বৈশ্বিক মহামারি করোনার (কোভিড-১৯) কারণে দেড় বছর ধরে থমকে আছে জনজীবন। সরকার ঘোষিত নানা বিধিনিষেধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন এসেছে। কখনো ‘লকডাউন’, কখনও ‘বিধিনিষেধ’ আবার কখনও ‘কঠোর বিধিনিষেধ’— এসবের মধ্যে দেশের বিচার ব্যবস্থার (আদালত) স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও একরকম থমকে আছে। চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক মামলার শুনানি স্থগিত করা হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘব-বোয়ালদের দ্রুত বিচারের বিষয়টিও তাই আটকে যায়। তবে কিছু কিছু মামলার জামিন ও রিমান্ড শুনানি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়।

দেশের আদালতসমূহে এখন কেবল সদ্য গ্রেফতার হওয়াা আসামিদের রিমান্ড, জামিন এবং নতুন মামলার ফাইলিং (নিবন্ধন) শুনানি চলে সশরীরে। এছাড়া মামলা সংক্রান্ত বাকি সব কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। স্থগিত রয়েছে অনেক মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরাও। ফলে অধিকাংশ মামলার বিচারিক কার্যক্রম আটকে গেছে।

বরখাস্ত হওয়া পুলিশের ডিআইজি মিজান ও তার স্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা, বরখাস্ত হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের ঘুষ লেনদেনের মামলা, কারা অধিদফতর হেডকোয়ার্টারের বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদের দুর্নীতি মামলা, বরখাস্ত হওয়া ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের দুর্নীতি মামলা এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলাগুলো সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে।

আদালত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি না এলে এসব মামলার অন্তত কয়েকটির রায় ঘোষণা হতো। তারা আশা করছেন, আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হলে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা যাবে। 

বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানকে আদালতে তোলা হচ্ছে

৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনে মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা

৪০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমান ওরফে মিজান ও দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

গত বছরের (২০২০) ১৯ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন। একই বছরের ১৮ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

ডিআইজি মিজান ও তার স্ত্রীসহ চারজনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং মামলা

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং আইনে ডিআইজি মিজান ও তার স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্নাসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ২০১৯ সালের ২৪ জুন দুদকের পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি মঞ্জুর মোর্শেদ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। একই বছরের (২০২০) ২০ অক্টোবর ডিআইজি মিজানসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

ঘুষ লেনদেনের মামলায় দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির ফেঁসে যান 

মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ৬ এর বিচারক আল-আসাদ মো. আসিফুজ্জামানের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। মিজান ও তার স্ত্রী ছাড়াও মামলার অপর আসামিরা হলেন- মিজানের স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্নার ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান ও ভাগ্নে মাহমুদুল হাসান।

মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে তিন কোটি ২৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তিন কোটি সাত লাখ পাঁচ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদকে আদালতে তোলা হচ্ছে

ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজি প্রিজন বজলুর রশিদের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর দুদকের উপ-পরিচালক মো. নাসির উদ্দীন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। গত বছরের ২৬ আগস্ট মো. নাসির উদ্দীন বজলুর রশীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই বছরের (২০২০) ২২ অক্টোবর আদালত বজলুর রশিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

মামলায় তার বিরুদ্ধে তিন কোটি ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯০২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়। মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেনের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে।

ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে

পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ

ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই দণ্ডবিধি ১৬১ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪ (২) ধারায় মামলা করে দুদক। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

গত বছর ২৪ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. সালাহউদ্দিন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। একই বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেন। এরপর মামলাটির বিচারিক কার্যক্রমের জন্য বিশেষ জজ আদালত-১০ এ বদলি করা হয়। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম মামলাটির শুনানি নিয়ে বিব্রত বোধ করেন। পরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ৫ এ এটি বদলির আদেশ দেন।

মামলায় ডিআইজি প্রিজন পার্থ গোপাল বণিকের বিরুদ্ধে ‘সরকারি চাকরিতে দায়িত্বরত অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে ৮০ লাখ টাকা অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগ’ আনা হয়। তিনি এসব টাকা কোনো ব্যাংক হিসাবে জমা না রেখে বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে নিজ বাসস্থানে লুকিয়ে রাখেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত- ৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেনের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা

২০১৯ সালের ১০ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ (এস কে সিনহা) ১১ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

ওই বছরের ডিসেম্বরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক পরিচালক বেনজীর আহমেদ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। গত বছরের ৫ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েশ অভিযোগপত্রটি আমলে নেন এবং ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা হয়

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখা থেকে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে চার কোটি টাকার ঋণ নেন। ওই টাকা একই দিনে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আসামি এস কে সিনহার ব্যক্তিগত হিসাবে (অ্যাকাউন্ট) স্থানান্তর করা হয়। পরে এস কে সিনহা নগদ, চেক ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেন, যা দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

মামলায় এস কে সিনহা ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীম, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান, একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা, রনজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি)। 

মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মো. জিয়াউদ্দিন আহমেদ তদন্তকালে মারা যাওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আটকে থাকা এসব মামলার বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাগুলো গুরুত্ব দিয়ে ট্রায়াল (বিচার) করা হচ্ছে। এর মধ্যে এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং পুলিশের ডিআইজি মিজান ও দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষের দিকে। তবে করোনার কারণে আদালতের সাক্ষ্যগ্রহণের কার্যক্রম স্থগিত থাকায় মামলার প্রক্রিয়া থেমে আছে। আমরা আশা করছি আদালতের কার্যক্রম স্বাভাবিক হলে এগুলোর নিষ্পত্তি দ্রুত করতে পারব।

টিএইচ/এমএইচএস/এমএআর/