প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উদযাপন করে বাংলাদেশ পুলিশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের কারণে ২০১৯ সালে পুলিশ সপ্তাহ হয় ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। ২০২৪ সালেও একই কারণে (জাতীয় নির্বাচন) পুলিশ সপ্তাহ পিছিয়ে হয় ফেব্রুয়ারিতে।

এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কবে হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার এখনও পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়নি পুলিশ সদরদপ্তর। সংগত কারণে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে বাহিনীটির কোনো ইউনিটকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। কবে নাগাদ হতে পারে পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন, সেটিও কেউ বলতে পারছেন না।

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একগুচ্ছ দাবি উত্থাপন করে পুলিশ। দাবি পূরণের আশ্বাসও দেন দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। সেখানে প্রধান অতিথি ভাষণ দেন, সভাপতিত্ব করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ চৌকস কর্মকর্তাদের বিপিএম ও পিপিএম প্রদান করেন প্রধান অতিথি। ‘স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট দেশ শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’— এ স্লোগানকে ধারণ করে সর্বশেষ গত বছর অনুষ্ঠিত পুলিশ সপ্তাহে প্রধান অতিথি ছিলেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ ও দেশত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কবে হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার এখনও পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়নি পুলিশ সদরদপ্তর। সংগত কারণে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে বাহিনীটির কোনো ইউনিটকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। কবে নাগাদ হতে পারে পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন, সেটিও কেউ বলতে পারছেন না।

গত বছর ৪০০ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম), বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-সেবা এবং রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)-সেবা দেওয়া হয়।

জুলাই বিপ্লবের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় / ফাইল ছবি

গত বছরের পুলিশ সপ্তাহে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন পুলিশ সদস্যরা। যার মধ্যে অন্যতম ছিল- পদোন্নতি জট নিরসন ও সুপার নিউমারারি পদ নিয়মিত করা। দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে নিয়োগের পাশাপাশি, বিদেশি মিশনগুলোতে প্রেষণে পুলিশ অফিসারদের নিয়োগের দাবিও উত্থাপন করা হয়।

এ ছাড়া নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ঋণ ও পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঝুঁকি ভাতা, নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের জন্য সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি জট কমানোসহ পুরোনো দাবিগুলো ফের তুলে ধরা হয়।

পুলিশ সপ্তাহে প্রতি বছরই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক হয় পুলিশের। ওই সব বৈঠকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিটের পক্ষ থেকে পৃথক বৈঠকে পুলিশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি উত্থাপন করা হয়

পুলিশ সপ্তাহে প্রতি বছরই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক হয় পুলিশের। ওই সব বৈঠকে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ছাড়াও বিভিন্ন ইউনিটের পক্ষ থেকে পৃথক বৈঠকে পুলিশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি উত্থাপন করা হয়।

পুলিশ সপ্তাহ এবার সহসা না হবার নেপথ্যে

চাকরিতে কোটা সংস্কার প্রশ্নে তেঁতে ওঠা আন্দোলন আরও তেঁতে ওঠার নেপথ্যের অন্যতম কারণ ছিল পুলিশের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ। যার প্রথম নজির স্থাপিত হয় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আন্দোলন দমাতে পুলিশের মারমুখী অবস্থান অতীতের সব সমালোচনাকে ছাড়িয়ে যায়।

নির্মমতা, গুম কিংবা বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে গত ১৫ বছর ধরে- বলছেন সংশ্লিষ্টরা / ফাইল ছবি

ছাত্রদের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণরোষের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। তোপের মুখে পড়ে পুলিশ। থানা, ট্র্যাফিক স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের মারধর, এমনকি তাদের হত্যার ঘটনাও ঘটে। সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষের মধ্যে ডিএমপিসহ পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী এবং সরকার ও আওয়ামী ঘেঁষা সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে হন গ্রেপ্তার।

৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখন নিজ নির্ভরতায় গতিশীল হচ্ছে পুলিশ। তবে, প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিরূপ পরিস্থিতি অথবা আন্দোলনের মুখে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর সদস্যদের

পুলিশপ্রধান, ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাবপ্রধানসহ সব ইউনিটে নেতৃত্বের পরিবর্তন আসে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখন নিজ নির্ভরতায় গতিশীল হচ্ছে পুলিশ। তবে, প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিরূপ পরিস্থিতি অথবা আন্দোলনের মুখে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীর সদস্যদের। এর মধ্যে ছিনতাই, ডাকাতি, যানজটের মতো নিত্যদিনের সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মমতা, গুম কিংবা বিরোধী কণ্ঠ দমনে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে গত ১৫ বছর ধরে। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাহিনীটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশকে পেশাদার, জনমুখী ও সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কার প্রক্রিয়া যেহেতু শুরু হয়েছে, সংগত কারণে সংস্কার কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন ফরমেটে হতে পারে পুলিশ সপ্তাহ।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা / ফাইল ছবি

কবে হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ

পুলিশ সপ্তাহ কবে হচ্ছে— জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি (এইচআরএম, চলতি দায়িত্ব) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদের কাছ থেকে।

তবে, পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এবার কবে নাগাদ পুলিশ সপ্তাহ হবে তা নিশ্চিত নয়। কারণ, এবার এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগে তো সিদ্ধান্ত, তারপর না প্রস্তুতি। সিদ্ধান্ত হলে জানতে পারবেন।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা এখনও কিছু জানি না। নির্দেশনা পাইনি। নির্দেশনা পেলে ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হবে।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ / ফাইল ছবি 

একই তথ্য দেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এ কে এম আওলাদ হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন অনেক প্রস্তুতির বিষয়। প্রতি বছরই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে আয়োজন করা হয়। এবার এখনও নির্দেশনা পাইনি। সামনে রমজান, ঈদও আছে। পুলিশ সপ্তাহের সিদ্ধান্ত হলে ঈদুল ফিতরের আগে হয়তো সম্ভব নয়।’

পরিবর্তিত পরিস্থিতি, আয়োজন পরের বছর যৌক্তিক হতে পারে

এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ সপ্তাহে নিজেদের কাজকর্ম ও পারফরম্যান্স হিসাবনিকাশ করা হয়। আরেকটা হচ্ছে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক। সরকারপ্রধান আসেন, ভাষণ দেন। এই পুলিশ সপ্তাহে সরকারের অনেক টাকা-পয়সাও খরচ হয়। এখন তো কৃচ্ছ্রসাধন করছে সরকার। অতএব নিজেদের কাজকর্মের হিসাব হতেই পারে। কিন্তু সামনে তো রমজান। এই অল্প সময়ে পরিবর্তিত এই পরিস্থিতির মধ্যে পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন হয়তো সম্ভব হবে না। পূর্ণাঙ্গ পুলিশ সপ্তাহ না করে এক বা দুইদিনের একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে পুলিশের কাজকর্ম ও পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা এখন সম্ভব, যদি সরকার রাজি হয়।

৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে কি এবার পুলিশ সপ্তাহ হতে দেরি হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটা কারণ হতে পারে। তবে, এবার করতেই হবে এমনও নয়। যেহেতু পরিবর্তিত পরিস্থিতি, পরের বছরও করা যেতে পারে। আর স্বীকৃতি তো ভালো কাজের হয়, উৎসাহ দেবার জন্য। যেটি খারাপ, সেটির মূল্যায়নের জন্য পুলিশ সপ্তাহের দরকার পড়ে না। এজন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা, ফৌজদারি ব্যবস্থা তো আছে।’

‘আমি মনে করি, বিশেষ পরিস্থিতির কারণে মিনিমাম দুই/একদিনের জন্য এই উদযাপনটা আয়োজনের চেয়ে পরের বছর ভালো করে করাটা যৌক্তিক। কারণ, এই অনুষ্ঠান ঘিরে অনেক ইন্টারেকশন হয়, অনেক সদস্যকে ঢাকায় আসতে হয়। খরচের বিষয় তো আছেই।’

বাহিনীটির সাবেক প্রধানরা বলছেন, সরকার ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন করতে পারে / ফাইল ছবি 

সরকার কী চাইছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকার কী চাইছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার চাইলেই সম্ভব। সরকার চাইছে কি না, সেটি সার্ভিস কর্মকর্তারা বলতে পারবেন। তবে, পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন করাই হয় সদস্যদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য, তারাও উজ্জীবিত হন। সেটি করা গেলে ভালো।’

জেইউ/এমএআর