ঢাকাসহ বাংলাদেশের ৫০টির বেশি জেলার উপর দিয়ে এখন তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে দিনের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে কয়েক ডিগ্রি। তীব্র গরমের কারণে সারা দেশেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দফায় দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করে জনগণকে সচেতন করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সবশেষ গতকাল রাতে দেওয়া পূর্বাভাসে আগামী ৭২ ঘণ্টার জন্য হিট অ্যালার্ট জারি করে সংস্থাটি।

এবার গরমে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে হিট স্ট্রোক। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর আসছে। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিনই হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর আসছে। কিন্তু এসব মৃত্যু হিট স্ট্রোকে নয়। এখন পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সারাদেশে হিট স্ট্রোকে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে মৃতদের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসতিয়াক ওয়ারেছ তুর্য, অন্যজন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ এলাকার নুরুল ইসলাম নামে এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক এবং বরগুনার তালতলী এলাকার নয়া মিয়া ফকির (৫০) নামে এক শ্রমিক।

এর আগে মঙ্গলবারও (২৩ এপ্রিল) একজন পুলিশ কনস্টেবলসহ রাজধানী ঢাকা ও বিভিন্ন জেলায় ৯ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে হিট স্ট্রোকের কথাই গণমাধ্যমে এসেছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২০ এপ্রিল থেকে বুধবার (২৪ এপ্রিল) পর্যন্ত পাঁচ দিনে সারাদেশে হিট স্ট্রোকে মারা গেছে ৩৬ জনের বেশি।

এতো মৃত্যু মানতে নারাজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে বলা হয়, দেশে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় হিট স্ট্রোকে মৃত্যু নিয়ে যত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা। এখন পর্যন্ত যতগুলো সংবাদে হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর বিষয় বলা হয়েছে, আমরা প্রতিটি সংবাদ ও রোগীদের তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। আর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরও দুইজন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের মৃত্যু নিয়ে হিট স্ট্রোকের সংবাদ হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই সকাল ৭টা ৮টার দিকে মারা গেছেন। যখন হিট স্ট্রোক হওয়ার কথাই না। তাছাড়া এসব ব্যক্তির মৃত্যু হাসপাতালে আসার পরও হয়নি, তারা সবাই ব্রট ডেথ (হাসপাতালে আনার আগে মৃত্যু)। আর ব্রট ডেথ যখন হাসপাতালে এসে ডেথ কনফার্ম হয়, সেটাকে কেউই হিট স্ট্রোক বলতে পারেন না। ফলে সিভিল সার্জন অফিসগুলোতে যোগাযোগ করা হলে তারাও আমাদের হিট স্ট্রোকের বিষয়টি নাকচ করেছে।

কন্ট্রোল রুম সূত্র জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত হিট স্ট্রোকে মৃতদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল), দ্বিতীয় জনের মৃত্যু হয়েছে গতকাল (২৪ এপ্রিল)। তাদের একজন চুয়াডাঙ্গা জেলায়, অন্যজন খুলনা জেলায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে দুজন চিকিৎসাধীন আছেন, তাদের একজন বগুড়া এবং অন্যজন রাঙ্গামাটি জেলায়।

গণমাধ্যমে আসা সব মৃত্যু হিট স্ট্রোকে নয় : স্বাস্থ্য মহাপরিচালক

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, দেশে এবার অন্যান্য সময়ের তুলনায় গরম একটু বেশি। যার কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্তও বেশি হচ্ছে। আমরা যতটুকু দেখছি প্রতিটি হাসপাতালেই স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রোগীর চাপ কিছুটা বেশি। এই অবস্থায় নিজেকে সুস্থ রাখতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

হিট স্ট্রোকে মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পত্রিকা-টেলিভিশনের খবরে সারাদেশ থেকেই প্রতিদিন হিট স্ট্রোকে মৃত্যুর খবর আমরা পাচ্ছি। তবে আমরা যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তাদের অধিকাংশই অন্যান্য কারণে মারা গেছে। তাদের কারও স্ট্রোক, কারও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে। তীব্র গরমের সময় মারা গেছে, তাই ভাবা হচ্ছে হিট স্ট্রোকে তারা মারা গেছেন। তাই এমন কোন সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না যার কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

গরমে ঢাকার হাসপাতালগুলোর যেমন পরিস্থিতি

তীব্র গরমে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বেড়েছে। সর্দি-জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব রোগীদের অধিকাংশই শিশু ও বয়স্ক। তবে বর্তমান সময়ে আলোচিত হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর কোনো হাসপাতালে মৃত্যু বা ভর্তির তথ্য পাওয়া যায়নি।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরতরা। প্রত্যেকটি হাসপাতালেই গরমজনিত অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেশি।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গরমের তীব্রতা বাড়ার আগে হাসপাতালটিতে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসত। এখন সেখানে প্রতিদিন ১১০০ থেকে ১৩০০ রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছে। শুধুমাত্র নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েই হাসপাতালটিতে ভর্তি আছে ৮৭ শিশু। এছাড়াও এই মুহূর্তে জ্বর, ডায়রিয়া, অ্যাজমা, সাধারণ ঠান্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছে।

রাজধানীর আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়তই হাসপাতালটিতে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১৯ এপ্রিলের পর রোগীর সংখ্যা ৫০০ জনের নিচে নামেনি। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে রোগী ভর্তি থাকে ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫০ জন।

হাসপাতালটির পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০ এপ্রিল ৫৪৩ জন, ২১ এপ্রিল ৫২২ জন, ২২ এপ্রিল ৫০০ জন, ২৩ এপ্রিল ৫২৪ জন এবং ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যা পর্যন্ত চার শতাধিক রোগী হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন।

এদিকে, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুধুমাত্র ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ২০ জন রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে।

হিট স্ট্রোক কী, কারা বেশি ঝুঁকিতে?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, হিট স্ট্রোক হলো অতিরিক্ত উত্তাপের একটি অবস্থা। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে ঘাম বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন। যেটাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় হিট স্ট্রোক বলে।

চিকিৎসকদের মতে, শিশু ও বৃদ্ধদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার বা হার্টের রোগী, স্ট্রোক বা ক্যান্সারজনিত রোগে যারা ভোগেন তাদের হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। ফলে গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে বেঁচে থাকা যায়।

এই অবস্থায় প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করতে হবে। গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুটিই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন, খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে।

তীব্র গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা

দেশে তীব্র দাবদাহ পরিস্থিতিতে গরমে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে ৪ দফা নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নির্দেশনাগুলো হলো;

>> তীব্র গরম থেকে দূরে থাকুন, মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিন।

>> প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করুন। হেপাটাইটিস এ,ই,ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতী পানিবাহী রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করুন।

>> গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরুন, সম্ভব হলে গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলুন।

>> গরম আবহাওয়ায় যদি ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, বমি বমি ভাব দেখা দেয়, তীব্র মাথা ব্যথা হয়, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, খিঁচুনি এবং অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে হাসপাতালে যান এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচতে যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা

গরমে শরীর থেকে অতিমাত্রায় পানি বের হয়ে যায়, এক পর্যায়ে পানিশূন্যতা দেখা দেয় এবং হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। তাই শরীরের পানির ঘাটতি পূরণে বেশি পরিমাণ পানি ও ওরস্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

তিনি বলেন, বেশি গরমের কারণে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে সারাদেশ থেকেই হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের খবর আসছে। এবার গরমে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী হচ্ছেন বয়স্ক ও নানা রোগে আক্রান্তরা।

এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, গরমের সময়ে যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে কাজ করে ঝুঁকিটা একটু বেশি। তারা ডিহাইড্রেশনের (পানিশূন্যতা) ঝুঁকিতে থাকে, তারাই হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এজন্য একটানা এক ঘণ্টার বেশি রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে, সম্ভব হলে অল্প পরিমাণ লবণ মিশিয়ে খেতে হবে। আরও ভালো হয় যদি দু-একটা ওরস্যালাইন খাওয়া যায়।

প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, গরমে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ লবণ বের হয়ে যায়। যে কারণে শুধু পানি পান করলে সেটা ঘাটতি পূরণ করে না, তাই লবণ মিশিয়ে পান করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, গরমের সময় যারা বাইরে বের হবেন তারা একটু ঢিলেঢালা কাপড় পড়ার চেষ্টা করবেন। কারণ জামা কাপড় বেশি টাইট হলে শরীর থেকে গরম সহজে বের হতে পারে না। এই সময়টাতে বাইরের সকল ধরনের খোলা খাবার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। গরমে বের হওয়ার সময় অবশ্যই বাসা থেকে বেশি তাপে ফোটানো ফিল্টার করা পানি বোতলে করে নিয়ে বের হতে হবে।

টিআই/এসকেডি