ডিপিপিতে স্টিলের শাটার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে কিন্তু ব্যবহৃত হয়েছে বাঁশ, প্রতীকী ছবি

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর নারীর ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ‘জেন্ডার সক্ষমতা অর্জন এবং নারীর কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে’ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তাভাবনার ফলে বর্তমানে সবক্ষেত্রে নারীদের দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষিত হচ্ছে।

• তিন বছরে প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ
• দরপত্র মূল্যায়নে পিডিকে সম্পৃক্ত করা হয়নি
• প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করছে না ঠিকাদার

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তাভাবনা থাকলেও সরকারি কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতায় সঠিক সময়ে অনেক কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন- প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের কর্মক্ষম করতে ভবন নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এটি অনুমোদনের পর বছর না ঘুরতেই সংশোধন করা হয়। প্রায় তিন বছর পার হলেও প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি মাত্র ২০.০২ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ১৮.৭২ শতাংশ। চলতি বছরের (২০২১ সাল) জুনে এটি শেষ করার কথা থাকলেও অগ্রগতি যৎসামান্য।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে নারীদের প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়ায় বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) নারীদের হোস্টেল স্থাপনের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিটাক চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে নারী হোস্টেল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের (২০২১) জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়নে ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সময় মতো কাজও শুরু হয়। কিন্তু শুরুতে প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে জমির মূল্য বিবেচনা করা হয়নি। ফলে ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী আনা হয়। ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৭৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। একই সঙ্গে সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। বর্তমানে এ প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ বাকি। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে হলে আগামী এক বছরের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনে এসে নারীদের প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়ায় বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক) নারীদের হোস্টেল স্থাপনের নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘বিটাক চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে নারী হোস্টেল স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) চলতি মাসে (জুন) ‘বিটাক চট্টগ্রাম, খুলনা ও বগুড়া কেন্দ্রে নারী হোস্টেল স্থাপন’ প্রকল্পটি নিয়ে নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন দেয়। ‘ইনোভেশন এক্সপ্রেস’ নামক তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে রিপোর্টটি প্রণয়ন করেছে আইএমইডি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ক্রয় পরিকল্পনা অনুযায়ী কার্যক্রয় প্যাকেজে তিনটি সাইটের নির্মাণ কার্যক্রম একত্রিত করে চারটি প্যাকেজ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে চারটি প্যাকেজকে (প্রতিটি সাইটের জন্য চারটি প্যাকেজ) ১২টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। প্রকল্পের এসব নির্মাণকাজের দরপত্র মূল্যায়নে প্রকল্প পরিচালককে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এছাড়া খুলনায় হোস্টেল ভবন নির্মাণ সাইটে ঠিকাদার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করছে না এবং নির্মাণকাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ঠিকাদারের কথা ও কাজে অমিল লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরে বগুড়ায় হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে আট তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে এবং নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৪৫ শতাংশ। চট্টগ্রামে হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে তিন তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে এবং নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি ২৫.৭৫ শতাংশ। খুলনার সাইটে তিন তলার ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হয়েছে এবং নির্মাণকাজের বাস্তব অগ্রগতি ২৫.৫৩ শতাংশ।

খুলনা সাইটের হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে স্টিলের শাটারের সঙ্গে বাঁশের শাটারও ব্যবহার হয়েছে, প্রতীকী ছবি
আইএমইডি’র প্রতিবেদন বলছে, প্রকল্পের খুলনা সাইটে হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে স্টিলের শাটার ব্যবহারের সঙ্গে বাঁশের শাটারও (ছাদের ঢালাই ধরে রাখতে ব্যবহৃত খুঁটি) ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ডিপিপিতে স্টিলের শাটার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে

আইএমইডি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একই সঙ্গে শুরু করা অন্যান্য ঠিকাদারের কাজের তুলনায় খুলনার ঠিকাদারের কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। খুলনা সাইটে ঠিকাদারের অসহযোগিতার কারণে কাজের অগ্রগতি ধীরগতিতে হচ্ছে। প্রকল্পের খুলনা সাইটে হোস্টেল ভবন নির্মাণকাজে স্টিলের শাটার ব্যবহারের সঙ্গে বাঁশের শাটারও (ছাদের ঢালাই ধরে রাখতে ব্যবহৃত খুঁটি) ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ ডিপিপিতে স্টিলের শাটার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। 

কাজের ধীরগতির কারণে প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ফলে সময় বৃদ্ধিসহ এর ব্যয় বেড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। এছাড়া সময় মতো জনবলের সংস্থান করতে না পারলে হোস্টেল ভবনের নির্মাণ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) পরিচালক (পরিকল্পনা) ও প্রকল্প পরিচালক ড. মো. জালাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক আছে। তবে রডের পরিবর্তে নয়। এটার শাটারিং স্টিলের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিটাকের সঙ্গে গণপূর্তের চুক্তি হয়েছে। গণপূর্তই এসব কাজের টেন্ডারের দরপত্র আহ্বান করেছে।’ আপনাকে দরপত্র আহ্বানের কমিটিতে রাখা হয়নি কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা তো ইজিপিতে (অনলাইনে) টেন্ডার করে। এখানে বাইরের লোক রাখার বিষয়টি অপশনাল। তবে, আমাকে কেন কমিটিতে রাখা হয়নি; তা বলতে পারব না। তারা আমাদের কাউকে রাখেনি বা কোনো চিঠি দেয়নি।’

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রকল্প হলেও এটি বাস্তবায়নে এত দেরি হচ্ছে কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্প পরিচালক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘করোনার জন্য প্রকল্পের কাজে বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া প্রি-কাস্ট পাইলিং করতেই আড়াই মাস লেগে যায়। তবে আমরা আশাবাদী, আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত করা সম্ভব হবে। এছাড়া ঠিকাদার আগের চেয়ে কাজের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠিকাদারের সঙ্গে যে সমস্যা ছিল তাও সমাধান হয়ে গেছে।’

বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রে (বিটাক)

এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, “প্রকল্পের কাজে ধীরগতি নতুন কিছু নয়। এগুলো দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে। বিশ্ব ব্যাংক তিন বছর আগে একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ‘পাবলিক ফাইন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট’র ওপরে প্রতিবেদনটি করা হয়। সেখানে তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন হয় না। যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ বেড়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ প্রকল্পের উপকার থেকে বঞ্চিত হয়। এরপরও যে কাজটুকু হয়, সেটাও বছরের শেষের দিকে গিয়ে তড়িঘড়ি করা হয়। তখনই নিম্নমানের উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটা সম্পন্ন হয়। এমনও দৃষ্টান্ত আছে, কোনো কোনো জায়গায় কাজ না করেই টাকা তোলা হয়।”

তিনি আরও বলেন, ‘এ কাজগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। উন্নয়ন যদি ব্যাহত না হতো তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ত। উন্নয়ন যেন সঠিকভাবে হয় সেজন্য নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতার প্রয়োজন। কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি বা গাফিলতি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এগুলো করতে না পারলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।’

এসআর/এমএআর/