বিমান দুর্ঘটনা ঘিরে যা হলো
গুজবের ঝড়, ‘লাশ গুমের’ গল্প, সরকারের নীরব ভূমিকা!
রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বহু গুজব ও বিভ্রান্তি, যা দেশের মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, সন্দেহ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ‘লাশ গুম’ থেকে শুরু করে মৃত্যুর সংখ্যা গোপনের মতো মনগড়া দাবি দ্রুত ভাইরাল হয় ফেসবুকে এবং সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে উত্তেজিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। গুজব ঠেকাতে সরকারি পদক্ষেপের কার্যকারিতা নিয়ে ওঠে নানা প্রশ্ন।
দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়ায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে শত শত পোস্টে ইচ্ছেমতো সংখ্যা উল্লেখ করা হয়- কেউ লেখেন ২০০, কেউ লেখেন ১৫০ জনের বেশি মারা গেছেন (এখন পর্যন্ত ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছে)। এর সঙ্গে ‘লাশ গুম’ ও ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের’ মতো মনগড়া দাবিও শেয়ার করা হয় ব্যাপক হারে।
বিজ্ঞাপন
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দুর্ঘটনার প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ফেসবুকে অন্তত এক ডজনের বেশি ‘সংবেদনশীল’ পোস্ট ভাইরাল হয়। এসব পোস্টে এআই-নির্মিত ফেইক ছবি, পাইলটের মৃতদেহ ও শেষ কথোপকথন, শিক্ষার্থীদের মারধরের খবর এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ সত্য গোপন করছে- এমন গুজব ছড়ানো হয়। অথচ তখন সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
৪০ থেকে ২০০ জন পর্যন্ত নিহতের গুজব
২১ জুলাই দুর্ঘটনার দিন দেওয়ান জাহিদ নামের এক ব্যক্তি নিজের ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, তার সামনেই ৪০টিরও বেশি মৃতদেহ বের করা হয়েছে।
তিনি লেখেন, একটা সেকশনে প্রায় ৩০/৪০ জন শিক্ষার্থী থাকে, যেটা আমরা নিজেরাই পড়ার সময় খুব ভালোভাবে দেখেছি। যেখানে ২টা সেকশনের কেউ বের হতে পারেনি। আর আপনারা বলছেন নিহত মাত্র ২০ জন! আমার সামনেই তো ৪০+ মৃতদেহ বের করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাটেনডেন্স লিস্ট আছে, সুতরাং নিহতের সংখ্যা নিয়ে কোনো লুকোচুরি হলে আগামীকাল সরকারের জন্য সুবিধার হবে না।
২২ জুলাই রুবেল আহমেদ নামে একজন একটি ফেসবুক গ্রুপে লেখেন, মাইলস্টোন কলেজে আমার প্রাক্তন সহকর্মী কয়েকজন শিক্ষক আছেন। আজ কলেজে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে শুনলাম- প্রায় ২০০ ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, স্টাফ এবং অভিভাবক নিহত হয়েছেন। আর সরকার দেখাচ্ছে মাত্র ২৭ জন! লাশ নিয়ে কেন এই লুকোচুরি? উপদেষ্টাদের আটকে রাখছে ছাত্ররা, আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সময় থাকতে শুধরে নাও, না হলে দাবালনের মতো ছড়িয়ে পড়বে।
ওইদিনই শাহাদাত হোসেন নামে এক ব্যক্তি পোস্ট করেন, মাইলস্টোনে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করা হচ্ছে! গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে লাশ গুম করার অভিযোগও তুলেছেন এলাকাবাসী।
সাইয়েদ আহমেদ লাবিব নামে আরেক ব্যক্তি লেখেন, লাশ গুম করা হচ্ছে মাইলস্টোনে। সবাই সেদিকে ফোকাস দিন।
এসব পোস্ট যাচাই করে দেখা যায়, এগুলোর কোনো তথ্যই সরকারি বা দায়িত্বশীল কোনো বেসরকারি সূত্র নিশ্চিত করেনি। অথচ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পোস্টগুলো শেয়ার, কমেন্ট ও স্ক্রিনশট হয়ে লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়, যা গুজবকে আরও উসকে দেয়।
সাংবাদিকদের প্রতি বিরূপ আচরণ
ঘটনার পরদিন মাইলস্টোন কলেজ ক্যাম্পাসে গেলে সাংবাদিকদের বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অন্তত দুদফায় তাদের কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। একপর্যায়ে কিছু ‘আন্দোলনরত’ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকের পরিচয়ে আসা লোকজন মব করে সাংবাদিকদের ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে অনেক গণমাধ্যমকর্মী তড়িঘড়ি করে কলেজ ত্যাগ করেন।
দুর্ঘটনার পরদিন গত ২২ জুলাই দেখা যায়, কলেজের ৫ নম্বর ভবনের সামনে ভিড় করা উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন- ‘লাশের প্রকৃত সংখ্যা গোপন করা হয়েছে, অনেক লাশ গুম করা হয়েছে। টিভি চ্যানেলগুলো সত্য প্রকাশ করছে না।’
এই অবস্থায় উপস্থিত সাংবাদিকরা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন- যদি কেউ প্রমাণ দেখাতে পারেন, তা যাচাই করে প্রকাশ করা হবে। তবে দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি এই দাবি নিশ্চিত না করলে, মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা সম্ভব নয়।
দুপুরের পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কারও কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও অনেকেই বারবার দাবি করতে থাকেন- ‘লাশ গুম করা হয়েছে।’ এ সময় সাংবাদিকদের দিকে আঙুল তোলা হয়, এমনকি হুমকিসূচক আচরণও দেখা যায়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে অন্তত পাঁচটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক নিরাপত্তার স্বার্থে ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
দুর্ঘটনার গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম আলোচিত ছিল ‘অ্যানোনিমাস’ নামের একটি ফেসবুক পেজের পোস্ট। দুর্ঘটনার পরপরই ওই পেজ দাবি করে, তারা নাকি একদিন আগেই এ ঘটনা ঘটবে বলে জানিয়েছিল
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বলেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে বুঝতে পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ। কিছু শিক্ষার্থী, কিছু অভিভাবক এবং কিছু অচেনা মুখ সাংবাদিকদের ঘিরে ধরে চিৎকার করে বলতে থাকেন- ‘আপনারা সরকারের দালালি করছেন, লাশ গুমের খবর চেপে যাচ্ছেন, সত্য বলেন না।’ আমরা ঠাণ্ডা মাথায় বলি, প্রমাণ দিলে আমরা নিউজ করব, কিন্তু দায়িত্বশীল সূত্র ছাড়া মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা সাংবাদিকতার নীতিমালার বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, আমাদের বোঝানোর পরও তারা শোনেনি, বরং উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। অনেকেই তখন ছবি বা ভিডিও তুলতেও সাহস পাননি। গুজব ছড়ানো হচ্ছিল, সেসব চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা হচ্ছিল, ফলে সত্য তুলে ধরা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
‘অ্যানোনিমাস’ পেজের পোস্ট নিয়ে বিভ্রান্তি
দুর্ঘটনার গুজব ছড়ানোর ক্ষেত্রে অন্যতম আলোচিত ছিল ‘অ্যানোনিমাস’ নামের একটি ফেসবুক পেজের পোস্ট। দুর্ঘটনার পরপরই ওই পেজ দাবি করে, তারা নাকি একদিন আগেই এ ঘটনা ঘটবে বলে জানিয়েছিল।
তাদের পোস্টে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ‘একটি স্কুল বা কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হবে’। এই দাবি ভাইরাল হলে অনেকে ধরে নেন, ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বা আগে থেকেই কারও জানা ছিল।
তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র। তাদের মতে, ‘অ্যানোনিমাস’ পেজের পোস্টটি আসলে আগের কোনো লেখা সম্পাদনা (এডিট) করে নতুনভাবে প্রকাশ করা হয়, যাতে মনে হয় এটি দুর্ঘটনার আগে আগে দেওয়া হয়েছিল। ফেসবুক পোস্টের মেটাডেটা পরীক্ষা করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, পোস্টটি প্রথম কবে দেওয়া হয়েছে এবং পরে কতবার সম্পাদনা হয়েছে। এই কৌশল ব্যবহার করে প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে প্রযুক্তিবিদ তানভীর জোহা ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরনের পোস্টের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এগুলো শুধু সামাজিক মাধ্যমে হৈচৈ তোলার এবং মনোযোগ আকর্ষণের জন্য করা হয়।
প্রথমদিকে দেখা গেছে, পেজটি দেশের বাইরে থেকে ভিপিএন ব্যবহার করে সক্রিয় ছিল। কর্তৃপক্ষ ট্র্যাক করা শুরু করার আধা ঘণ্টার মধ্যেই তারা পেজের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
প্রযুক্তিবিদ তানভীর জোহা বলেন, এ ধরনের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাওয়া যেত। অতীতে অনুরূপ পরিস্থিতিতে ফেসবুক বাংলাদেশকে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। কিন্তু মাইলস্টোন দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তা হলে গুজবের উৎস দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হতো।
তিনি জানান, মাইলস্টোন কলেজের সাম্প্রতিক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিশেষত ফেসবুকে ব্যাপক গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ‘লাশ গুম’ হওয়ার অভিযোগও ছিল। শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি। কলেজের সামনে কেউ এসে তাদের সন্তান নিখোঁজ বা লাশ হারানোর অভিযোগ করেনি, কিংবা কোনো পোস্টার বা প্রকাশ্য দাবিও দেখা যায়নি। পরে স্পষ্ট হয়, এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন গুজব, যা সামাজিক উত্তেজনা তৈরির জন্য ছড়ানো হয়েছিল।
জোহা বলেন, বর্তমানে ‘সাইবার নিরাপত্তা অধ্যাদেশ’ কার্যকর আছে, কিন্তু সংসদ ভেঙে যাওয়ায় এটি এখনও আইন আকারে পাস হয়নি। ফলে অধ্যাদেশের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।
এ প্রযুক্তিবিদ জানান, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, গাইবান্ধার বুলবুল নামে এক ব্যক্তি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর দায়ে আদালতে সাজা পেয়েছেন।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ ধরনের কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে ভবিষ্যতে অনেকে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সাহস পাবে না।
গুজব দমনে সরকারের নীরবতা, প্রশ্নেরও উত্তর নেই
মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় গুজব ছড়িয়ে পড়া এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়ে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে গত ৩০ জুলাই জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের মাধ্যমে ডাক ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের কাছে সুনির্দিষ্ট ৪টি প্রশ্ন পাঠানো হয়।
প্রশ্নগুলো ছিল- দুর্ঘটনার পরপর ফেসবুকে যেসব বিভ্রান্তিকর তথ্য, ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হতে থাকে সেগুলোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য ছড়িয়ে ‘গুজব’ দমনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি না? গুজব ঠেকাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা অধিদপ্তর, বিটিআরসি বা সাইবার মনিটরিং টিম কী ভূমিকা পালন করেছে? কোনো প্ল্যাটফর্মকে কন্টেন্ট সরাতে বলা হয়েছিল কি না? সরকারের নজরদারি ব্যবস্থায় কী ধরনের ঘাটতি ছিল?
দীর্ঘ ৯ দিন কয়েক দফা যোগাযোগের পরও এ বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে কি না জানতে চাইলে গত ৯ আগস্ট চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী জানান, এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচালনা করে। তারা প্রয়োজন মনে করলে কোনো পোস্ট বা তথ্য সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরাতে বিটিআরসিকে অনুরোধ করে এবং বিটিআরসি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।
তিনি বলেন, আমরা নানা ধরনের অনুরোধ পাই। যেগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
আরএইচটি/এমএসএ/জেএস