যশোর-৬ (কেশবপুর) আসন থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মনোনয়ন পেয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। তিনি বর্তমানে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য।

উল্লেখ্য, শ্রাবণের পারিবারিক পটভূমি আওয়ামী লীগ-কেন্দ্রিক; তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন এবং ভাইয়েরাও উপজেলা পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এমন একটি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আদর্শিক রাজনীতির পথে হাঁটা এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ দলীয় মনোনয়ন অর্জন করা— শ্রাবণের রাজনৈতিক জীবনের এক ব্যতিক্রমী দিক।

‘রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আদর্শিক সম্পর্ক মজবুত’— এই স্লোগানে বিশ্বাসী এই তরুণ নেতা ভোটের মাঠে ভোটারদের মনোভাব, নির্বাচনী পরিবেশ এবং কেশবপুরের প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের যশোর জেলা প্রতিনিধি রেজওয়ান বাপ্পীর সঙ্গে।

ঢাকা পোস্ট : বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থাকায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন ধানের শীষের মনোনয়ন। আপনার প্রতি স্থানীয় ভোটারদের মনোভাব কেমন দেখছেন?

কাজী রওনকুল ইসলাম : আলহামদুলিল্লাহ। ভোটারদের মনোভাব শতভাগ আমার দিকেই মনে হচ্ছে, ধানের শীষের প্রতীকের দিকেই মনে হচ্ছে। আপনারা জানেন, দীর্ঘদিন পর আমি কেশবপুরে পদার্পণ করি। সেদিন এই কেশবপুরবাসীর মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখেছি, এই উচ্ছ্বাস আরও দ্বিগুণে রূপান্তর হয়েছে যেদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে আমাকে মনোনীত করেছে। কেশবপুরবাসী ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।

ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিন এলাকায় অনুপস্থিত ছিলেন। আপনার দৃষ্টিতে এলাকার নির্বাচনী পরিবেশ কেমন?

কাজী রওনকুল ইসলাম : এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ এবং ভালো আছে বলে আমি মনে করি। পরবর্তীতে পরিবেশ কেমন হয়— সেটা সময়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। 

ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনে দলীয় প্রতীক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরে প্রার্থীর নিজস্ব গুণাবলীর দিকে নজর দেন ভোটাররা। কী কারণে তারা আপনাকে মূল্যায়ন করবেন বলে মনে করেন?

কাজী রওনকুল ইসলাম : বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে প্রতীক বড় একটা ফ্যাক্টর। প্রতীকের পাশাপাশি নেতাকর্মী এবং নির্বাচনী এলাকার জনগণ বিবেচনা করেন, যে প্রতীক থেকে প্রার্থী হয়েছেন তার নিজস্ব যোগ্যতা, তার আচার-ব্যবহার, তার কর্মদক্ষতা, তাকে ভোট দিলে ভবিষ্যতে কেমন করবেন..., ভোট তো একজন নেতার কাছে ভোটারের আমানত, স্বাভাবিকভাবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেশার দক্ষতা ও ক্ষমতা, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলার আকাঙ্ক্ষা— এগুলো আছে কি না, তারা দেখেন। আমি বিশ্বাস করি, কেশবপুরের জনগণ এবং কেশবপুরের প্রতিটি ভোটার আমার প্রতি ইতোমধ্যে ‘পজিটিভ রেসপন্স’ (ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া) দেখিয়েছেন। তারা আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।

আমি আশা করি, আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই কেশবপুরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আমাকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করবেন।

ঢাকা পোস্ট : আপনি যেহেতু বিএনপির মনোনীত প্রার্থী, এখানে অন্যান্য দলেরও প্রার্থী আছেন। প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

কাজী রওনকুল ইসলাম : যার যার দলের আদর্শিক চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিকোণ আলাদা। আমি আমার নিজ দলের, ধানের শীষ প্রতীকের, জাতীয়তাবাদী আদর্শের রাজনীতি করি। সেই আদর্শ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমি নিজ এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। কেশবপুরের সর্বসাধারণ, সব ভোটারের মন জয় করার চেষ্টায় আছি। তাদেরকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমার মতো অন্যান্য দলের প্রার্থীরাও চেষ্টা করবেন তাদের প্রতীকে ভোট যেন আসে। তবে, কেশবপুরের মানুষ ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে আছেন। 

ঢাকা পোস্ট : যশোরবাসী তথা নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য আপনার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি আছে কি?

কাজী রওনকুল ইসলাম : আমি যশোরে আসার পর থেকে কেশবপুরের প্রতিটি ইউনিয়ন, প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় গিয়েছি। কেশবপুরের প্রধান সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। আপনি দেখবেন, এখানকার মানুষের কৃষিকাজের পরিবর্তে ঘেরের (মাছের ঘের) প্রতি ঝোঁক বেশি। কারণ জলাবদ্ধতা, সারা বছর পানি আটকে থাকে। আমার ইচ্ছা, কেশবপুরের জলাবদ্ধতাকে স্থায়ী একটা সমাধানে রূপ দেওয়া। শুধু কেশবপুর নয়, এই জলাবদ্ধতা অন্যান্য উপজেলায় ছড়িয়ে গেছে। এজন্য এই সমস্যাকে স্থায়ী একটা সমাধানে রূপ দেওয়া জরুরি। নির্বাচিত হলে সেই লক্ষ্যেই আমি কাজ করে যাব। 

এছাড়া, কেশবপুরে আগে মাদকের বিস্তার ছিল না, এখন তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। যেহেতু এটা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা। আমার ইচ্ছা আছে, আমাদের যে তরুণ সমাজ, সেই তরুণ সমাজকে মাদক থেকে সরিয়ে কীভাবে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই চেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি কীভাবে তাদেরকে সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাব। ইনশাআল্লাহ আমি সেটা পারবে।

ঢাকা পোস্ট : একজন তরুণ ও উদীয়মান নেতা হিসেবে, তরুণদের নিয়ে আপনার বিশেষ কোনো কর্মপরিকল্পনা আছে কি না?

কাজী রওনকুল ইসলাম : একজন তরুণ প্রতিনিধি হিসেবে তরুণ সমাজকে নিয়ে আমার সুনির্দিষ্ট ভাবনা রয়েছে। বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণদের ভবিষ্যতের ওপর আলোকপাত করে প্রণীত হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে তরুণরাই হবে সবচেয়ে বড় একক ভোটার। আমি যেহেতু এই প্রজন্মের প্রতিনিধি, তাই আমি তাদের মনস্তত্ত্ব ও ভাবনা জানতে সচেষ্ট হয়েছি। আমি প্রতিনিয়ত তরুণদের সঙ্গে মিশছি, বিভিন্ন স্থানে তাদের সঙ্গে কথা বলছি এবং তাদের চিন্তা-চেতনা ধারণ করার চেষ্টা করছি। এই ভাবনাগুলো আমার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশিত হবে এবং কেশবপুর পরিচালনার ক্ষেত্রে তা প্রধান দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।

ঢাকা পোস্ট : অতীতের নির্বাচনগুলোতে অন্য দলের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ ছিল। এবার অন্য দলের সাধারণ ভোটাররা নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না?

কাজী রওনকুল ইসলাম : একটি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব মূলত সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। প্রার্থী হিসেবে আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে সাধারণ ভোটারদের সম্পূর্ণরূপে আশ্বস্ত করা। তারা যেন নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে, তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং পছন্দের প্রতীকে ভোট দিতে পারে— এই পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্বের অংশ। পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো কেমন হয়েছে, তা মুখ্য বিষয় নয়; আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

আমরা এই নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ভোটের মাঠে ফিরতে পারেননি এবং তারা ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো, যারা দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্ট শাসনের অধীনে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেননি, সেই সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। ইনশাআল্লাহ, এবার ভোটের পরিবেশ ভালো থাকবে এবং ভোটাররা উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেবে।

ঢাকা পোস্ট : ঢাকা পোস্টের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরিবার ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।

কাজী রওনকুল ইসলাম : আমি আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং সেই আদর্শিক চর্চার ফলস্বরূপই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলাম এবং বর্তমানে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার আদর্শের প্রতি অবিচল থাকা, ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের কারণে আমি বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছি, জেল খেটেছি এবং সাজা ভোগ করেছি। রাজনীতি ও জিয়া পরিবারের প্রতি আমার অবিচল প্রতিশ্রুতির কারণেই দল আমাকে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আদর্শিক বন্ধন আরও বেশি সুদৃঢ় ও মজবুত হয়। আমার নেতাকর্মীরাও এই আদর্শে বিশ্বাসী এবং কেশবপুরবাসী সকলেই আমাকে ভোট দেওয়ার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

কাজী রওনকুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।

একনজরে কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ

২০০৩ সালে কেশবপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন শ্রাবণ। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজি মুহম্মদ মুহসীন হলে। কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে হল ও বিভাগের সহপাঠীদের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে সান্ধ্য কোর্সে (স্নাতকোত্তর) অধ্যয়নরত অবস্থায় ২০২২ সালে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি হন শ্রাবণ। পরে ‘অসুস্থতার’ কারণ দেখিয়ে ২০২৩ সালের আগস্টে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্য এর দুই মাসের মাথায় তাকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়।

শ্রাবণের বাবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম কেশবপুর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। শ্রাবণের বড় ভাই মুস্তাফিজুল ইসলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। আরেক ভাই মোজাহিদুল ইসলাম উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক। আর ছোট ভাই আজাহারুল ইসলাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক।

আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান হয়েও রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত হওয়ায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেননি তিনি। মনোযোগ দেন বিএনপির রাজনীতিতে, সেখানে দৃঢ়তারও প্রমাণ দেন।

আরএআর