সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পাশের ফ্লাটেই থাকতেন এনজিওকর্মী গায়েত্রী অমর সিংহ। নিজেদের মধ্যে সখ্যতার সুযোগে বাইরে ঘুরতে যেতেন। গায়েত্রী অমর সিংহের বাচ্চা দেখভাল করতের মাহমুদা খানম মিতু (নিহত) নিজেই! 

বাবুল ও গায়েত্রীর ঘনিষ্ঠতা নিজ চোখে দেখার পর ‘দুই বাচ্চাকে নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা’ বাবা-মাকে জানিয়েছিলেন মিতু। এত কিছুর পরও বাবুল আক্তারকেই বিশ্বাস করেছিলেন তার বাবা-মাসহ আত্মীয়-স্বজনরা।

নির্মমভাবে মিতুকে হত্যার পর শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বাবুল আক্তারের কান্না, আহাজারি, মৃত মিতুর পা ধরে কান্না করা, কবরের সামনে বিলাপের দৃশ্য দেখে মিতুর শত অভিযোগ-অনুযোগ ভুলে গিয়েছিলেন তারা। তবে বিচক্ষণ সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন (মিতুর বাবা) উদ্যোগী হয়ে খোঁজ নেন, ফোন রেকর্ডে থাকা বাবুলের সঙ্গে মুছার রোমহর্ষক কথোপকথন শোনেন। সবকিছু আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয় তার কাছে। একপর্যায়ে নিজের মেয়ে মিতু হত্যায় বাবুলকে দোষারোপ করেন বাবা মোশাররফ হোসেন।

বৃহস্পতিবার নিজ বাসায় এমন তথ্যই দেন মিতুর বাবা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পারিবারিক কলহ ছিল। মারধরও করা হয়েছে মিতুকে। এরপরও বাবুল আক্তারকে সমর্থন করে গেছি। চট্টগ্রামে বদলি হওয়ার পর নতুন ঝামেলা তৈরি হয়। সেখানে গায়েত্রী অমর সিংহের সঙ্গে তার (বাবুল আক্তার) ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আপত্তিকর অবস্থাতেও দুজনকে দেখতে পায় মিতু।’

স্বামী বাবুল আক্তারকে বিশ্বাস করেছিলেন মিতু, ভেবেছিলেন সময় হলে স্বামী তার কাছে ফিরে আসবে

মিতুর বাবা বলেন, সুদান মিশনে যাবার পর গায়েত্রী বাবুলের ব্যবহৃত ফোনে অনেক ম্যাসেজ করে। সেসব ম্যাসেজে আবার কিছু হুমকিও ছিল। মিতু আমাকে জানিয়েছিল। বাসাতেও জানিয়েছিল। তবে, আমি বলেছিলাম কোনো হুমকির জবাব দেওয়ার দরকার নেই। জবাব দিলে আবারও হুমকি আসবে।

সুদান থেকে প্রতি তিন মাস পরপর দেশে ছুটিতে আসত বাবুল আক্তার। কিন্তু সে উঠত ঢাকায়। কখনো মিতু তা জানত, কখনো জানত না। ঢাকায় হোটেলে গায়েত্রীকে নিয়ে থাকত বাবুল। এসব কিছু জেনেও চুপ ছিল মিতু। কোনো কোনো সময় সে বলেছে, বাবুলের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করেন।

পারিবারিক অশান্তি-কলহ চরমে ওঠার পর মিতু একবার ফ্যানে ঝুলে সুইসাইড (আত্মহনন) করতে চেয়েছিল। কখনো সারা রাত বাইরে সিঁড়িতে বসে রাত কাটাত। ছেলে মাহির ও মেয়ে জারার মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ বুঝে সহ্য করেছে সে— বলেন মিতুর বাবা।

মা শাহিদা মোশাররফ বলেন, সে আমার বড় মেয়ে। ১৬ বছরের সংসারে ওর কপালে সুখ জোটেনি। এটা মা হিসেবে জেনেও চেপে থাকতে হয়েছে, মেয়ের সংসারে স্বার্থে।

বড় মেয়ে মিতুর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা শাহিদা মোশাররফ

‘মিতুর খুনের পেছনে বাবুলই জড়িত’ উল্লেখ করে শাহিদা মোশাররফ বলেন, ‘সে (মিতু) জেনে গিয়েছিল বাবুলের অপকর্মের কথা, পরকীয়া সম্পর্কের কথা। বাধা দিয়েছিল মিতু। এরপর বাবুলের পাশাপাশি শ্বশুর বাড়ি থেকেও নেমে আসে অমানসিক নির্যাতন। মিতু ফোন করে আমাকে এসবই বলত।’

মা-মেয়ের ফোনালাপও জেনে যায় বাবুল

একদিন বাবুল ও গায়েত্রীর মধ্যকার আপত্তিকর দৃশ্য দেখে সারা রাত কাঁদেন মিতু। সকালে সেসব কথা মা শাহিদার সঙ্গে শেয়ার করেন। শাহিদা মোশাররফ বলেন, “মিতু বরাবরই সংসার চালিয়ে যাবার কথা বলেছে। বলেছে, বাবুল একদিন ভালো হবে। একটু বয়স হলেই ঠিক হয়ে যাবে। ঘণ্টা খানেক পরই বাবুল বাসায় এসে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। মিতুকে শাসিয়ে বলে, ‘সব বলে দিছ না?’ এরপরই খুন হয় মিতু।”

মিতুর মা বলেন, মিতু মারা যাওয়ার পর বাবুল যেভাবে ভেঙে পড়ার অভিনয় করেছিল তাতে আমরা মিতুর সব অভিযোগ-অনুরাগ ভুলে গিয়েছিলাম। তবে তার সব অভিনয় আস্তে আস্তে ফাঁস হয়ে যায়। মিতু মারা যাবার ক’দিন পরই বাবুল বিয়ে করে। মগবাজারে সেই মেয়ের সঙ্গে বসবাস শুরু করে কিন্তু আড়াই বছরও সংসার টেকেনি। এরপর খুলনার এক মেয়েকে বিয়ে করে। সেটাও টেকেনি। কয়েক মাস আগে কুমিল্লার এক নারীকে সে বিয়ে করেছে।

শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে আর যোগাযোগ রাখেননি বাবুল আক্তার

শাহিদা মোশাররফ আরও বলেন, বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ তোলার পরই আমাদের বাসা ছেড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাবুল। আর যোগাযোগ রাখেনি। মিতু খুনের খবরও শুনতে হয়েছিল পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির কাছ থেকে। বাবুল ফোন ধরেনি। সন্তানের সামনে মাকে খুন করতে পারে বাবুল, তা এখনো ভাবতে পারি না।

বাবা মোশাররফ হোসেনের বিশ্বাস, মেয়ে হত্যার সুষ্ঠু বিচার পাবেন তিনি

নতুন মামলায় বাবুলের শাস্তির আশা মিতুর বাবার

মিতু হত্যার ঘটনায় প্রথম মামলার বাদী ছিলেন বাবুল আক্তার। ওই মামলার বাদী হিসেবে তাকে গ্রেফতারের সুযোগ না থাকায় নতুন করে হত্যা মামলা দায়েরের জন্য পিবিআই তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নিয়ে যান তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেনকে।

মামলা দায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিতুর সঙ্গে যা যা হয়েছে তার অনেক কিছুই সে লিখে গেছে। যেমন- গায়েত্রীর আগমন, হুমকি, মেসেজ দেওয়া প্রভৃতি। মুছার আচরণ, মুছাকে চিনতে না পারা, ফোন রেকর্ড, মিতু খুনের পরদিন থেকে মুছা নিখোঁজ...। মামলার এজাহারে বিশেষ কিছু না লিখলেও খুনের সম্ভাব্য সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত আমি পুলিশকে দিয়েছি। আশা করছি ন্যায় বিচার পাব। খুনি হিসেবে বাবুল আক্তারের বিচার হবেই।’

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে তৎকালীন পুলিশ সুপার ও মিতুর স্বামী বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। একপর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম। তদন্তে তার বিরুদ্ধেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার (১১ মে) ডেকে তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

গতকাল বুধবার (১২ মে) দুপুরে বাবুল আক্তারকে প্রধান আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার শ্বশুর অর্থাৎ মিতুর বাবা। মামলায় আসামি করা হয়েছে আরও সাতজনকে। তারা হলেন- কামরুল ইসলাম মুছা, কালু, ওয়াসিম, শাহজাহান, আনোয়ার, এহতেসামুল হক ভোলা ও সাকি।

অবশেষে পিবিআই’র হাতে ধরা পড়লেন বাবুল আক্তার, এখন তিনি রিমান্ডে আছেন

এদিকে, স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে তাকে আদালতে এনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার জাহান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

জেইউ/এমএআর