৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার আত্মসাতের মামলায় আলোচিত নাম কামরুল আশরাফ খান (পোটন)। তিনি নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। যদিও অজ্ঞাত কারণে নির্বাচনের কয়েক দিন আগেই ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান। মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন সেটির তথ্য অনুযায়ী, ১৪৫ কোটি টাকা সম্পদের মালিক সাবেক এ সংসদ সদস্য। এর মধ্যে অর্ধশত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন গত ১০ বছরে।

তার এমন সন্দেহভাজন সম্পদের হিসাব যাচাই করতে সম্প্রতি নোটিশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নোটিশে পোটন ছাড়াও তার মালিকানাধীন পোটন ট্রেডার্সের জিএমসহ চারজনের সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার আত্মসাৎ মামলার সূত্র ধরে ওই নোটিশ দিয়েছে সংস্থাটি।

পোটন ছাড়াও সম্পদের বিবরণী দাখিলের নোটিশপ্রাপ্তরা হলেন- মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের জিএম মো. নাজমুল আলম (বাদল), মহাব্যবস্থাপক মো. শাহাদত হোসেন নিপু, মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের খুলনা ও নওয়াপাড়া প্রতিনিধি মো. আতাউর রহমান এবং উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি মো. সোহরাব হোসেন। তারা সবাই সার আত্মসাৎ মামলার আসামি।

পোটনের হলফনামা অনুযায়ী, ১০ বছরে তার সম্পদ ৯২ কোটি ৪৬ লাখ ২৬ হাজার ৫২৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৪৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৭ টাকা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার ছিল ৯৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪১১ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তা ১৩ গুণ বেড়ে ১৩ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৬ টাকা হয়েছে

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার সরবরাহ না করে আত্মসাতের অভিযোগে ইতোমধ্যে পোটনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। মামলার সূত্র ধরে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সাধারণত দুর্নীতিবাজরা আত্মসাৎ করা টাকা দিয়ে সম্পদ গড়ে থাকেন। দুদকের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে, সেটা খুঁজে বের করা। পরবর্তীতে এসব সম্পদ ক্রোক বা ফ্রিজ করে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা। কাজটা বেশ কঠিন, তবে দুদক আইন অনুযায়ী চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ পোটনের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ব্যবহৃত সেলফোন নম্বরে খুদে বার্তাও পাঠানো হয় কিন্তু সাড়া দেননি তিনি।

সম্পদের নোটিশে যা বলা হয়েছে

সম্প্রতি দুদক পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়ালের স্বাক্ষর করা পৃথক নোটিশ পোটনসহ সংশ্লিষ্টদের অফিস ও স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। সম্পদের নোটিশে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দুদকের স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, আপনি বা আপনাদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্বনামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ/সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। আপনি আপনার নিজ ও আপনার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তির নামে-বেনামে অর্জিত যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ, দায়-দেনা, আয়ের উৎস এবং তা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণী কমিশনে দাখিল করবেন। আদেশ পাওয়ার ২১ কার্যদিবসের মধ্যে নির্ধারিত ছকে সম্পদের বিবরণী দাখিলে ব্যর্থ হলে কিংবা মিথ্যা সম্পদ বিবরণী দাখিল করলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ৫ (২) ধারা অনুযায়ী আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

হলফনামা অনুযায়ী পোটনের যত সম্পদ

নরসিংদী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনের ১০ বছরের ব্যবধানে ব্যাংকে টাকা, বাড়ি, জমিসহ সব সম্পদই বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদে।

১০ বছর আগে দেওয়া অর্থাৎ ২০১৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় স্ত্রী-সন্তানের নামে কোনো জমি না থাকলেও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রদত্ত হলফনামায় স্ত্রীর নামে ৭৬৯.২৯ শতাংশ, ছেলের নামে ১০২০.৭০ শতাংশ এবং মেয়ের নামে ৯৭০.১৫ শতাংশ মিলিয়ে মোট ২৭৬০.১৪ শতাংশ জমি দেখানো হয়েছে।

পোটনের হলফনামা অনুযায়ী, ১০ বছরে তার সম্পদ ৯২ কোটি ৪৬ লাখ ২৬ হাজার ৫২৩ টাকা থেকে বেড়ে ১৪৫ কোটি ৯৩ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৭ টাকা হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার ছিল ৯৭ লাখ ৬৮ হাজার ৪১১ টাকা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তা ১৩ গুণ বেড়ে ১৩ কোটি ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৬ টাকা হয়েছে।

২০১৪ সালে তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল ৩১ লাখ চার হাজার ৫৪৪ টাকা। ২০২৩ সালে দেখানো হয়েছে এক কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৭ টাকা। ৩৭১ শতাংশ জমি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৬৯৪.১০ শতাংশ হয়েছে। ১০ বছর আগে পোটনের বার্ষিক আয় ছিল চার লাখ ৯৭ হাজার ৯৯১ টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৮৮ টাকা। এছাড়া ৭০ লাখ ৩০ হাজার টাকার স্বর্ণ ও মূল্যবান ধাতু এবং ৭টি অ্যাপার্টমেন্টের তথ্য দেওয়া হয়েছে।

৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ

প্রায় ৫৮২ কোটি টাকার সরকারি সার সরবরাহ না করে আত্মসাতের অভিযোগে কামরুল আশরাফ খান পোটনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৬ নভেম্বর মামলা করে দুদক। ২০২১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর উপ-পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক ও সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটন, ওই প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক মো. শাহাদত হোসেন (নিপু) ও মো. নাজমুল আলম (বাদল), পোটন ট্রেডার্সের উত্তরবঙ্গ প্রতিনিধি সোহরাব হোসেন ও প্রতিনিধি (খুলনা ও নওয়াপাড়া) মো. আতাউর রহমানকে আসামি করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/১০৯ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

২০১৪ সালে তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল ৩১ লাখ চার হাজার ৫৪৪ টাকা। ২০২৩ সালে দেখানো হয়েছে এক কোটি ৯৬ লাখ ৬৫ হাজার ৬২৭ টাকা। ৩৭১ শতাংশ জমি বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৬৯৪.১০ শতাংশ হয়েছে। ১০ বছর আগে পোটনের বার্ষিক আয় ছিল চার লাখ ৯৭ হাজার ৯৯১ টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ২৫ লাখ ১৬ হাজার ৮৮ টাকা। এছাড়া ৭০ লাখ ৩০ হাজার টাকার স্বর্ণ ও মূল্যবান ধাতু এবং ৭টি অ্যাপার্টমেন্টের তথ্য দেওয়া হয়েছে

মামলার প্রতিবেদন সূত্র জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা ইউরিয়া সার বাফার গুদামে না দিয়ে ৫৮১ কোটি ৫৮ লাখ নয় হাজার ৬৪ টাকার ৭১ হাজার ৮০১ টন ৩১ কেজি সার আত্মসাৎ করেছেন আসামিরা। কামরুল আশরাফ খানের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স ৫০ দিনের মধ্যে সার গুদামে পৌঁছে দেওয়া কথা ছিল। সেটা না করে সার ট্রানজিটে রয়েছে বলে বিসিআইসিকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা তিন লাখ ৯৩ হাজার টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে পোটন ট্রেডার্সের চুক্তি হয়। এর মধ্যে এক লাখ ৪৩ হাজার ৫৭৬.২৫৮ টন ইউরিয়া সার বিভিন্ন বাফার গুদামে সরবরাহ করা হলেও বাকি ৭১ হাজার ৮০১ টন ৩১ কেজি ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করেন পোটন ও তার সহযোগীরা। যার বাজারমূল্য ৫৮২ কোটি টাকা।

ট্রানজিটে থাকা ইউরিয়া সার দ্রুত সরবরাহ করার জন্য মেসার্স পোটন ট্রেডার্সকে ধারাবাহিকভাবে পত্র ও তাগিদ পত্রসহ মোট ৪৩টি চিঠি দেয় বিসিআইসি। যদিও এসব চিঠির কোনো জবাবই দেয়নি পোটনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। বিসিআইসি’র গঠন করা তদন্ত কমিটিতেও অভিযোগের সত্যতা মেলে।

আরএম/এসকেডি