সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে

প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাকে হেনস্তা করতে অতি উৎসাহী ছিলেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট আমলারা। মন্ত্রণালয়ে রোজিনাকে হেনস্তার বিষয়টি লুকিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্রটি জানায়, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে এন্তার অভিযোগ তুলে ধরে কিছু আমলা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককেও উত্তেজিত করেছিলেন ঘটনার দিন। তারই রেশ ধরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘটনার পরদিন মঙ্গলবারও রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছোড়েন। রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা করা এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে ওই দিন দুপুরে তিনি বলেন, ‘তাকে (রোজিনা) আটকে রেখে কোনো ধরনের নির্যাতন বা আঘাত করা হয়নি। বরং তিনি নিজেই মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দেন।’ অবশ্য রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু সাংবাদিকদের কাছে হেনস্তার অভিযোগ তোলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছাড়া সরকারের অন্য মন্ত্রীরা অবশ্য বলেছেন, ‘রোজিনা ইসলাম ন্যায়বিচার পাবেন।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মতো কঠিন সুর তাদের কণ্ঠে নেই। 

এদিকে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোজিনাকে টানা পাঁচ ঘণ্টা আটকে রাখা; পরবর্তীতে তাকে থানায় হস্তান্তর, মামলা ও গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর বিষয়টি রোজিনার বিপক্ষে নয়, উল্টো তার পক্ষেই জনমত গড়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে শুরু করে মাঠের প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু হয়েছে এবং তা এখনও চলছে। দেশজুড়ে এমন প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড়ে এ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছেন।

দেশজুড়ে রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি অব্যাহত আছে। জাতিসংঘও এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বুধবার (১৯ মে) এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও কথা বলেছেন। সাংবাদিক সমাজকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বার্ষিকী উপলক্ষে  আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ আহ্বান জানান। তার বক্তব্যেও সহমর্মিতার বিষয়টি প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, ‘যেহেতু মামলা হয়েছে এবং বিষয়টি বিচারাধীন, তাই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ন্যায়বিচার পাবেন। তার প্রতি কোনো অবিচার হলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ ঘটনার দিন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কেউ বিষয়টি সাংবাদিকদের ব্রিফ করলে এমন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি নাও হতে পারত— বলেন ওবায়দুল কাদের।

রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে সাংবাদিকদের প্রতিবাদ 

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও মনে করছেন, সরকারকে বিব্রত করতে কোনো পক্ষ অতি উৎসাহী হয়ে রোজিনা ইস্যুটি তৈরি করছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন রয়েছে। এ সেতুবন্ধন একটা মহল নষ্ট করার চেষ্টা করছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নয়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।

জানা গেছে, ঘটনার দিন (সোমবার) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি পক্ষ বিষয়টি সুরাহার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু আমলাদের একটি অংশ মামলা করার বিষয়ে চূড়ান্ত তৎপরতা চালান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একই ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেন। কিছু আমলার ভেতরের ঐক্য এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার মাধ্যমে ছড়ানো সরকারের শীর্ষপর্যায়ে রোজিনাবিরোধী বার্তার ফলে মামলা না করে সমঝোতার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। শেষপর্যন্ত রোজিনাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে থানায় নেওয়া হয় এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মামলা দেওয়া হয়।

তবে রোজিনার মুক্তির দাবিতে রাজধানীসহ সারাদেশের গণমাধ্যমকর্মীসহ বিভিন্ন মহলের দুর্বার প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু হলে সরকারের শীর্ষ মহলের সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে তাদের কঠোর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের কাছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাঠানো তথ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে জানা গেছে, এখন সরকার রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসছে। সরকার-গণমাধ্যমের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরির সুযোগ দিতে চায় না তারা।

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পরদিন মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান। রোজিনার চিকিৎসা এবং কারাগারে যাতে আর কোনো হেনস্তার শিকার না হন সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের আশ্বাস দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) শুনানিতে রোজিনার জামিনের আশাও প্রকাশ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এটাও বলেন যে, সাংবাদিকদের সঙ্গে সরকারের কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি হোক তা তারা চান না। তথ্যমন্ত্রীও বিষয়টির সুন্দর সমাধানের কথা বলেন এদিন।

বুধবার (১৯ মে) দুপুরে চট্টগ্রামে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে তথ্য কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশনের মাধ্যমে যে কেউ যে কোনো তথ্য সরকারের কাছে চাইতে পারে। তথ্য কমিশনের মাধ্যমে শুধু সে তথ্যই তিনি পাবেন না যেটা নন-ডিসক্লোজার আইটেম। এক্ষেত্রে গোপন নথি পাচার অন্যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে রোজিনা ইসলামের মামলার ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।

পুলিশ বেষ্টিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আদালতে নেওয়া হচ্ছে

এর আগে (মঙ্গলবার রাতে) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবেন। আমি শুধু এটুকু বলব, সরকার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হোক—এ রকম কোনো সন্দেহ যদি থাকে, তাহলে সরকার সেটি দূর করার চেষ্টা করবে। পরশুদিন বোধ হয় জামিনের শুনানি আছে, সেটি আদালত নিশ্চয়ই দেখবেন, সবকিছু বিবেচনা করবেন। আমিও প্রসিকিউশনকে মামলাটা খতিয়ে দেখার জন্য বলব। তবে এটুকু বলতে পারি, অবশ্যই তিনি (রোজিনা ইসলাম) ন্যায়বিচার পাবেন।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বুধবার বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা যেসব মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি তারা শুরু থেকেই ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। রোজিনাকে যারা হেনস্তা করেছে আমরা তাদের শাস্তি চাই। রোজিনা ন্যায়বিচার পাবেন, মন্ত্রীদের এমন আশ্বাসে আমরা আশাবাদী হতে চাই।

রোজিনার জামিনে মুক্তির বিষয়ে তার পরিবারের লোকজনও আশাবাদী। এ বিষয়ে রোজিনার স্বামী মনিরুল ইসলাম মিঠু ঢাকা পোস্টকে বুধবার বিকেলে বলেন, রোজিনার জামিন হবে- এ আশা আমরা করছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবসহ অন্যরা ভুল তথ্য দিয়ে বিষয়টিকে আজ জটিল অবস্থায় নিয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, রোজিনার মুক্তির দাবিতে যখন আন্দোলন শুরু হয়, পরবর্তীতে রোজিনার গলা টিপে ধরা এবং নানাভাবে হেনস্তার কঠোর সমালোচনা মুখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পরিস্থিতি প্রতিকূলে যাচ্ছে ভেবে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা তা বয়কট করেন। পরে বাধ্য হয়ে মন্ত্রণালয় অর্থ খরচ করে মুদ্রিত সংবাদপত্রে বুধবার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে। সেখানে রোজিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ উপস্থাপন করা হয় যাতে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তাদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে না পড়ে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় দায়ের করা মামলায় যেসব অভিযোগ করা হয়েছিল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা-ই প্রকাশের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রকাশের এমন চেষ্টাও মানুষ বাঁকা চোখে দেখেন। 

এ অবস্থায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা গণমাধ্যমকর্মীদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি নন। ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ব স্বাস্থ্য অনুবিভাগ) কাজী জেবুন্নেছা বেগমের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। দফতরে যোগাযোগ করা হলে কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

পিএসডি/এমএআর