পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) দাফতরিক কাঠামোগত সমস্যায় ধুঁকছে দীর্ঘদিন ধরে। সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর একাধিক লিখিত ও মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। বরং এ বিভাগের সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।

ভুক্তভোগী আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, একের পর এক সচিব আসছেন। দায়িত্ব পালন করে তারা চলেও যাচ্ছেন। কিন্তু কেউই বিভাগের সক্ষমতা বাড়ানোসহ সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেননি। অথচ গত কয়েক বছর ধরে সরকারের বড় অঙ্কের এডিপি বাস্তবায়ন দেখভালের পুরো দায়িত্বই এ বিভাগের ওপর ন্যস্ত।

পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি প্রকল্প চলমান। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে বর্তমান সরকার শহর থেকে শুরু করে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। প্রকল্পের সংখ্যাও দিনদিন বাড়ছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে ও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, প্রকল্প বাস্তবায়নে জনসাধারণ কতটুকু সুবিধা পাচ্ছেন এবং প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জন হচ্ছে কি না— নিরপেক্ষ থেকে এসব তথ্য প্রতিবেদন আকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরামর্শ দেয় আইএমইডি।

দিনদিন প্রকল্পের সংখ্যা যেহেতু বাড়ছে সেহেতু আইএমইডি’র জনবল ও কলেবর বাড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে এর উল্টো। কাগজে-কলমে এর পরিসর বাড়লেও কমেছে কর্মকর্তার সংখ্যা। পদ খালি হলেও তা পূরণে নেওয়া হচ্ছে দীর্ঘ সময়। ফলে বিশাল উন্নয়ন বাজেটের প্রকল্পগুলো জনবল সংকটে কার্যকরভাবে দেখভাল করা যাচ্ছে না।

বিভাগটির অনুমোদিত প্রথম শ্রেণির ১৩৮ কর্মকর্তার বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮৪ জন। অর্থাৎ এ বিভাগে মোট ৫৪ কর্মকর্তার পদ খালি আছে। অন্যদিকে, অনুমোদিত দ্বিতীয় শ্রেণির ৬০ কর্মকর্তার বিপরীতে বর্তমানে আছেন মাত্র ১৩ জন। বাকি ৪৭ কর্মকর্তার পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি

আইএমইডি’র ওয়েবসাইটে সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়টি উল্লেখ আছে। সেখানে দেখা যায়, বিভাগটির অনুমোদিত প্রথম শ্রেণির ১৩৮ কর্মকর্তার বিপরীতে কর্মরত আছেন ৮৪ জন। অর্থাৎ এ বিভাগে মোট ৫৪ কর্মকর্তার পদ খালি আছে। অন্যদিকে, অনুমোদিত দ্বিতীয় শ্রেণির ৬০ কর্মকর্তার বিপরীতে বর্তমানে আছেন মাত্র ১৩ জন। বাকি ৪৭ কর্মকর্তার পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি।

দিনদিন প্রকল্পের সংখ্যা বাড়লেও আইএমইডি’র জনবল ও কলেবর সেভাবে বাড়েনি

সচিবালয় নির্দেশমালা- ২০১৪ এর বিধি- ১১ অনুযায়ী, প্রশাসনিক কর্মকর্তার দৈনন্দিন কাজ আটটি। বিধি- ১২ অনুযায়ী, ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কাজ ১০টি। এসব কাজের মাধ্যমে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভাগের সচিব বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজ নিষ্পত্তি করেন। এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত কর্মকর্তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দাফতরিক কাজ সম্পাদন করেন। এ পদগুলোর সিংহভাগ পূরণ হয় সচিবালয় নিয়োগ বিধিমালা- ২০১৪ অনুযায়ী, পদোন্নতির মাধ্যমে। কিন্তু ফিডার পদধারীদের মধ্যে পদোন্নতিপ্রাপ্তির বিষয়ে গত সাত বছর ধরে আইএমইডিতে চারটি মামলা চলমান। এসব জটিলতা নিরসনে আইএমইডি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ। অথচ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ডিজি- ২ আইএমইডিতে কোনো মামলা বা নিয়োগ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি আটকে আছে কি না— তা জানতে চাইলেও আইএমইডি’র কর্তারা সরাসরি বিষয়টি গোপন রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আইএমইডি’র যুগ্ম সচিব কাজী আনোয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত চিঠিতে মামলার বিষয়টি গোপন রাখা হয়।

আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, চলমান মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হলে বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের শূন্য পদগুলো পূরণ হয়ে যেত। এ অবস্থায় কোনো সচিব মামলা নিষ্পত্তি করেননি। উল্টো মামলার তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালে সচিবালয় নিয়োগ বিধি জারির পরিপ্রেক্ষিতে আইএমইডি’র ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা এসব মামলা করেন।

আইএমইডি’র সাবেক যুগ্ম সচিব কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এখন এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আমার এখন কিছু মনে পড়ছে না, তবে জেনে বলতে পারব।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো চিঠি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে দিইনি। এরকম কোনো চিঠি দিয়েছি, আমার মনে পড়ছে না।’

তথ্য গোপনের বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাজী আনোয়ার হোসেন কেন তথ্য গোপন করেছেন তা আমি কীভাবে বলব? আমিও এ বিষয়ে অবগত নই। যতটুকু জানি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সব বিভাগের শূন্য পদ পূরণের জন্য ফলোআপ করছে। সেখানে আমাদের প্রতিনিধি যান। কাজী আনোয়ার হোসেন একবার এবং অতিরিক্ত সচিব একবার গিয়েছিলেন।’

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে তথ্য গোপনের বিষয়টি আমার জানা নেই। তথ্য-প্রমাণ পেলে এর কারণ জানতে চাইব।’

দীর্ঘদিন আইএমইডিতে আছেন যারা 

সাধারণত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো কর্মকর্তাকে তিন বছরের বেশি সময় কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে রাখে না। কিন্তু আইএমইডিতে বর্তমানে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা আছেন যারা পাঁচ থেকে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে কর্মরত। একই বিভাগে দীর্ঘদিন থাকায় অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ থেকে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ওই কর্মকর্তারা হলেন- যুগ্ম সচিব মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বর্তমানে আইএমইডি’র সেক্টর ৫-এ পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। ২০১২ সালে আইএমইডিতে সহকারী পরিচালক (সহকারী প্রধান) হিসেবে যোগ দেন তিনি। 

উপ-পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। তিনি এ বিভাগে ২০১৪ সাল থেকে কর্মরত। উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মসিউর রহমান কর্মরত আছেন সেক্টর ৭-এ। তিনি পাঁচ বছরের অধিক সময় এখানে আছেন। উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মুহাম্মদ মোস্তফা হাসান কর্মরত আছেন সেক্টর ৮-এ। তিনিও পাঁচ বছরের অধিক সময় এখানে কর্মরত।

প্রথম শ্রেণির ১৩৮ কর্মকর্তার বিপরীতে আছেন ৮৪ জন। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে আছেন অনেকে

আইএমইডি’র সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) অবস্থা আরও ভয়াবহ। এ ইউনিটের যুগ্ম সচিব ও পরিচালক আজিজ তাহের খান ও মো. শামিমুল হক আছেন পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। এছাড়া তিন বছরের বেশি সময় ধরে আছেন উপ-সচিব ও উপ-পরিচালক মো. আকনুর রহমান ও মো. মাহফুজার রহমান। অন্যান্য কর্মকর্তারাও আছেন তিন বছর বা এর চেয়ে বেশি সময় ধরে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে যারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে কর্মরত, তাদের বদলি শুরু হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে নিচে নামব। বিশেষ ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে একই বিভাগে থাকছেন। যদি ওই বিভাগের কর্তৃপক্ষ মনে করেন তাদের রাখা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে রাখা হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি নেই। ট্রেডিশন হলো, নরমাল ক্ষেত্রে তিন বছর, কোথাও কোথাও পাঁচ বছর।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাহলে তাকে বদলি করা হয়। আর কেউ যদি দীর্ঘদিন আইএমইডিতে থাকেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বদলি হয়ে যাবেন। আমরা ইতোমধ্যে লিস্ট (তালিকা) করেছি।’

দীর্ঘদিন আইএমইডি ও সিপিটিইউতে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘সিপিটিইউর ক্ষেত্রে আমি মনে করি যারা এক্সপার্ট, তাদের থাকা উচিত। আর আইএমইডিতে যারা আছেন, আমার মনে হয় না তারা তেমন এক্সপার্ট। সরকারের বদলির যে বিধিমালা আছে, সেটির আলোকে এটি করলে ভালো হবে।’

দীর্ঘদিন ধরে আইএমইডিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে কেউ আছেন কি না, তা আমার জানা নেই। এমন কেউ যদি থেকে থাকেন এবং সরকার যদি মনে করে তার বিকল্প নেই, তাহলে সরকার বিবেচনা করবে। তবে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি আমি দেখব। আমি সচিবকে জিজ্ঞাসা করব। কারা এতদিন ধরে এখানে আছেন, তাদের বিষয়ে আমি বিস্তারিত জানব। তারপর ব্যবস্থা নেব।’

বিশাল উন্নয়ন বাজেটের প্রকল্পগুলো জনবল সংকটে কার্যকরভাবে দেখভাল করতে পারছে না আইএমইডি

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের বর্তমান মহাসচিব আলী ইমাম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে বহু পদ খালি আছে। এতে কোনো কিছু ব্যাহত হওয়ার কারণ নেই। তবে শূন্যপদে জনবল নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের অনেকে এ বিভাগে দীর্ঘদিন চাকরি করছেন— এমন প্রসঙ্গ টানলে তিনি বলেন, ‘এখানে বদলিযোগ্য যেসব কর্মকর্তা আছেন, তাদের বদলি করা উচিত। আর চাহিদা অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে শূন্য পদের বিপরীতে কর্মকর্তা চাওয়া যেতে পারে।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রথম শ্রেণির সব কর্মকর্তাই পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে থাকে। সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী এ বিষয়ে সচিব ব্যবস্থা নেবেন। যেখানে যেখানে আমার অনুমোদনের প্রয়োজন, সেখানে নেবেন। আমার জানা মতে, এখন আমার দফতরে এ ধরনের কোনো ফাইল অপেক্ষমাণ নেই। প্রধানমন্ত্রী এর আগে আইএমইডিকে শক্তিশালী করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বর্তমান আইএমইডির পরিস্থিতির কথা জানেন না।’

জনবল নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানলাম, খোঁজ নেব। দ্বিতীয় শ্রেণির ৬০ পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১৩ জন। এখানেও নিয়োগের প্রয়োজন আছে। মূলত, এসব তথ্য আমার জানা ছিল না। এখন আমি এগুলো সম্পর্কে খোঁজ নেব। এছাড়া, আইএমইডির চলমান মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে পারলে বিস্তারিত বলতে পারব। এখন পর্যন্ত আইএমইডির মামলার বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। এটি নির্ভর করবে আইনি প্রক্রিয়ার ওপর।’

এসআর/আরএইচ/এমএআর/