ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে করোনার ভ্যাকসিন চুক্তির ধরন নিয়ে দ্বিমুখী বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান বলছেন এককথা, অন্যদিকে ভ্যাকসিনটির আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাজমুল হাসান পাপন বলছেন ভিন্ন কথা।

সোমবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান জানান, ভ্যাকসিন নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চুক্তি হয়েছে, এটি জিটুজি চুক্তি। তবে সন্ধ্যায় নিজ বাসভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন নাজমুল হাসান পাপন।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সচিব হয়তো ভারতের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে অন্য কোনো চুক্তির বিষয়ে বলেছেন। এই চুক্তি সরকারের সঙ্গে সরকারের নয়, বরং সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চুক্তি। কিন্তু তিনি (স্বাস্থ্য সচিব) কীভাবে এটাকে সরকারের চুক্তি বলে দাবি করেন, আমার জানা নেই।

আমি এখনই ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনরাকে ফোন করলাম। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আমরা যে চুক্তি করেছি তার টাকা কীভাবে যাবে, কীভাবে ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে— সেসব কাজ হয়েছে জিটুজি বা সরকার টু সরকারের মাধ্যমে

স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান

পাপন বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে ভ্যাকসিন এনে আমরা সরকারকে সাহায্য করছি। আমরা এই ভ্যাকসিন না আনলে সরকার কোনোভাবেই আনতে পারত না। বেক্সিমকো যদি ভ্যাকসিন না আনে, তাহলে বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠান এতটা সাহস করতে পারে? আমরা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দামে সরকারকে ভ্যাকসিন আমদানি করে দিচ্ছি।

মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, পাশে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান

এর আগে দুপুরে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমি এখনই ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনরাকে ফোন করলাম। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আমরা যে চুক্তি করেছি তার টাকা কীভাবে যাবে, কীভাবে ব্যাংক গ্যারান্টি দেবে— সেসব কাজ হয়েছে জিটুজি বা সরকার টু সরকারের মাধ্যমে। যে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার কথা ভারত সরকার বলেছে শুধুমাত্র কমার্শিয়াল অ্যাকটিভিটিজের (বাণিজ্যিক কার্যক্রম) ওপর, আমাদেরগুলোর ওপর নয়। কারণ আমাদেরটা সরকার টু সরকার।’

স্বাস্থ্য সচিব হয়তো ভারতের সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে অন্যকোনো চুক্তির বিষয়ে বলেছেন। এই চুক্তি সরকারের সঙ্গে সরকারের নয়, বরং সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চুক্তি। কিন্তু তিনি (স্বাস্থ্য সচিব) কীভাবে এটাকে সরকারের চুক্তি বলে দাবি করেন, আমার জানা নেই

নাজমুল হাসান পাপন, এমডি, বেক্সিমকো ফার্মা

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে সকাল থেকে কাজ করছি। বেক্সিমকো, ফরেন মিনিস্ট্রি ও ভারতের মিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছেন, আমাদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে সেই চুক্তি ব্যাহত হবে না। কোনো সমস্যা হবে না, আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’

ভ্যাকসিন আসবেই: পাপন

ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে নাজমুল হাসান পাপন বলেন, সেরামের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছে যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমাদের দেশ থেকে অনুমোদন পাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আমরা ভ্যাকসিন পেয়ে যাব।

তিনি বলেন, সেরামের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, এটা একটি আন্তর্জাতিক মানের চুক্তি। সুতরাং এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমরা চিন্তিত নই।

নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন নাজমুল হাসান পাপন

তিনি আরও বলেন, ছয়টি ধাপে তারা আমাদের ভ্যাকসিন দেবে। ৫০ লাখ করে ছয় মাসে মোট তিন কোটি ভ্যাকসিন আমরা পাব।

এদিকে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশকে দুশ্চিন্তা না করার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন বাংলাদেশ যথাসময়ে পাবে বলে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে।

সোমবার (৪ জানুয়ারি) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আব্দুল মোমেন এ তথ্য জানান।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের যেসব বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে সেগুলো ঠিক থাকবে। বাংলাদেশ যথাসময়ে ভ্যাকসিন পাবে। ওরা বলেছে, ভ্যাকসিন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির যে আলাপ হয়েছে সেটা ঠিক থাকবে। ভারত প্রথম ভ্যাকসিন আমাদেরই দেবে। তাই এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।’

করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পেতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আগেই চুক্তি করে রেখেছিল বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। এ চুক্তির মাধ্যমেই ভারতে উৎপাদিত করোনার ভ্যাকসিন পাবে বাংলাদেশ— এমটাই কথা ছিল। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহীর সংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাদের ভ্যাকসিন রপ্তানিতে আগামী কয়েক মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি উঠে আসে। এতে উদ্বেগের মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশ।

অক্সফোর্ডের টিকার অনুমোদন দিল ওষুধ প্রশাসন

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি করোনার টিকা জরুরিভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সোমবার (৪ জানুয়ারি) রাতে ঢাকা পোস্টকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক আইয়ুব হোসেন।

তিনি বলেন, সন্ধ্যায় আমাদের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আমরা এই ভ্যাকসিনের সব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেছি এবং ভ্যাকসিনটি জরুরি ব্যবহারের বিষয়ে একটি অনাপত্তিপত্র (এনওসি) জারি করেছি।

আইয়ুব হোসেন বলেন, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে এনওসি সংগ্রহ করেছে এবং এটি ব্যবহার করে তারা এখন ভারত থেকে ভ্যাকসিন আনার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে।

টিআই/এইচকে/এমএআর/