিমালার আওতায় আসতে চাই। আপনি রানা প্লাজার দুর্ঘটনা দেখতে পারেন। এখানেও কিন্তু ব্যর্থতা ছিল। কিন্তু তারা এখন আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার জন্য তো পুরো সেক্টরকে বন্ধ করে দেওয়া হয়নি। তৎকালীন সময় প্রধানমন্ত্রী সর্বক্ষণ সহযোগিতা করেছেন। বিজিএমই এর প্রতিনিধিরা সার্বক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। যার ফলে তারা অনেক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে।

আমাদের অনেক অর্জনও রয়েছে। আমাদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে ছেলে মেয়েরা বিদেশে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সরকার যদি আমাদেরকে সহযোগিতা করে তাহলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে আরও ১০ লাখ দক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে। এই জনবল আমরা তৈরি করে দেব। ওরা যদি ওখান থেকে জব-লেস হয়ে ফিরে আসে তাহলে আবার এখানে যুক্ত হতে পারবে। কোটি-কোটি লোকের মার্কেট নিয়ে আজকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।

ঢাকা পোস্ট : এসব ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে আপনারা বড় করে দেখছেন কেন?

ইমরান হাসান : আমাদের দুর্ভাগ্য এত বছরেরও আমরা আমলাতন্ত্রের লালফিতা কাটতে পারিনি। আমরা তাদের হাতে বন্দী হয়ে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী একা কী করবেন? একজন মন্ত্রীর এপয়েন্টমেন্ট চেয়ে আমরা দিনের পর দিন ঘুরেছি কিন্তু পাইনি। অথচ উনি অনেক জায়গায় ফিতা কাটতে গিয়েছেন। সমালোচনা করলেই সরকার বিরোধী নয়। আমরা সমালোচনা করতে চাই, আমরা কথা বলতে চাই এবং সমাধান চাই। ক্ষতি আমরা কিভাবে পোষাবো। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে আমরা যে ইমেজ তৈরি করেছি, সেটি নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনা হতেই পারে কিন্তু এই দুর্ঘটনার দায় কেউ এড়াতে পারবে না। রেস্তোরাঁ সেক্টরে এই প্রথম এত বড় দুর্ঘটনা হয়েছে। তবে এটিই শেষ দুর্ঘটনা হওয়া উচিত। প্রতি জেলায় ও থানায় পর্যন্ত আমাদের কমিটি আছে। প্রয়োজনে আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ভিজিটে যাব। আমাদের দাবি হচ্ছে আমাদেরকে হয়রানি করা যাবে না। আর এসব জায়গায় দায়িত্ব পালন করার জন্য সৎ, দক্ষ এবং যোগ্য লোক দিতে হবে। 

তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি এই সেক্টরকে প্রমোট করার জন্য। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। তবে সেগুলো আমরা সংশোধন করতে বদ্ধপরিকর। আমি আবারো প্রধানমন্ত্রী কাছে আহ্বান জানাচ্ছি বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য। আর এই সেক্টরে অসংখ্য মানুষ কাজ করছেন। সবাই খুব উদ্বিগ্ন। একজন তরুণ উদ্যোক্তা অনেক ধার-দেনা করে একটি রেস্তোরাঁ তৈরি করে। যখন এটি বন্ধ করে দেওয়া হয় তখন তার স্বপ্নই সেখানে চাপা পড়ে যায়। এটা তো হতে পারে না। আমরা কারো উপর প্রশ্ন তুলতে চাই না। আমরা চাইই একটি সুশৃঙ্খল জায়গা করে দেওয়া হোক। আমরা সেখানেই কাজ করবো।

আরএইচটি/এআর/এমএসএ