ঢাকা ১০ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. হেফজুল বারি মোহাম্মদ ইকবাল (এইচ বি এম ইকবাল) কাগজে-কলমে ৫ আগস্টের পর থেকে পরিবারসহ পলাতক। জনশ্রুতি রয়েছে, তারা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে দেশে না থাকলেও ইকবাল ও তার সহযোগীদের আর্থিক দুর্নীতি কিংবা অপকর্ম চলমান রয়েছে।

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী ও গুলশান শাখায় নতুন হিসাব খুলে ইকবাল ও তার পরিবারের মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৬৪টি পে-অর্ডার ইস্যু করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক ও ব্যাংকের বাইরের কিছু ব্যক্তির সহযোগিতায় দুই, আড়াই ও ৪ লাখ থেকে শুরু করে ৮০ লাখ টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করে মোট ২৮৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা অন্যত্র স্থানান্তর এবং বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর থেকে ১১ অক্টোবরের বিভিন্ন সময়ে ওই টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। এ ছাড়া ২০২৪ সালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়, গুলশান শাখা, গোডাউন ও প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গুলশান শাখার অফিস ভাড়া, ব্যবহার অনুপযোগী স্থান ভাড়া ও তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে মোটিভেশনাল বোনাসসহ ১৪৭ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। 

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে এসব অপকর্মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে সুপারিশও করা হয়েছে।

২৮৮.৪৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ছক

বিএফআইইউ ও দুদকের বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসির সাবেক চেয়ারম্যান এইচ. বি. এম ইকবাল বিদেশে পালিয়ে থাকা অবস্থায় তার স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বেশ কিছু নতুন হিসাব খুলে লেনদেন পরিচালনা করেছেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নতুনভাবে খোলা হিসাবের তথ্য জানার পর এ বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়।

সার্বিক নথিপত্র পর্যালোচনা বলছে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তার সহযোগিতায় ইকবাল হোসেন ও তার পরিবারের বিভিন্ন হিসাব ব্যবহার করে তাদের মালিকানাধীন বিভিন্ন সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ব্যাংকটির বনানী শাখা এবং গুলশান শাখা থেকে ৩৬৪টি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়েছে। যার মূল্যমান ২৮৮ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার ৩৫৭ টাকা। আর ওই অর্থ ইকবালের সহযোগীরা অন্যত্র স্থানান্তর এবং বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করেছেন। এমন প্রেক্ষাপটে ইকবাল এবং তার পরিবারের সদস্যদের স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের নামে যেসব পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়েছে সেগুলো মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২৩(১) (গ) ধারার আওতায় স্থগিত রাখার জন্য গত ২১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকটিকে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

গত ১২ অক্টোবর ৬৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এইচ বি এম ইকবাল এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুদক। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় তার স্ত্রী ও অপর এক সন্তানের নামে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করা হয়।

একাধিক সূত্রে আরও জানা যায়, প্রিমিয়ার ব্যাংকে এইচ বি এম ইকবাল-সংশ্লিষ্টদের নামে প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে হিসাব খুলে লেনদেন শুরু করা হয়। যদিও হিসাবগুলো ২০২৪ সালের ১১ অক্টোবর ১ম দফায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এরপর ৩০ দিন করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ২১০ দিন স্থগিত রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০২৫ সালের ২৯ মে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত থেকে অপর এক আদেশে লেনদেন অবরুদ্ধ করা হয়। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে আদালত থেকে ওই নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, এইচ বি এম ইকবাল সংশ্লিষ্টদের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেটিভ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামেই ১৮১টি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। যা ব্যবহার করে ২২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের ছক করা হয়। অন্যদিকে প্রিমিয়ার হোটেল এন্ড রিসোর্ট লিমিটেড নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩২টি পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। যার মাধ্যমে ৮০ লাখ টাকা করে মোট ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়। একইভাবে ইকবাল সেন্টারের নামে ৩৯টি পে-অর্ডারে ৩১ কোটি ২০ লাখ টাকা, বুকশারা রেস্টুরেন্ট লিমিটেডের নামে ৬ পে-অর্ডারে ২১ লাখ ৪১ হাজার টাকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মোট ৩৬৪ পে-অর্ডার ইস্যু করে মোট ২৮৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

এ বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবু জাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ব্যাংকটির অন্য একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, বনানী ও গুলশান শাখায় এরূপ ঘটনায় ওই পে-অর্ডার আটকে দেওয়া হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় টাকা ছাড় করা হয়নি।

এইচ বিএম ইকবাল প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পা লন করে আসছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন।

অন্যদিকে দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে যদি কোনো সুপারিশ দুদকে পাঠানো হয় এবং তা যদি দুদকের তফসিলভুক্ত হয় তাহলে কমিশন নিশ্চয়ই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে। তবে আপনার জানতে চাওয়া বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত নই।

ইকবাল সিন্ডিকেটের বিষয়ে অপর একটি অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এইচ বি এম ইকবাল, তার পরিবারবর্গ ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়, গুলশান শাখা, গোডাউন ও প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গুলশান শাখার অফিস ভাড়া বাবদ মোট ৭৬.৬৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। যার প্রমাণও মিলেছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একইভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদনে। এ ছাড়া প্রিমিয়ার ব্যাংক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যবহার অনুপযোগী দেখিয়ে স্থান ভাড়া ও তিনজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে মোটিভেশনাল বোনাস প্রদান বাবদ মোট ৭০.৪৫ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।

৬৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ, দুদকের মামলা

গত ১২ অক্টোবর ৬৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এইচ বি এম ইকবাল এবং তার ছেলের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে দুদক। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পাওয়ায় তার স্ত্রী ও অপর এক সন্তানের নামে সম্পদ বিবরণী নোটিশ জারি করা হয়।

প্রথম মামলায় সাবেক এমপি ডা. ইকবালের নামে ৬২ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৮২ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, দুদকের অনুসন্ধানে সাবেক এমপি ইকবালের নামে ২৯৮ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ১৫৯ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এর বিপরীতে তার দায় ১৩৯ কোটি ৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫৯৪ টাকা। ফলে নিট সম্পদের পরিমাণ ১৫৯ কোটি ৬৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫৬৫ টাকা। অন্যদিকে বিভিন্ন খাতে তার আয় দেখা যায় ১৯০ কোটি ৬৫ লাখ ২৫ হাজার ৫৬২ টাকা, ব্যয় ৯৩ কোটি ২৩ লাখ ৭৫ হাজার ৭৭৯ টাকা। ফলে নীট আয় হয় ৯৭ কোটি ৪১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮৩ টাকা। এই হিসেবে তিনি জ্ঞাত আয় বহির্ভূত ৬২ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৮২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন। এ অপরাধে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা অনুযায়ী মামলা রুজু করে দুদক।

অন্যদিকে ডা. ইকবালের পুত্র ইমরান ইকবালের নামে ৪৫ কোটি ৭৩ লাখ ১০ হাজার ৩৯৭ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। তার নিট আয় ৪০ কোটি ৭০ লাখ ৯৬০ টাকা। ফলে তিনি ৫ কোটি ৩ লাখ ৯ হাজার ৪৩৭ টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক বলে দুদক মনে করছে। তার বিরুদ্ধেও দুদক আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা অনুযায়ী আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এইচ বি এম ইকবাল, তার পরিবারবর্গ ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়, গুলশান শাখা, গোডাউন ও প্রিমিয়ার ব্যাংক সিকিউরিটিজ লিমিটেডের গুলশান শাখার অফিস ভাড়া বাবদ মোট ৭৬.৬৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

একই দিন ডা. ইকবালের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পী ও অপর সন্তান মঈন ইকবালের নামে সম্পদ বিবরণী নোটিশ ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে স্ত্রী শিল্পীর নামে ১০ কোটি ৮২ লাখ ২২ হাজার ৮৬৬ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। যাচাইয়ে দেখা যায়, তিনি ৩৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৮ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ ভোগ দখলে রেখেছেন।

অপরদিকে ডা. ইকবালের অন্য পুত্র মঈন ইকবালের নামে ৪৭ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৮৭ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। তার নিট আয় ৪৭ কোটি ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৪৫ টাকা, ফলে তিনি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ৪৪২ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ ভোগ দখলে রেখেছেন। তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন অনুযায়ী ২৬(১) ধারায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ ইস্যু করে দুদক।

এইচ বি এম ইকবাল প্রিমিয়ার ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দেন। গত বছরের নভেম্বরে এইচবিএম ইকবাল, তার দুই স্ত্রী ও সন্তান এবং তাদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করে বিএফআইইউ। এরপরও এইচ বি এম ইকবাল তার নামে থাকা ব্যাংক হিসাব থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা ও ৩০ হাজার মার্কিন ডলার উত্তোলন করেন। বিষয়টি বিএফআইইউর নজরে আসার পর ব্যাংকটির কাছে জানতে চেয়ে কোনো সদুত্তর না পেয়ে জরিমানা করা হয়।

আরএম/এনএফ