পুলিশের মানবিক মুখ ডিসি মাসুদ
‘আ. লীগ নেতাকর্মীদের ভুল ভাঙে যখন আমরা পাল্টা গুলি চালাই’
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে যখন রাজপথে চলছিল গুলি, লাঠিপেটা ও নিপীড়নের তাণ্ডব; তখনই কিছু সাহসী মানুষ ছিলেন আশার আলোকবর্তিকা। তাদেরই একজন মো. মাসুদ আলম, যিনি তখন পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘যদি তোমাদের অ্যাটাক করার জন্য কেউ আসে, তাহলে আমি আছি। আমার ওপর দিয়ে যাইতে হবে। আগে আমাকে মারতে হবে, তারপর যাইতে হবে।’
তার এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার উৎস। সেই সাহসী কথাগুলো আজও নতুন প্রজন্মকে সাহস দেয়, আশার বাতি জ্বালায়। বর্তমানে সেই কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি)।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ভয়াল জুলাই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেন তিনি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
আন্দোলনের সময়ে কী ধরনের নির্দেশনা ছিল? আপনি কীভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন?
ডিসি মাসুদ বলেন, ‘আমি তখন পাবনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সব নির্দেশ এসপি স্যারের মাধ্যমে আসত। রংপুরে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর পাবনাতেও আন্দোলন জোরদার হয়।’
‘পাবনায় আন্দোলন চলেছিল মূলত তিনটি স্থানে— পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মহাসড়কে, এডওয়ার্ড কলেজ গেট এলাকায় এবং জেবি মোড়ে। ১৬ জুলাই থেকে আমরা দেখেছি শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আন্দোলন করছেন। আমি নিজে শিক্ষার্থীদের বলেছি, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানান, আমরা পাশে থাকব। আমরা কোথাও অকারণে বলপ্রয়োগ করিনি।’
আন্দোলন শান্ত রাখতে আ. লীগ নেতাদের দিয়েছিলেন কড়া বার্তা
ডিসি মাসুদ বলেন, ‘আন্দোলনের সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার পরিকল্পনা ছিল। অথচ আন্দোলন দমন কিংবা তাতে হস্তক্ষেপের কোনো দায়িত্ব তাদের দেওয়া হয়নি। সেটি ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। তাই আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রতিদিন মেসেজ দিয়েছি— আন্দোলনের আশপাশে এলে কিন্তু খবর আছে। ঝামেলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেব, পেটাব; মামলা দেব।’
‘এই বার্তার কারণেই ৩ আগস্ট পর্যন্ত কেউ মাঠে নামেনি। ওই সময় পর্যন্ত আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। শিক্ষার্থীরাও আমাদের অনুরোধে দিনে ২-৩ ঘণ্টা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে চলে যেত। আমরা সবসময় চেয়েছি যেন কোনো শিক্ষার্থী প্রাণ না হারায়।’
৪ আগস্ট : বদলে যায় আন্দোলনের চিত্র
ডিসি মাসুদ বলেন, ‘৪ আগস্ট সকাল থেকেই হাজার-হাজার সশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী মাঠে নামে। আমাদের ধারণা, ৩ আগস্ট রাতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাদের কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে, ছাত্র-জনতা ছিল সম্পূর্ণ নিরস্ত্র এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছিল।’
‘আমরা তখন খুব বিপাকে পড়ে যাই। নির্দেশ ছিল বলপ্রয়োগ করা যাবে না। আমি নিজে ফোর্স নিয়ে দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম— যাতে সংঘর্ষ না হয়, কেউ যেন ছাত্রদের ওপর হামলা না করে।’
যখন গুলি চালাই, তখন আ. লীগ নেতাকর্মীদের ভুল ভাঙে
ডিসি মাসুদ জানান, ‘৪ আগস্ট পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা চলছিল। তবে, স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে। তিনি তার দলবল নিয়ে একটি গলি দিয়ে এসে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।’
‘ওই হামলায় ঘটনাস্থলে দুজন নিহত হন। অনেকে গুরুতর আহত হন। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই এবং তাদের রক্ষায় নির্দেশ দিই গুলি চালাতে। কারণ তারা মনে করেছিল, পুলিশ কিছু বলবে না। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙে যখন আমরা পাল্টা গুলি চালাই।’
‘নিরপরাধ মানুষের ওপর গুলি চললে আমি চুপ থাকতে পারি না। ৫ আগস্ট যদি পরিস্থিতি এমন না হতো, আমাকে হয়তো অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। তবুও আমি এসব চিন্তা করিনি’— বলেন ডিসি মাসুদ।
তিনি বলেন, ‘৩ আগস্ট থেকেই পুলিশের ভেতরে আলোচনা শুরু হয়— পাবনার আন্দোলন বুঝি আমি নিজেই করাচ্ছি। তবে, আমি এসব পাত্তা দিইনি। আমার কথা ছিল, যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়, কেউ আহত না হয়, তাহলে তো সেটাই আমাদের কৃতিত্ব।’
‘৪ আগস্ট ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় অনেকে আন্দোলনের মাঝে আটকা পড়ে। আমি নিজেই ঝুঁকি নিয়ে সেই শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করি। আমি রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করি’— যোগ করেন তিনি।
৫ আগস্ট পাবনায় পুলিশের ওপর কোনো হামলা হয়নি
ডিসি মাসুদ বলেন, ‘৫ আগস্ট দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় পাবনার চিত্র ছিল কিছুটা ভিন্ন। অন্য সব এলাকায় পুলিশের ওপর ক্ষোভ ছিল এবং পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা হয়েছিল। কিন্তু পাবনায় পুলিশের কোনো স্থাপনায় হামলা হয়নি। আর কেউ মিছিল নিয়ে ধ্বংসাত্মক কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করতে আসেনি। আমার কোনো অফিসার কিংবা ফোর্স একজনও হামলার শিকার হয়নি।’
বর্তমান দায়িত্বের চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে ঢাকার রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাসুদ আলম। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনসহ এই এলাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অফিস রয়েছে, যেখানে প্রায়শই বিভিন্ন আন্দোলন দেখা যায়। বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত ১৭ বছর হয়তো অনেকের যৌক্তিক দাবি ছিল, তখন তারা কথা বলতে পারেনি বা দাবি নিয়ে আসতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর তাদের হয়তো আকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। তাই অনেকে এখন বিভিন্ন দাবি নিয়ে আসছে।’
“তবে, এত বেশি দাবি নিয়ে মানুষ আসছে যে তারা নিজেও জানে না দাবি নিয়ে কোথায় যেতে হবে। এখন তাদের মনে হচ্ছে যমুনাতে যাওয়া দরকার, তখন তারা ঘোষণা দিচ্ছে ‘লং মার্চ টু যমুনা’। আবার তাদের মনে হলো দাবি নিয়ে সচিবালয়ে যাওয়া দরকার, তখন তারা ঘোষণা দিয়ে দেয় ‘লং মার্চ টু সচিবালয়’। আসলে তারা নিজেরাও জানে না কোথায় যেতে হবে।”
ঢাকা প্রেস ক্লাবের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘প্রেস ক্লাবের অবস্থা তো ভয়াবহ। ওইখানে এত শব্দ যে, আমার যে টিআই দায়িত্ব পালন করেন তিনি এখন কানে কম শোনেন। যাচ্ছে-তাই অবস্থা।’
আন্দোলনকারীদের প্রতি অনুরোধ ও পুলিশের সীমাবদ্ধতা
ডিসি মাসুদ বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব, তারা যেন তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আসেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আন্দোলন করেন। কোনোক্রমে যেন অযৌক্তিক দাবি এবং আইন অমান্য না করেন। কারণ, সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের পরিস্থিতি উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।’
‘অনেকে আসেন পরীক্ষায় ফেল করেছে, পাস দেওয়ার জন্য। পরীক্ষা দেবে না, সেজন্য আন্দোলন করতে। এসব দাবির আসলে কোনো যৌক্তিকতা নাই। রমনা বিভাগের পুলিশের এখন অধিকাংশ সময় পার হয়ে যায় এসব আন্দোলনে দায়িত্ব পালন করতে করতে।’
৫ আগস্ট পরবর্তী অভিজ্ঞতা এবং পুলিশের দায়িত্ব
৫ আগস্ট পরবর্তী অভিজ্ঞতায় মাঠপর্যায়ের পুলিশের কীভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত— এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি মাসুদ বলেন, ‘আমরা নমনীয়ভাবে এবং বল প্রয়োগ না করে দায়িত্ব পালন করতে চাই। বিশেষ করে আন্দোলনের বিষয়টি আমরা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে চাই। কিন্তু অনেক আন্দোলনে দেখা যায়, এত বেশি একঘেয়েমি থাকে এবং আইন অমান্য করার প্রবণতা এত বেশি থাকে, তখন আমাদেরকে অনেক সময় বাধ্য হয়ে বল প্রয়োগ করতে হয়। আন্দোলন দমাতে এখন আমরা গুলির ব্যবহার করি না।’
‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পুলিশের মনোবল দুর্বল করার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়। বাম দলসহ বিভিন্ন গ্রুপ কোনো কারণ ছাড়াই পুলিশকে যা ইচ্ছা গালি দেয়। অনেকে দাবি নিয়ে যমুনা কিংবা সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। তাদের তো আটকাতেই হয়। তারা যদি ভেতরে চলে যায়, তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে?’
‘আমাকে তো দায়িত্ব পালন করতেই হবে। এটি করতে গেলে আমাদের ওপর অনেকে চড়াও হয়। উল্টাপাল্টা কথা বলে। দেখা গেছে, ওই আন্দোলনকারীর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই নেই।’
পুলিশ সদস্যদের কাজের চাপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘একজন পুলিশ সদস্যকে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হয়। এটা কি আমরা কেউ দেখছি? তাদের ঠিকভাবে ঘুম হয় না, ঘুমের জায়গাও নাই। এসব বিষয় তো আমাদের বুঝতে হবে।’
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব শুধু নির্দেশ পালন নয়— মানবিকতা, ন্যায়বোধ এবং দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোও আমাদের কর্তব্য। সেই জায়গা থেকে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি।’
এমএসি/এমজে