সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই দুর্ঘটনা বিমানবাহিনীর ফাইটারের প্রযুক্তিগত দিক থেকেই নয়; বরং সামরিক প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা ও কৌশলগত প্রস্তুতির বিষয়েও আলোচনা-সমালোচনা শোনা যাচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে, দুর্ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, সম্ভাব্য কারণ, দুর্ঘটনার শেষ মুহূর্তে পাইলটের সঙ্গে ঊর্ধ্বতনের কথোপকথন জানতে কথা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সাবেক সহকারী প্রধান এবং সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ-বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) এম সানাউল হকের সঙ্গে। বিশেষ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের প্রধান প্রতিবেদক আদনান রহমান।

১. পাইলট ও কন্ট্রোল/কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে কি কথোপকথন হয়েছে?

উত্তর : জি, অবশ্যই কথা হয়েছে। আসলে যেকোনো বিমান ফ্লাইং করতে চাইলে একদম প্লেন স্টার্ট করা থেকে সুইচ অফ করা পর্যন্ত ফ্লাইংয়ের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার কন্ট্রোল টাওয়ার, র‍্যাডার কন্ট্রোল, এরিয়া কন্ট্রোল, ট্রেনিং কন্ট্রোল ইত্যাদি বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে পাইলট রেডিওতে কথা বলে, যাকে আমরা বলি ‘কল দেওয়া’। এজন্য কথা বলার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও টার্মিনোলজি আছে। বিমানবাহিনীর পাইলটরাও একই নিয়ম মেনে ফ্লাইং করেন। যখন কোনো বিমানে বিশেষ কোনো জরুরি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয় যাতে পাইলট বিমানটির বা নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন বোধ করে, তখন সে তার ঝুঁকির পরিস্থিতি অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট রেডিও কল দেয়। যেমন- আপনারা নিশ্চই ‘মে ডে’ (May Day) কলের কথা শুনেছেন।

২১ জুলাই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কবলিত বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির একইভাবে শুরু থেকেই বিভিন্ন কন্ট্রোলের সঙ্গে রেডিওতে নিয়মিত কথা বলে গেছেন। যেহেতু তিনি এই বিমানটিতে প্রথম একা (Solo) ফ্লাই করতে যাচ্ছিলেন, তাই বিমানবাহিনীর প্র্যাকটিস অনুযায়ী মিশনের শুরু থেকেই তার অফিসার কমান্ডিং রানওয়ের পাশে একটি নির্দিষ্ট স্থানে- যাকে আমরা বলি ‘মোবাইল হাট’(Mobile Hut)- সেখানে রেডিওসহ অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনিও টেক অফের আগেই তার সঙ্গে রেডিওতে নিয়ম অনুযায়ী স্বাভাবিক কথা বলেছে। আকাশে উড্ডয়নরত অবস্থায় অফিসার কমান্ডিং পাইলটের দেওয়া সব কল শুনেছেন। প্লেনটিকে টাওয়ারের কন্ট্রোলার এবং তিনি দুজনে মাটিতে থেকেও সার্বক্ষণিক দেখতে পেয়েছেন।

পাইলট কোথাও কোনো যান্ত্রিক গোলযোগ বা ইমার্জেন্সি পরিস্থিতির কল দেয়নি। কিন্তু তার মিশনের এক পর্যায়ে তিনি যখন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে-১৪ এর দিক থেকে (উত্তর থেকে দক্ষিণে) উড়ে আসছিলেন, তখন মাটি থেকে তার অফিসার কমান্ডিং লক্ষ্য করেন যে বিমানটি তার নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে কিছুটা যেন নিচে নেমে গেছে। তখন তিনি পাইলটকে উচ্চতা খেয়াল করার কথা মনে করিয়ে দিতে একটি কল দেন ‘চেক হাইট’। কিন্তু পাইলট এ কথার বিশেষ কোনো উত্তর বা কারণ বলেনি। কিন্তু তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অফিসার কমান্ডিং দেখতে পান যে বিমানটি অস্বাভাবিক দ্রুত আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। তিনি তখন পরপর আরো দুবার ‘চেক হাইট’ কল দেন। কিন্তু পাইলট একবারও কোনো উত্তর দেয়নি। এরপর তিনি যখন বুঝতে পারেন যে পাইলট বিপৎসীমার নিচে চলে যাচ্ছে এবং তাকে এখনি প্লেন থকে প্যারাশুট নিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে, তখন তিনি তাকে পরপর দুইবার ‘ইজেক্ট ইজেক্ট’ কল দেন। কিন্তু এ চরম মুহূর্তেও পাইলট কোনো উত্তর দেয়নি। নিশ্চই তখন তিনি মরিয়া হয়ে প্লেনটিকে কোনো উন্মুক্ত জায়গায় ক্র্যাশ করার জন্য শেষ চেষ্টা করছিলেন এবং খুবই শেষ মুহূর্তে যতক্ষণে তিনি ইজেক্ট করেন, তখন তার প্যারাশুট খোলেনি, যার ফলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

২. কথোপকথনগুলো বিশ্লেষণ করে প্রাথমিকভাবে ক্র্যাশের কোনো কারণ জানা যায় কি না?

উত্তর : যেহেতু পাইলট সরাসরি রেডিওতে তার কী ইমার্জেন্সি হয়েছিল তা বলে যায়নি, কাজেই যতটুকু রেডিও কল বা কথাবার্তার রেকর্ড এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের রেকর্ডে আছে, তা থেকে এ দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যায় না। যেমন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের সাম্প্রতিক বোয়িং-৭৮৭ এর ককপিটে দুই পাইলটের কথা থেকে দুটো ইঞ্জিনের ফুয়েল ‘শাট অফ সুইচ’ বন্ধ থাকার কথা জানা যায়।

কিন্তু প্লেনটি উড়ন্ত অবস্থায় তার অফিসার কমান্ডিং এবং এটিসি টাওয়ার যা যা দেখেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, তাতে করে আমরা যারা ফাইটার পাইলট, আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারি মাত্র। তবে এটা নিশ্চিত যে এমন একটা কিছু অত্যন্ত বিপজ্জনক ইমার্জেন্সি পরিস্থিতি হঠাৎ করেই ঘটেছিল, যাতে করে পাইলটের ক্র্যাশ করা ছাড়া আর কোনো অন্য উপায় ছিল না। ঠিক ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের মতোই। আমরা পাইলটরা বলি, এটা অনেকটা রেড লাইন ক্রস করে ফেলার মতো অবস্থা। সেখানে যে বিমান বা যে পাইলটই পড়ুক, তার বিমান কী ধরনের ছিল বা পাইলট কতটুকু অভিজ্ঞ ছিল বা ঠিকমতো অ্যাকশন নিয়েছে কিনা – এসবের কিছুতেই আর রক্ষা করা যায় না। 

সঠিক কারণ নির্ধারণের বিষয়ে যেহেতু একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি কাজ করছে, তাই আমাদের এ নিয়ে এখন মন্তব্য না করাই বাঞ্ছনীয়। 

৩. পাইলট প্লেনের কোনো ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি উল্লেখ করেছিল কি?

উত্তর : না, এ ব্যাপারে আগেই বলেছি।

৪. প্রশিক্ষণ ফ্লাইট জনবসতিপূর্ণ এলাকায় উড্ডয়ন নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এবিষয়ে আপনার মন্তব্য কি।

উত্তর : জি, এ ব্যাপারে নানা সমালোচনা হচ্ছে, ঠিক। দেখুন, এ বিষয়টি সম্পর্কে আমি চারটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

প্রথমত- বিমানবাহিনী কখনও কোনো প্রশিক্ষণ ফ্লাইট ঢাকা শহরের মতো জনবহুল এলাকায় পরিচালন করে না। প্রশিক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ এলাকা রয়েছে। সেখানেই সব ধরনের প্রশিক্ষণ ফ্লাইট ফ্লাইং করা হয়। কিন্তু একটা জেট প্লেনকে তো যেকোনো একটা রানওয়ে থেকেই টেক অফ ও ল্যান্ডিং করতে হবে, তাই না? সেটাই শুধু বিমানবন্দর এলাকায় করা হয়। সারা বাংলাদেশে এবং বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশেই এভাবেই সব ফ্লাইং ট্রেনিং করা হয়। তাছাড়া আরো একটি বিষয় আছে – প্রশিক্ষণ ফ্লাইট না করলেই কি দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে যাবে? ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের বোয়িংটি তো প্রশিক্ষণ ফ্লাইট ছিল না। আমাদের এখানে যেকোনো দিন এমন দুর্ঘটনা ঘটবে না, এটা আমরা কখনই নিশ্চিত বলতে পারি না। কাজেই আমি মনে করি প্রশিক্ষণ মূল বিষয় না।

দ্বিতীয়ত- এখন মনে করুন আমরা ঢাকা বা অন্যান্য শহর যেখান থেকে এদেশে ফ্লাইং করি, সেসব জনবহুল এলাকায় ফ্লাইং বন্ধ করে দিতে চাই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, কোথা থেকে ফ্লাইং করব? আমরা কি নতুন রানওয়ে বা বিমানবন্দর বানাব। সেটি করতে পারলে তো ভালোই হতো। আমি যতটুকু জানি, একটা নতুন বিমানবন্দর বানাতে প্রায় ১৫-২০ বিলিয়ন ডলার লাগবে, প্রায় ১২-১৪ বছর সময় লাগবে। কিন্তু দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার আলোকে আমাদের মতো একটি দেশের বাজেট বা উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখন এমন ব্যয়বহুল কাজ হাতে নেওয়া কি সম্ভব? তাহলে আমরা কি বিমানবাহিনীর ফ্লাইং ঢাকার বাইরে অন্য কোনো ঘাঁটিতে পাঠিয়ে দেব?

এখানেই আসে আমার তৃতীয় পয়েন্ট। 

তৃতীয়ত- স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনা এবং ডিফেন্স প্ল্যান। যেকোনো দেশের রাজধানী বা ‘সিট অব দ্য গভর্নমেন্ট’ দেশের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান। রাজধানী সুরক্ষিত রাখা যেকোনো দেশের ডিফেন্সিভ প্ল্যানের অংশ। একইভাবে, আকাশ আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য দেশের বিমানবাহিনীর ফাইটার প্লেনগুলোও স্ট্র্যাটেজিক অ্যাসেট এবং এদেরকে রাজধানীতে বা তার অতি-নিকটবর্তী কোনো স্থানে রাখা জরুরি। আবার যেহেতু আমাদের দেশের ভৌগোলিক আকার অনেক ছোট, শত্রু বিমান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমাদের ফাইটার প্লেনগুলো খুব কম সময়ই পাবে। সেই মূল্যবান সময়ের কিছু অংশ যদি প্লেন রাজধানীতে পৌঁছতেই লেগে যায়, তাহলে শত্রু বিমানকে রাজধানীতে আক্রমণের আগেই ধ্বংস করার মতো সময় আর থাকবে না। তাই বিশেষ করে বাংলাদেশে বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের কম্বেট ফাইটার প্লেনগুলোকে ঢাকায় রাখাটা অত্যাবশ্যক। 

চতুর্থত- এবং আমাদের দেশের জন্য বর্তমানে সবচাইতে জরুরি পয়েন্ট হলো জনবহুল এলাকায় বিমানবন্দর, না বিমানবন্দরের চারপাশে জনবহুল এলাকার সৃষ্টি। আমরা যদি বাংলাদেশে ফ্লাইংয়ের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আপনারা নিশ্চই জানেন যে, এদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সম্মিলিত বাহিনী মোট ১০৩টি রানওয়ে বা এয়ারস্ট্রিপ নির্মাণ করেছিল। এসব এলাকা ও রানওয়ে পাকিস্তান আমলে বিমানবাহিনীকে দেওয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এদের মাত্র অল্প কয়েকটি বেসামরিক ও কমার্শিয়াল ফ্লাইংয়ের জন্য ব্যবহার করেছে। যেমন- তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা ছিল জনবহুল তৎকালীন মূল ঢাকা শহরের বাইরে। যেমন- আজিমপুর গোরস্থান। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ঢাকার জনসংখ্যা এবং কলেবর বৃদ্ধি বিবেচনায় আবারো মূল ঢাকার বাইরে কুর্মিটোলায় অবস্থিত পুরোনো এয়ারস্ট্রিপ ও বিমানবাহিনীর এলাকায় নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়, যা অবশেষে ১৯৮০ সালে সম্পন্ন হয়। বিমানবাহিনী ঘাঁটি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি করার পর ১৯৮৫ সালে তেজগাঁও থেকে ফাইটার প্লেনগুলোকে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এই বিমানবন্দরের আশেপাশে উত্তরার এতসব স্থাপনাও ছিল না, নিকুঞ্জও ছিল না। কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল জনবহুল ছোট সাইজের বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা শহরের আশেপাশে তথা এই বিমানবন্দরের আশপাশ দ্রুত জনবহুল হয়ে ওঠে। 

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, একটি বিমানবন্দরের চারিদিকে কোথায় কতটুকু স্থানে আদৌ কোনো স্থাপনা তৈরি করা যাবে না, আর কোথায় কত উচ্চতার স্থাপনা করা যাবে – এ সবই আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট। এবং এজন্য বিমানবন্দরের আশেপাশে যেকোনো স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা রাজউক অনুমোদনের আগে সিভিল এভিয়েশন অথরিটির কাছ থেকে লিখিত ছাড়পত্র গ্রহণ আইনত বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে ঘুষ, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অবৈধ প্রভাব ইত্যাদির কারণে বাস্তবিকে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের আশেপাশে অসংখ্য অবৈধ, অননুমোদিত উঁচু স্থাপনা গড়ে উঠেছে, যা প্রতিটি টেক অফ ও ল্যান্ডিংয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আজ আমাদের জাতীয় জীবনে এই যে এত বড় প্রাণনাশী দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর পেছনে মূল কারণ এসব অবৈধ স্থাপনা। এসব আজ অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে। আমরা কেউই এ কারণে আর একটিও জীবন হারাতে চাই না। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। এখানে রাজনীতি বা স্বজনপ্রীতির কোনো অবকাশ নেই। এ দায়িত্ব সরকারের। আমি এ ব্যাপারে আশু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

৫. একই মডেলের ফাইটার বিমান আগেও তিনবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। দুইজন পাইলট নিহত হয়েছে, পতেঙ্গা সমুদ্রে একজন নিখোঁজ হয়েছে। ফাইটারটি নিরাপদ কি না?

উত্তর : না, এখানে অপতথ্য নিয়ে গুজবের সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কৌতুহল ও জানার আগ্রহকে পুঁজি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন খবর ভাইরাল হচ্ছে। অথচ সত্যি কথা হলো তিনটি বিষয়।

এক- বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এই এফটি/এফ-৭বিজিওয়ান (FT/F-7BG1) মডেলের বিমানে এটিই প্রথম দুর্ঘটনা। এর আগে যে কটি দুর্ঘটনার কথা বলা হচ্ছে তা ছিল পূর্ববর্তী মডেল এফ-৭এমবি এবং এফ-৭ বিজি মডেলের বিমানে। এখানে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে কোনো বিমানের প্রতিটি মডেল নানা গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উন্নয়নের পর আলাদাভাবে তৈরি করা হয়, কখনো কখনো আলাদা মিশনের জন্য তৈরি করা হয়। এসব আলাদাভাবে কেনা হয়, এদের টেকনোলজি এবং বিভিন্ন সিস্টেম ভিন্ন হওয়ায় প্রতিটি পাইলটকে আলাদা আলদাভাবে ট্রেনিং করে সেই বিমান চালাতে শিখতে হয়। তাই নামের মধ্যেও বিশেষ পার্থক্য থাকে।

দুই- আমরা ১৯৮৯ সালে প্রথম কিনি এফ-৭এমবি বিমান, তার উন্নত পরবর্তী মডেল এফ-৭ বিজি কিনি ২০০৬ সালে এবং সবশেষ এফ-৭বিজিওয়ান কিনি ২০১২-১৩ সালে। একটি বিমানে লাইফ স্প্যান বা জীবনকাল সাধারণত ৩০-৪০ বছরের কম হয় না। সে হিসাবে এই এফ-৭বিজিওয়ান বিমান এমনকি আমাদের মিগ-২৯ বিমানের চাইতেও অনেক নতুন। আসলে এটিই আমাদের বিমানবাহিনীর সর্বশেষ ক্রয়কৃত বিমান। 

তিন- প্রতিদিন সকালে যেকোনো ফ্লাইংয়ে যাওয়ার আগে একদল প্রশিক্ষিত বিমানসেনা টেকনিশিয়ান, তাদের উপর কয়েকজন জেসিও সুপারভাইজার, তার উপর একজন কোয়ালিফাইড ইঞ্জিনিয়ার অফিসার প্রতিটি বিমান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু চেক করে এবং লিখিতভাবে সার্টিফাই করে যে বিমানটি উড্ডয়নের জন্য ১০০ শতাংশ ফিট। সর্বোপরি, বৈমানিক এসে আবার নিজে সবকিছু চেক করে যদি দেখে সব ঠিক আছে তখনই শুধু বিমানটিকে মিশানের জন্য গ্রহন করে। তারপরও বিমানটি স্টার্ট করার থেকে শুরু করে টেক অফ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যদি পাইলট যেকোনো প্রকার ত্রুটি দেখতে পায়, কিংবা এমনকি অনুভব করে যে একটা কিছু শব্দ বা গন্ধ মনে হয় ঠিক নেই, তাহলেও সে টেক অফ না করে ফিরে আসে এবং লিখিতভাবে বিমানটিকে আবার চেক করতে পাঠায়। সেটি ঠিক না করা পর্যন্ত ওই প্লেন আর কোনো মিশনে যাবে না। এভাবে বিমানবাহিনীতে প্রতিদিন প্রতি ফ্লাইটের আগে প্রতিটি প্লেন এমন কঠিন পরীক্ষার পরই ফ্লাইয়ে যায়। কাজেই প্লেনটি একটা রিকন্ডিশন ফ্রেশ গাড়ির মতো প্রতিদিন ফ্লাইয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এখানে পুরাতন বা সমস্যাসহ কোনো প্লেনের কোনো ফ্লাই করার অবকাশ নেই। বরং আজ আমাদের সরকারের কাছে দাবি জানানো উচিত আরো আধুনিক প্রজন্মের ফাইটার প্লেন বিমানবাহিনীতে দ্রুত সংযোজনের জন্য।

কাজেই যেকোনো প্লেন পুরোনো বা নতুন যা-ই হোক না কেন একই পদ্ধতিতে তার রক্ষণাবেক্ষণ, সার্ভিসিং, চেকিং করে নিরাপদ উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত করা হয়। প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে এক্সিডেন্ট ঘটে কেন। কারণ, আফটারঅল, যত নতুন বা আধুনিকই হোক একটা প্লেন মানে একটা অতি জটিল মেশিন। যেকোনো মেশিন যেকোনো সময় ফেইল করতেই পারে। এটা মেনে নিয়েই এভিয়েশন প্রফেশন সিভিল মিলিটারি সব। 

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে বিমান দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে, অনেক বৈমানিকও শহীদ হয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং আমাদের চৌকস বৈমানিকদের বীরত্বপূর্ণ দক্ষতায় এখন পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের কারণে মাটিতে কেউ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কারণ এ বিষয়টিকে শুরু থেকেই আমাদের বৈমানিকদের বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল বাংলাদেশে এটি আমাদের বৈমানিকদের দক্ষতা এবং আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় পাইলটসহ অনেক তাজাপ্রাণ ইতোমধ্যেই ঝরে গেছে, অনেক মায়ের কোল চিরতরে খালি হয়ে গেছে। শুধু বিমান বা স্কুল নয়, ধ্বংস হয়ে গেছে কত আগামীর স্বপ্ন। এ ক্ষতি অপূরণীয়, এ কষ্ট সমগ্র জাতিকে কান্নায় ভাসাচ্ছে প্রতিদিন। আরো অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। আমি সব বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শহীদী মর্যাদার জন্য আল্লাহ দরবারে আকুল দোয়া জানাচ্ছি। যারা চিকিৎসাধীন তাদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। 

পরিশেষে সবার কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, দয়া করে গুজবে কান দেবেন না, গুজব ছড়াবেন না। আপনার যেকোনো কিছু জানার থাকলে বিমানবাহিনীতে যোগাযোগ করুন। আমি নিশ্চিত, জাতির এ দুঃখজনক ক্রান্তিলগ্নে অবশ্যই বিমানবাহিনী আপনাকে সহায়তে করবে। দেশের সুশীল সমাজ এবং মিডিয়াকে নিজ সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ থেকে জনগণের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরার আহ্বান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের ধৈর্য ধারণ করার ক্ষমতা দান করুন।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ জনে। এ দুর্ঘটনায় রাজধানীর সাতটি হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন রয়েছে প্রায় অর্ধশত। নিহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ১৭ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১৫ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে একজন, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে একজন (অজ্ঞাতনামা) এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন মারা গেছেন।

এআর/জেডএস