নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল
বিদেশি বিনিয়োগ বনাম পুরোনো সুবিধাভোগী, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?
ইনফোগ্রাফ / ঢাকা পোস্ট
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব আন্তর্জাতিক অপারেটরকে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এমন সিদ্ধান্তে বন্দরের দক্ষতা ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, সরকারের এমন উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে একটি পক্ষ। তাদের যুক্তি, এনসিটি বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হতে পারে। পাশাপাশি তাদের মন্তব্য, দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে টার্মিনালটি পরিচালিত হোক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে এনসিটি পরিচালনা করে আসছে সাইফ পাওয়ারটেক। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্দরের সবচেয়ে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান এটি। এখন সময় হয়েছে সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানটিকে বাদ দিয়ে সুষ্ঠু টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। যদিও কেউ কেউ ‘দেশীয় প্রতিষ্ঠান’-কে এটি পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে ‘আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত’ বলে অভিযোগ করেছেন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা রাসেল আহমেদসহ একটি গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের দোসর হলেও তারা সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন!
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, গত ২৩ এপ্রিল রাসেল আহমেদের নেতৃত্বে ‘বন্দর রক্ষা আন্দোলন’ নামে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন নগরীর কাস্টমস মোড়ে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ইস্যুতে মিছিল ও সমাবেশ করে। যদিও এতে উপস্থিতি ছিলেন হাতেগোনা ২০ থেকে ২৫ জন। এরপর ২৬ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যক্তিগত আইডি থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার দাবি জানান রাসেল আহমেদ। সেখানে বৈষম্যবিরোধী অন্য ছাত্রনেতারা বিরূপ মন্তব্য করেন।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
রাসেলের পাশাপাশি টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে তুলে না দিতে একাধিকবার বিবৃতি দেয় চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতও। সর্বশেষ দলটি গত ২০ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে। সেখানে দলটির মহানগর আমির শাহজাহান চৌধুরী একই দাবি উপস্থাপন করেন। তবে, তিনি বন্দরের এ টার্মিনাল পরিচালনাকারী সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করেননি।
বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা হলো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটি অপারেটরের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনা করা। যাতে কনটেইনার খালাসের সময় ও ব্যয় হ্রাস পায়। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ে। সিঙ্গাপুর, দুবাই, কলকাতা এমনকি মুম্বাইসহ আধুনিক বিভিন্ন বন্দরে আন্তর্জাতিক অপারেটরদের অংশগ্রহণ রয়েছে। এ অবস্থায় ‘বন্দর রক্ষা আন্দোলন’-এর নামে বিরূপ প্রচারণা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। ‘বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে না দেওয়া’র দাবিটি সরাসরি সাইফ পাওয়ারটেকের পক্ষে যাচ্ছে।
তাদের মন্তব্য, বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করছে সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটি) নামের বিদেশি প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বে-টার্মিনালের কয়েকটি টার্মিনাল বিদেশিদের পরিচালনার দায়িত্ব দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দেশের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিদেশিদের আহ্বান জানাচ্ছে। সম্প্রতি রাজধানীতে বিদেশিদের নিয়ে বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের মানুষও এটিকে স্বাগত জানিয়েছে।
আরও পড়ুন
বন্দরের ওই কর্মকর্তাদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে নানা খাতে অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অথচ এসব গুরুতর সমস্যা উপেক্ষা করে এনসিটি পরিচালনা নিয়ে হঠাৎ করে সরব হয়ে উঠেছে ওই পক্ষটি। টার্মিনাল নিয়ে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তার আসল উদ্দেশ্য দেশের স্বার্থ রক্ষা নয় বরং পুরোনো সুবিধাভোগী সাইফ পাওয়ারটেককে আবারও সিস্টেমে ঢুকিয়ে দেওয়া। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষে স্লোগানের আড়ালে তারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ব্যবসায়ীকে ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সম্প্রতি রাসেল আহমেদের দেওয়া স্ট্যাটাসে বৈষম্যবিরোধীর ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক আরিফ মঈনুদ্দিন লেখেন, ‘আগে লীগের দোসর সাইফ পাওয়ারটেককে বন্দর থেকে আউট করতে বলো। এরপর দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি যে সর্বোচ্চ বিট করবে সে-ই পাবে। সাইফ পাওয়ার টেককে বন্দর থেকে আউট করার আন্দোলন করলে বলিও। সাথে আছি।’
২৬ এপ্রিল দেওয়া সেই স্ট্যাটাসে রাসেল আহমেদ লেখেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত বন্দর কার স্বার্থে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে? ক্রিমিনালি ও ষড়যন্ত্র কিংবা সমালোচনা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থে, সার্বভৌমত্বের স্বার্থে কথা বলে যাব। কেউই বিরত রাখতে পারবে না।’
সেই স্ট্যাটাসে ফাহাদ ওমর নামের একজন লেখেন, ‘বিদেশিদের হাতে না গেলে তো এই যে সাত আওয়ামী কোম্পানি আছে, সেগুলোর হাতে যাবে। তো এগুলোর বিরুদ্ধে কথা কেন বলো না? কারণ, বললে উনারা রাগ করবে তা-ই না।’
দেশীয় প্রতিষ্ঠান মানেই কি সাইফ পাওয়ারটেক
২০০৫ সালে বন্দরের যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে সাইফ পাওয়ারটেক। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির শীর্ষ নেতাদের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংসহ নানা খাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সরকারের উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ টেন্ডার না দিয়েই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে বছরের পর বছর চুক্তি নবায়ন করে। আবার কোনো সময় টেন্ডার হলেও নীতিমালায় এমন সব শর্ত দেওয়া হয় যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতায় যেন টিকতে না পারে।
চট্টগ্রাম বন্দরে সাইফ পাওয়ারটেকের আধিপত্য ব্যবসায়িক কৌশলের ফল নয়। এর পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা। বিশেষ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও একাধিক প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘদিনের। এ ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সাইফ পাওয়ারটেক নিয়ম ভেঙে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।
আরও পড়ুন
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, নূর-ই-আলম চৌধুরী, সামশুল হক চৌধুরী ও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনসহ দলটির শীর্ষ নেতারা। এ ঘনিষ্ঠতাই ছিল তার প্রধান সম্পদ। এর মাধ্যমে তিনি কেবল বন্দর নয়, দেশের আরও অনেক বড় সরকারি প্রকল্পে প্রবেশাধিকার পান।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, কর্তৃপক্ষকে ব্যবহার করে সাইফ পাওয়ারটেক ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) পদ্ধতিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ছাড়া নিয়মিতভাবে কাজ পেয়ে আসছে। যেখানে উন্মুক্ত দরপত্রের বাধ্যবাধকতা থাকে না। সরকারি বিধিমালা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে একের পর এক চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে। তাদের একচেটিয়া অবস্থান নিশ্চিত করতে কোনো কোনো সময় বন্দরের প্রচলিত নিয়ম পর্যন্ত বদলে দেওয়া হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২২ সালে দুবাইভিত্তিক কোম্পানি সাফিন ফিডারের সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণা দিয়ে শেয়ারদর বাড়িয়ে পুঁজিবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে। এর বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে খোলা প্রতিষ্ঠান ‘সাইফ মেরিটাইম এলএলসি’-এর অর্থ বাংলাদেশ থেকে কীভাবে পাচার হয়েছে, তা নিয়ে তদন্ত চলছে। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, রাজস্ব ফাঁকি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সরকারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
বন্দর ব্যবহারকারী এক ব্যবসায়ী জানান, রাজনৈতিক দাপট এবং একচেটিয়া সুবিধাভোগের ইতিহাসই বলে দেয় সাইফ পাওয়ারটেক কখনও ব্যবসার গুণে নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির বলয়ে থেকে বন্দরে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। আজ যখন সরকার পরিবর্তনের পর স্বচ্ছতা ফেরানোর চেষ্টা হচ্ছে, তখন তারা আবারও নতুন পথ বেছে নিয়ে ফিরে আসতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভিন্ন গোষ্ঠীর হাত ধরে কিন্তু একই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘোষণা দিয়েছিলেন, বন্দর-সংশ্লিষ্ট সব কাজ এখন থেকে উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে দেওয়া হবে এবং একক আধিপত্য ভাঙা হবে। তবে, বর্তমান অবস্থা দেখে তার ঘোষণা কতটুকু বাস্তবায়ন হয় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক আরিফ মঈনুদ্দিন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাইফ পাওয়ারটেককে আর এক মিনিটের জন্যও বন্দরে দেখতে চাই না। এজন্য বন্দর চেয়ারম্যানকে যা যা সাপোর্ট দেওয়া লাগবে আমরা দেব। বন্দর রক্ষা আন্দোলনের নামে যে কর্মসূচি হয়েছে সেটার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশেষ একটা চুক্তিকে উদ্দেশ্য করে কারা এবং কেন এ আন্দোলন করেছে, কার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে; আমি জানি না। তবে, আমরা ছাত্ররা চট্টগ্রাম বন্দরে আওয়ামী লীগের দোসর সাইফ পাওয়ারটেকের আর একচেটিয়া দৌরাত্ম্য দেখতে চাই না। সাইফ পাওয়ারটেকের তরফদার রুহুল আমিন আওয়ামী লীগ সরকারের কেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এটা আমরা সবাই জানি।’
‘স্বৈরাচারের সুবিধাভোগী দোসরদের বন্দর থেকে বিতাড়িত করতে হবে। কোম্পানি দেশি-বিদেশি যা-ই হোক দরপত্র ডেকে সর্বোচ্চ বিট করা কোম্পানির সঙ্গে যেন চুক্তি হয়, যাতে রাজস্ব আদায় সর্বোচ্চ হয়; সে-ই চেষ্টা থাকতে হবে। ড. ইউনূসের কারণে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। তাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে-ই চিন্তা থাকা উচিত।’
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল এনসিটি। প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা এ টার্মিনালে একসঙ্গে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচটি জাহাজ ভেড়ানো যায়। এখানে চারটি জেটি রয়েছে এবং বন্দরের মোট কনটেইনারের প্রায় অর্ধেক হ্যান্ডলিং করা হয়। এটিতে ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তি-সম্বলিত ইয়ার্ড। কনটেইনার ওঠা-নামা করার জন্য রয়েছে ১৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন। পাশাপাশি কনটেইনার স্থানান্তরের যত যন্ত্র দরকার, সবই আছে টার্মিনালটিতে।
বন্দর-সংশ্লিষ্ট একজন জানান, এ টার্মিনালের উন্নয়নে যত বিনিয়োগ সবই করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবহার করে কোনো প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই টার্মিনালটি থেকে সাইফ পাওয়ারটেক হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দেশীয় অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে তেমন সুযোগ দেওয়া হয়নি। এখন সবাই বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে না দেওয়ার জন্য দাবি তুললেও সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলছে না। এর মানে যারা আন্দোলন করছে তাদের উদ্দেশ্য সাইফ পাওয়ারটেককে বহাল তবিয়তে রাখা।
আরও পড়ুন
যদিও বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। গত ২৪ এপ্রিল বন্দর দিবসের মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বন্দরের সেবার মান ও দক্ষতা বাড়বে। পাশাপাশি বড় অঙ্কের আর্থিক লাভ হবে। কারও চাকরি যাবে না। যেমন- পতেঙ্গা টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে দেওয়ার পরও ঊর্ধ্বতন কয়েকজন ছাড়া সব বাংলাদেশি সেখানে কাজ করছে।’
অভিযোগের বিষয়ে বন্দর রক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত রাসেল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা ছিল পিসিটি ও এনসিটি টার্মিনাল বিদেশিদের তত্ত্বাবধানে দেওয়ার। পিসিটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তেমন বিনিয়োগ আসেনি। উল্টো দেশের তিনটি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে তারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। সেখান থেকে কী লাভ হয় আমরা জানি না এবং ভেতরে কী হয় তাও বাংলাদেশের মানুষ জানে না।’
‘ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও বন্দর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমাদের কিছু শঙ্কা রয়েছে। আমাদের দাবি হচ্ছে, এনসিটি দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া। আবার বিদেশিদের দেওয়া হলেও যেন সেটি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে হয়, নিয়ন্ত্রণ যাতে পোর্টের হাতেই থাকে। এনসিটি সরাসরি বিদেশিদের দেওয়া হলে একটু হলেও দেশের সার্বভৌমত্ব প্রসঙ্গে প্রশ্ন জাগবে।’
‘আমাদের দাবির বিষয়ে পরবর্তী সময়ে স্মারকলিপি দেব। শুধু এনসিটি নয়, আপনারা দেখবেন বন্দরের নানা অব্যবস্থাপনা নিয়েও আমরা কথা বলছি।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এনসিটি ইস্যুতে আমরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছি যে, বিদেশিদের কাউকে যেন টার্মিনাল না দেওয়া হোক। প্রয়োজনে বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব লোকবলের মাধ্যমে পরিচালনা করুক। এক্ষেত্রে নতুন সরকার বিবেচনা করবে ফ্যাসিবাদের আমলে সুবিধাভোগী কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেবে, নাকি নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেবে।’
অভিযোগের বিষয়ে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাইফ পাওয়ারটেক ২০ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার (২০ ফুট সমমানের কনটেইনার) হ্যান্ডলিং করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ টার্মিনালে বার্ষিক ১০ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার কথা। সেখানে আমরা এক বছরে প্রায় ১৩ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছি। ২০০৬ সালে আমরা বন্দরে কাজ শুরু করি। তখন জাহাজের গড় অবস্থান সময় ছিল ১২ থেকে ১৪ দিন। আমরা সেটিকে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছি। এ টার্মিনালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ভেসেল অপারেটর আসে, তারা আমাদের সর্বোচ্চ দক্ষতার সনদ দিয়েছে।’
‘কিন্তু এখন বলা হচ্ছে এনসিটিতে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার। বাস্তবে এখানে সর্বোচ্চ আইটি খাতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। এ কারণে আমরা চাই টার্মিনালটিকে টেন্ডারের মাধ্যমে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হোক। আমরা এখন দেশে ভালোভাবে টার্মিনাল পরিচালনা করে বিদেশি যেতে চাচ্ছি। এ অবস্থায় সরকারের উচিত আমাদের মতো বাংলাদেশি কোম্পানিকে সাপোর্ট দেওয়া।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মানুযায়ী কাজ পেয়েছি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের সখ্যতার প্রশ্নই ওঠে না। এটি ভুল কথা। আমরা পিউর ব্যবসায়ী। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না। যখন যে সরকার আসে তাদের সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে হয়।’
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসবের প্রশ্নই ওঠে না।’
গত ৩০ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিশ্বমানের সেবা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনায় এমন অপারেটরদের সম্পৃক্ত করতে হবে যাতে আমাদের পোর্টগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। আমরা যে ইনভেস্টমেন্ট হাবের কথা বলছি তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের বন্দরগুলোকে বিশ্বমানের করতেই হবে।’
পরে ২ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে যে পরিমাণ কাজে লাগানোর কথা আমরা তা পারছি না। এটিসহ দেশের সব বন্দর পরিচালনার জন্য বিশ্বের টপ অপারেটরদের সঙ্গে কথা চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরকার একাধিক বন্দর পরিচালনার ভার তাদের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলাচ্ছে। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেও অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। আবার জিটুজি (সরকার থেকে সরকারে) ভিত্তিতেও অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।’
এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (৮ মে) বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (ভেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বন্দরের বিভিন্ন টার্মিনাল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘পোর্ট ক্যাপাসিটি এখন লিমিটেড। ছয় গুণ করার পরও ভিয়েতনামের ধারে কাছেও যাবে না। তাই এক্সপার্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। যেন কম জায়গায় বেশি অপারেশন করা যায়। দুবাইতে জেবেদ আলী পোর্টে ভিজিট করার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে পোর্ট অপারেটররা একটা কন্ট্রোল রুমে বসেন। তারা এসি রুমে বসে ক্রেন অপারেট করেন। এখানে আমরা একটি কনটেইনারের ওপরে তিনটা বা চারটা করে রাখতে পারি। ওইখানে তারা একটির ওপরে ১৬টি পর্যন্ত কনটেইনার রাখে।’
একই দিন চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু হোটেলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আমার এখানে কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, অনেকের ভুল তথ্য দেখছি। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি অপারেটরকে দিলে অনেকে বলছেন, জব চলে যাবে। আমি বলছি, জব যাবে না বরং আরও ১০ গুণ বাড়বে। যে যেখানে জব করছেন, তার চেয়ে আরও দশ গুণ জব বাড়বে।’
এমআর/এমজে