জনবলের অভাবে বাড়ছে না কোভিড পরীক্ষা, আটকে আছে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের নিয়োগও

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তে বেশি বেশি পরীক্ষার নির্দেশনা দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনা পরীক্ষার বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করছে বারবার। কিন্তু এ কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এ কারণে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ।

এ অবস্থায় জরুরিভিত্তিতে হাসপাতালগুলোতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু নির্দেশনার এক বছর পার হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের হাসপাতালগুলোতে চাহিদার তুলনায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংখ্যা অনেক কম। বর্তমানে যারা আছেন তাদের দিয়ে দেশে করোনা পরীক্ষা আর বাড়ানো সম্ভব নয়। তারা নিয়মিত এসব পরীক্ষা চালিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুততম সময়ে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে বর্তমানে ২৫ হাজার ৬১৫ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। মানদণ্ড অনুযায়ী, এক্ষেত্রে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদের সংখ্যা হওয়ার কথা এক লাখ ২৮ হাজার ৭৫টি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদ আছে সাত হাজার ৯২০টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন আরও কম, পাঁচ হাজার ১৮৪ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৩২ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স ও পাঁচজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের চিত্র এর উল্টো। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে বর্তমানে ২৫ হাজার ৬১৫ জন চিকিৎসক কাজ করছেন। মানদণ্ড অনুযায়ী, এক্ষেত্রে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদের সংখ্যা হওয়ার কথা এক লাখ ২৮ হাজার ৭৫টি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পদ আছে সাত হাজার ৯২০টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন আরও কম, পাঁচ হাজার ১৮৪ জন। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য শূন্য দশমিক ৩২ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট কাজ করছেন।

আর ল্যাব টেকনোলজিস্টের দুই হাজার ১৮২টি পদের মধ্যে এক হাজার ৪১৭ জন কর্মরত আছেন। নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটি করেন ল্যাব টেকনোলজিস্টরা।

প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য দেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ০.৩২ জন

এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা টেস্টের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছি। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ছাড়া স্যাম্পল কালেকশন কে করবে? এটা তো অপেশাদার লোকদের কাজ নয়। সরকার চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দিয়েছে ভালো কথা। কিন্তু মেডিকেল টেকনোলজিস্টও নিয়োগ দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ রোগের নমুনা পরীক্ষায় প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ভারত যেখানে তিন/চার লাখ করে প্রতিদিন নমুনা পরীক্ষা করে, সেখানে আমাদের সংখ্যা মাত্র ১০/১৫ হাজার। দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে অবশ্যই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে।’

মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে আছে উদাসীনতা

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের উদাসীনতার রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগের ব্যাপারে নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ তিনি করোনা সংকট চলাকালীন জরুরিভিত্তিতে নিয়োগের কথা বলেছিলেন। কিন্তু গত জুন মাসে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেও পরীক্ষা নিতে নিতে ডিসেম্বর মাস গড়ায়। পরবর্তীতে ভাইভার জন্য ডাকা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এ নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি সিন্ডিকেটের সহযোগিতায় সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয় চলে আসে।

তিনি বলেন, যেহেতু পরীক্ষাটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেহেতু আমরা পরীক্ষা বাতিল করে আবারও পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু অধিদফতর থেকে বলা হয়েছে, এ মুহূর্তে পরীক্ষা বাতিল হলে পরবর্তীতে নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে আরও জটিলতা দেখা দেবে। যেহেতু ১২ বছর পরে নিয়োগটা আবারও শুরু হয়েছে, তাই আমরা বিষয়টা ছাড় দিলেও এখন এটা দুদক পর্যন্ত গড়িয়েছে। এখন তদন্ত কমিটির তদন্ত চলছে, তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে পরীক্ষা বাতিল হবে কি না। তবে, আমরা চাই এটি খুব দ্রুত সমাধান হোক। পাশাপাশি আরও যে পদগুলো ফাঁকা আছে সেগুলোতে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

আক্ষেপ প্রকাশ করে আশিকুর রহমান আরও বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদফতর বা প্রশাসন মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের আসলে কী মনে করেন, আমরা জানি না। তাদের মতে দেশে আসলে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সেটা তারাই বলতে পারবেন। অথচ পাশের দেশ ভারতসহ উন্নত দেশগুলোতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের যে সম্মান, মর্যাদাসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, আমাদের দেশে এর কিছুই নেই। বরং দেখা যায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পদবী বিকৃত করে টেকনোলজিস্টকে বারবার টেকনিশিয়ান বলা হয়। অথচ এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক।

লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষ হলেও আটকে আছে নিয়োগ প্রক্রিয়া

‘যেখানে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের ব্যাপারে সরকারি গেজেট আছে, সেখানে তারা ভুলবশত বলেন, নাকি ইচ্ছাকৃত বলেন, আমাদের বুঝে আসে না। তবে আমরা মনে করি, যেহেতু বারবারই তারা এভাবে বলছেন, সেহেতু এটি তারা ইচ্ছাকৃতভাবে করছেন’— যোগ করেন তিনি।

আশিকুর রহমান বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেশের হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্টের সংকট রয়েছে। শুধু করোনা বলে নয়, সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, রেডিওথেরাপি, ফিজিওথেরাপিসহ সব ডিপার্টমেন্টেই সারাদেশে ১০/১২ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া উচিত। তাহলে বাংলাদেশে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একটা আমূল পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে রোগীদের আর রোগ নির্ণয়ের জন্য পাশের দেশ সিঙ্গাপুর, ভারতে যেতে হবে না।’

পেশাজীবী এ নেতা বলেন, আমরা যদি আমাদের মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ট্রেনিং করাতে পারি, পাশাপাশি যদি উন্নত কিছু যন্ত্রপাতি যুক্ত করা যায়, তাহলে আমার মনে হয় দেশের লোক বাইরে যাবেন না; বরং বাইরের লোক আমাদের দেশে এসে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য আসবেন। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা ভালো দিক হতে পারে। কিন্তু প্রশাসন বা আমাদের নীতিনির্ধারক যারা আছেন তারা এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা এগুলো বুঝতে চান না।’

চিকিৎসক-নার্সরা কোয়ারেন্টাইনে গেলেও টেকনোলজিস্টরা পারছে না

বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলমাস আলী খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা ঝুঁকি নিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করছেন। কয়েকটি হাসপাতালে সংক্রমণের পর চিকিৎসক-নার্সরা কোয়ারেন্টাইনে গেলেও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পাঠানো হচ্ছে না। কারণ টেকনোলজিস্টরা কোয়ারেন্টাইনে গেলে সেখানে কাজ করার কেউ থাকে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতর

তিনি বলেন, দেশে ১২ বছর ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় কিছু নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এটা নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের খবর আসে। যেসব স্কুল-কলেজে লিখিত পরীক্ষা হয়েছে, সেগুলোতে সেখানকার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথেষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এরপরও ভাইভা নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আশা করি, খুব দ্রুতই এর সমাধান হবে।

তিনি আরও বলেন, পাশের দেশ ভারতে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ লাখ করোনা পরীক্ষা হয়, সেখানে বাংলাদেশে হয় ১০/১৫ হাজার। ভারতে আমরা দেখি, পাঁচ লাখ পরীক্ষা হলে তিন লাখ পজিটিভ আসে। এখন আমাদের দেশে টেস্টই যদি না হয়, তাহলে করোনা কীভাবে পাবেন?

কবে নাগাদ নিয়োগ জানে না স্বাস্থ্য অধিদফতর

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরে আমরা গত বছরের জুনে নিয়োগের উদ্যোগ নেই। পরবর্তীতে গত ডিসেম্বরে আমরা লিখিত পরীক্ষা নেই এবং ফেব্রুয়ারিতে ভাইভা নেওয়া শুরু করি। এর মধ্যেই মিডিয়াতে কিছু অনিয়মের কথা আলোচনায় আসে। ফলে এটা নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। তদন্ত কমিটি যেই রিপোর্ট দেবে, সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।

কবে নাগাদ তদন্ত কাজ শেষ হবে বা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কবে নাগাদ নিয়োগ শুরু হবে এটা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে তদন্ত প্রতিবেদন পেলে খুব শিগগিরই আমরা পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে পারব, আশা করি।’

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এক বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি

গত বছরের ২৯ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি পদ এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের এক হাজার ৮০০টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ৮৮৯টি পদের বিপরীতে ২৩ হাজার ৫২২ জন এবং মেডিকেল টেকনিশিয়ানদের বিভিন্ন গ্রুপের এক হাজার ৮০০টি পদের বিপরীতে প্রায় ৫০ হাজার জনসহ মোট প্রায় ৭৪ হাজার চাকরিপ্রার্থী গত বছরের ১২, ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন।

লিখিত পরীক্ষার পর মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের মৌখিক পরীক্ষা গত ২২ ফেব্রুয়ারি এবং টেকনিশিয়ানদের মৌখিক পরীক্ষা ১০ মার্চ শেষ হলেও এখনও নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি।

প্রসঙ্গত, করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ছয় হাজার নার্স ও দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছে। এছাড়া আরও দুই হাজার চিকিৎসকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।

টিআই/এমএআর/